ফরিদপুরের নগরকান্দার সদরবেড়া গ্রামের তপন ফকির। কেউ চেনেন তপন সাধু নামে। আবার এলাকাবাসীর কাছে তপন ওঝা নামেও তিনি পরিচিত। বয়স ষাটর্ধ্বো। নানান রোগে অসুস্থদের সাড়িয়ে তোলার নানা টোটকা দেন তিনি।
নৌকায় দুধ-গুড়ের রসে ভেজা তিন দিনব্যাপী চিতই পিঠার মেলার আয়োজন করে এলাকায় বেশ পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। স্বপ্নে আদেশ পেয়ে ভক্তদের জন্য প্রায় তিন যুগ ধরে নৌকার মধ্যে দুধ, গুড়ের রসে চিতই পিঠা ভিজিয়ে ভক্তদের খাওয়াচ্ছেন। যেটা ওই এলাকার একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ২০ টি মাটির চুলায় মাটির পিঠার ছাচে গ্রামের বেশ কয়েকজন মহিলা তৈরি করছেন চিতই পিঠা। পাশেই বড় বড় পাতিলে জাল দেয়া হচ্ছে দুধ, আরেকটিতে ফুটানো হচ্ছে টাটকা খেজুরের রস। উঠানের মাঝখানে রাখা হয়েছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও রং করা একটি নৌকা। নৌকার মাঝখানে পলিথিন বিছানো, কিনারে লাগানো আছে কয়েকটি লাল নিশান। ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখা আছে একটি বৈঠা। সারি সারি জ্বালানো হয়েছে মোমবাতি। এ মেলা ঘিরে বসেছে রঙ বেরঙের নানান খেলনা, খাবারের দোকান, আচারের দোকানসহ বিভিন্ন প্রকারের দোকানদার। তারা পশরা সাজিয়ে বিক্রি করছেন নানান সব জিনিসপত্র।
তপন ফকির বলেন, প্রায় তিন যুগ ধরে চলছে তার এ দুধ-গুড়ে ভেজানো চিতই পিঠার মেলা। তিন যুগ আগে হঠাৎ এক রাতে তিনি স্বপ্নে আদেশ পান। সেই ওহি মোতাবেক প্রতি বছর আমি পালন করে আসছি। প্রতিবছর মাঘ মাসের পূর্ণিমার রাতে শুরু হয়ে ৩ দিন ধরে নৌকার মধ্যে দুধ-খেজুরের রসে ভিজিয়ে চিতই পিঠা এলাকাবাসী ও ভক্তদের খাওয়াতে হবে। তাতেই বাড়বে তার দৈবশক্তি। সেই থেকে বিশ্বাস আর শুরু। প্রতিবছর এ সময় তিনি গ্রামবাসী ও ভক্তদের নৌকায় ভেজানো দুধ চিতই পিঠা খাওয়ানোর আয়োজন করে আসছেন।
জানা গেছে, তপন ফকিরের দুধ চিতইয়ের মেলা’ নামে পরিচিত এই দুধ চিতই উৎসব। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়ে সোমবার রাতে শেষ হয়েছে এ অনুষ্ঠান। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শুরু হয় পিঠা খাওয়ার আয়োজন।
সন্ধ্যার পর পাতিলে দুধ আর খেজুরের রস মিশিয়ে ঢেলে দেয়া হয় নৌকায়। এর মধ্যে ডুবিয়ে দেয়া হয় চিতই পিঠা। বাটিতে তুলে তুলে পরিবেশন করা হয় ভক্ত ও দর্শনার্থীদের মাঝে। তবে প্রতি বছর মাঘ মাসের পূর্ণিমায় শুরু হলেও এবার পূর্ণিমা ফাল্গুন মাসে হওয়ায় অনুষ্ঠানটি একটু পিছিয়ে গেছে।
তপন সাধুর বাড়ির খাদেম মোঃ আব্বাস মিয়া বলেন, এবার প্রতিদিন মেলায় ৫ মণ দুধ, ১ মণ খেজুরের রস আর প্রায় ১০ হাজার পিচ চিতই পিঠা ভেজানো হয়। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় খাওয়া চলে গভীর রাত পর্যন্ত। প্রতিদিন আয়োজনের পিঠা শেষ হয়ে যায়।
উৎসব দেখতে স্থানীয়রা ছাড়াও দুর দুরান্ত থেকে অগুনিত মানুষ ভিড় করে। ফরিদপুর জেলা সদর থেকে আগত শোভন বলেন,আমি জীবনে কোথাও দেখি বা শুনি নাই এরকম নৌকার মধ্যে ভেজানো পিঠার কথা। তাই দেখতে এসেছি। ব্যাতিক্রমী বটে। বেশ ভালো লাগছে।
গ্রামের বাসিন্দা পরিমল চন্দ্র শীল বলেন, ব্যাতিক্রমী আয়োজনে আমরা প্রতি বছর এখানে পিঠা খেতে আসি। একদম গরম ভেজানো পিঠা। খুবই সুস্বাদু খেতে।
উৎসবে আগত অনেক দর্শনার্থীরা এ প্রতিনিধির কাছে অভিযোগ করেছেন, এই পিঠা তৈরী ও বিতরন স্বাস্থ্য সম্মত না। তাই এই দিকে নজর রাখার জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান।
তালমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি মাঘ মাসের শেষের দিকে তিন দিনব্যাপী এমন ধরনের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় এলাকাবাসী ছাড়াও দুর দুরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটে এই আয়োজন দেখতে।
প্রিন্ট