জনরোষ এড়িয়ে নির্বিঘ্নে দেশত্যাগ করতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বিমানবন্দরে যান অনেকটা ছদ্মবেশে। বুধবার মধ্যরাতে তিনি লুঙ্গি, গেঞ্জি ও মুখে মাস্ক পরে শাহজালালের ভিআইপি টার্মিনালে হাজির হন। এরপর কঠোর গোপনীয়তায় তাকে বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকানো হয়। এক পর্যায়ে সব ধরনের নিরাপত্তা তল্লাশি এড়িয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাকে নির্বিঘ্নে বিমানে তুলে দেন। এ সময় ইমিগ্রেশনে তিনি কূটনৈতিক সুবিধার বিশেষ লাল পাসপোর্ট ব্যবহার করেন।
.
সূত্র জানায়, রাত পৌনে ১টায় আবদুল হামিদের ব্যক্তিগত গাড়িটি বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালে পৌঁছায়। এ সময় সেখানে দায়িত্বরত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তার গাড়ি আটকে দেন। তারা আরোহীদের পরিচয় জানতে চান। গাড়িচালক জানালার কাচ নামিয়ে বলেন, গাড়িতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পরিবারবর্গ রয়েছেন। এ কথা শোনার পর গাড়িটিকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলা হয়।
.
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গাড়ি বাইরে অপেক্ষমাণ রেখে ভেতরে ঢোকেন। এ সময় নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্সের খোঁজ চলাকালে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির সামনে এসে হাজির হন। সাবেক রাষ্ট্রপতির বহির্গমন অনুমোদন রয়েছে বলে জানান তিনি। এক পর্যায়ে আবদুল হামিদসহ তার সফরসঙ্গীদের বিমানবন্দরের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার হয়। এ সময় আবদুল হামিদ গাড়িতে বসেই পোশাক বদল করেন। পরনে থাকা লুঙ্গি গেঞ্জি পরিবর্তন করে প্যান্ট ও শার্ট পরে নেন।
.
সূত্র জানায়, ভিআইপি টার্মিনাল দিয়ে ঢোকার পর আবদুল হামিদকে প্রথমে বিমানবন্দরের উপ-প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার (ডিএসও) কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। এক পর্যায়ে সেখানে সিভিল এভিয়েশন এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এভসেক’র কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত হন। এ সময় আবদুল হামিদের দেশত্যাগের বিষয়টি জানিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে কয়েক দফা ফোন করা হলে গ্রিন সিগনাল দেওয়া হয়। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিরাপত্তা তল্লাশি এড়িয়ে নির্বিঘ্নে তাকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়।
.
সূত্র জানায়, আবদুল হামিদের সুবিধার জন্য তাকে বহনকারী থাই এয়ারওয়েজের বিমানটিকে (ফ্লাইট নম্বর টিজি৩৪০) ভিআইপি টার্মিনালের কাছাকাছি আনা হয়। এরপর বিমান ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বিশেষ গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিমানবন্দরের ১২ নম্বর আউট-বে এলাকায়। আবদুল হামিদ বিমানে ওঠার বেশ কিছুক্ষণ পর সফরসঙ্গী ছেলে রিয়াদ আহমেদ এবং শ্যালক ডাক্তার এনএম নওশাদ খান বিমানে ওঠার অনুমতি পান।
.
সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় কঠোর গোপনীতার মধ্য দিয়ে। বিমান কাউন্টার থেকে রাজু নামের থাই এয়ারওয়েজের এক কর্মী বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ করেন। পরে ইমিগ্রেশনে আবদুল হামিদের নামে ইস্যুকৃত কূটনৈতিক মর্যাদার বিশেষ লাল পাসপোর্ট দেখানো হয়। নিয়মানুযায়ী ইমিগ্রেশনে উপস্থিত হয়ে এ সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়মকানুন সম্পন্ন করার কথা। তবে তাকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে চাননি। ধারণা করা হচ্ছে, নিরাপদে দেশত্যাগে সুযোগ করে দিতে এ প্রক্রিয়া নিয়মানুযায়ী সম্পন্ন করা হয়নি। ইমিগ্রেশনে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ৫ আগস্টের পর এখানে যারা কর্মরত আছেন তারা অনেকেই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের এবং ফ্যাসিস্টবিরোধী। এটা তারা জানত। এ কারণে তাদের কারও মুখোমুখি আবদুল হামিদকে করা হয়নি।
.
সূত্র বলছে, আব্দুল হামিদ বিমানে ওঠার আগ পর্যন্ত বিমানবন্দরে দায়িত্বপ্রাপ্ত সব সংস্থার প্রতিনিধিরা রীতিমতো নিশ্চুপ ছিলেন। বিশেষ করে পুলিশের বিশেষ শাখা, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি), বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনী এভসেক এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ছিলেন অনেকটা দর্শকের ভূমিকায়। অথচ এদিন উচ্চপর্যায়ের পরিদর্শনের কথা বলে পুরো বিমানবন্দর কড়া নিরাপত্তায় ঘিরে রাখা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গভীর রাত পর্যন্ত বিমানবন্দরে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। এসব কারণে আবদুল হামিদের এভাবে দেশত্যাগ নিয়ে নানান প্রশ্ন ও সন্দেহের উত্তর মিলছে না। পুরো বিষয়টি যেন রহস্যেঘেরা।
.
লাল পাসপোর্ট ঘিরে যত প্রশ্ন : আবদুল হামিদ দেশ ছাড়েন কূটনৈতিক সুবিধার বিশেষ পাসপোর্টে (নম্বর ডি০০০১০০১৫)। রাষ্ট্রপতি থাকার সময় ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি তার নামে ১০ বছর মেয়াদি এই পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। ২০৩০ সালের পহেলা জানুয়ারি পর্যন্ত এর মেয়াদ রয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের লাল পাসