দেশবাসীকে কর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শুধু রাজধানী বা শহরে নয়, সারা দেশে যারা কর দিতে সক্ষম, দয়া করে তারা কর পরিশোধ করুন। সরকার আপনাদের পরিষেবা এবং কল্যাণে এই অর্থ ব্যবহার করবে।
রোববার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) দুইদিনব্যাপী রাজস্ব সম্মেলন উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা বলেন। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশে এটিই প্রথম এ ধরনের সম্মেলন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক মন্দা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়েছে। এটা মোকাবিলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমরা যত বেশি ট্যাক্স সংগ্রহ করব, ততই এটি অতিক্রম করা সহজ এবং সম্ভব হবে।’
তিনি করের পরিমাণ বাড়ানোর পরিবর্তে করদাতার সংখ্যা সম্প্রসারণে আন্তরিকতা ও পেশাদারির সঙ্গে কাজ করতে এবং জনগণকে কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে সারা দেশে ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তেল, গ্যাস, গম, ভোজ্যতেল, চিনিসহ প্রতিটা জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। আমরা ভর্তুকি দিয়ে এসব পণ্য অধিক মূল্যে কিনে এনে তা কম মূল্যে দেশের মানুষকে দিচ্ছি। এক কোটি মানুষ টিসিবির কার্ড পেয়েছে, সবখানে ভর্তুকি মূল্যে মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করা হচ্ছে। কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। করোনাকালে শিল্প ও কলকারখানা চালু রাখার জন্য সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। এভাবেই সরকার সবাইকে দুঃসময়ে ভর্তুকি অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, এখন সরকার যাতে রাষ্ট্র চালাতে পারে বা মানুষের জন্য কাজ করতে পারে, সেদিকে সবাইকে দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ ভর্তুকি আমরা আর কত দিতে পারব। উন্নয়ন কাজগুলো যাতে ব্যাহত না হয়, সেদিকও আমাদের দেখতে হবে।
সরকারপ্রধান বলেন, আপনারা উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে যদি যান, যে পরিবর্তন হয়েছে গত ১৪ বছরে, সেই পরিবর্তনটা দেখতে পাবেন। এখন আর কেউ কুঁড়ে ঘরে বাস করে না, ভূমিহীন-গৃহহীন প্রত্যেককে সরকার বিনে পয়সায় ঘর তৈরি করে দিচ্ছে। আর্থিক সহায়তা দিয়ে জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। পাশাপাশি ব্যবসাবাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগও করে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, করদানের সক্ষমতা কিন্তু উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও রয়েছে। সেখানে আমরা যদি একটু প্রচার চালাই, তাহলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসবে, কারণ তারা তো সেবা পাচ্ছে। এই সেবাটা পাওয়ার জন্যই তারা করবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম এবং সদস্য ড. আব্দুল মান্নান শিকদার। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য প্রদ্যুৎ কুমার সরকার। অনুষ্ঠানে এনবিআর-এর কার্যক্রমের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশে আয়কর প্রদানকারীর সংখ্যা এখনো অনেক কম। অনেকে একে ঝামেলা মনে করেন। তবে এর জন্য জোর-জুলুম খাটানো যাবে না। মানুষকে ভয়ভীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলা যাবে না। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। জনগণকে জানাতে হবে যে আপনি যে কর দেন, সেটা কিন্তু আপনার কাজেই লাগে।
তিনি বলেন, যাদের কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে, সর্বক্ষেত্রে ডিজিটাল সিস্টেম হয়ে গেলে তারা ফাঁকি আর দিতে পারবে না। মানুষ যাতে কর ফাঁকি না দেয়, সেজন্য আর করের পরিমাণটাও এমন রাখতে হবে যাতে প্রতিটা মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিতে পারে।
শেখ হাসিনা বলেন, দ্বিতীয়বার আমরা ক্ষমতায় এসে সবার আয় বাড়ানোর পাশাপাশি করের আওতায় আনার উদ্যোগ নিই। আর আমরাই প্রথম চালু করি যে প্রত্যেক সংসদ-সদস্যকেও আয়কর দিতে হবে। সংসদ-সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে আগে কর দিলেও সংসদ-সদস্য হিসাবে তাদের কর রেয়াত ছিল। আমরাই, প্রধানমন্ত্রীরও কর দেওয়ার ব্যবস্থা করি শুধু মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছাড়া। ফলে করদাতার সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ই-টিনধারীদের রিটার্ন প্রদানে উদ্বুদ্ধ করে সক্ষম করদাতাদের কর নেটের আওতায় আনা হয়েছে। ইতোমধ্যে আয়কর বিভাগ কর্তৃক নন ফাইলার কোম্পানির রিটার্ন দাখিলের জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। করদাতারা যাতে ঘরে বসে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারেন, তার জন্য ই-ফাইলিং ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী কাস্টমস ব্যবস্থাপনায় অনুসৃত ‘ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট প্র্যাকটিসেস’ বিবেচনায় নিয়ে একটি নতুন কাস্টমস আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকসহ সব তফশিলি ব্যাংক, বেপজা, সিসিআইঅ্যান্ডই, বিআরটিএ, আইএটিএ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ অনেক স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কাস্টমস বিভাগের কম্পিউটার সিস্টেমের ইন্টারফেসিং ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে পরোক্ষ করব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন হিসাবে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, আধুনিক বিনিয়োগ ও রাজস্ববান্ধব আইনটি ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। জনগণ এখন অনলাইনে মূল্য সংযোজন কর নিবন্ধন এবং অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করতে পারছে এবং ‘ইএফডিএমএস’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এর আগে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ৪১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নবনির্মিত ১২ তলা রাজস্ব ভবন উদ্বোধন করেন।
উন্নত দেশ গড়তে দেশে বিনিয়োগ করুন : প্রধানমন্ত্রী এদিন সকালে রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নবনির্মিত ‘বিনিয়োগ ভবন’ উদ্বোধন করেন। এ সময় তিনি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে দেশে বিনিয়োগে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সবাই বিনিয়োগ করলে নিজেরাও লাভবান হবেন, দেশটাও লাভবান হবে। বহুতল বিনিয়োগ ভবনটি তিনটি সংস্থা-বিডা, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এবং জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৪ বছরে ব্যবসায়ীবান্ধব পরিবেশ আমরা সৃষ্টি করেছি। শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা ব্যবসা করেন। এখন আর ওই হাওয়া ভবনের পাওয়াও দিতে হয় না। আমাদের উন্নয়নের লক্ষ্য তৃণমূলের মানুষ। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। তাই নিজস্ব বাজার হচ্ছে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আশপাশের যে দেশগুলো রয়েছে, তাদের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগ স্থাপন করছি।
তিনি বলেন, ভুটান, নেপাল, ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার সর্বক্ষেত্রেই চমৎকার একটি যোগাযোগের জায়গা। তাছাড়া এই দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ৩শ কোটি মানুষের বাজার, এ সুবিধাটা যে কেউ নিতে পারেন। আমরা কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের এয়ারপোর্ট করে দিচ্ছি, ঢাকার সঙ্গে সরাসরি রেললাইন করা হয়েছে, সড়কের উন্নয়ন করেছি। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়, ইস্ট ও ওয়েস্টের মধ্যে একটা ব্রিজ হতে পারে বাংলাদেশ। সেভাবেই আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলছি। আমরা মনে করি, আমাদের ভৌগোলিক যে অবস্থান, সেটাও অত্যন্ত অনুকূলে।
শেখ হাসিনা বলেন, মাতারবাড়ীতে ইতোমধ্যে ডিপ সি পোর্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে, পায়রা পোর্টের উন্নতি হচ্ছে, মোংলা পোর্টকে আমরা উন্নত করছি, বে-টার্মিনালসহ আরও অনেক সুবিধা আমরা সৃষ্টি করে দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া উপস্থিত ছিলেন।
বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব না। ইংল্যান্ড দেড়শ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এটা সবার মনে রাখতে হবে। আমরা কিন্তু সেই পর্যায়ে যাইনি। গ্যাস-বিদ্যুৎ দেওয়া যাবে ক্রয়মূল্যে। আর কত ভর্তুকি দেওয়া যায়। আর এক্ষেত্রে কেন দেব। আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি কৃষিতে, খাদ্য উৎপাদনে। এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১২ টাকা খরচ হয় উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, সেখানে আমরা নিচ্ছি মাত্র ৬ টাকা। তাতেই আমরা অনেক চিৎকার শুনি। গ্যাস-বিদ্যুৎ সাপ্লাই দেওয়া যাবে যদি সবাই ক্রয়মূল্য যা হবে সেটা দিতে রাজি থাকেন। তাহলে দেওয়া যাবে। তাছাড়া আর কত ভর্তুকি দেওয়া যায়।
প্রিন্ট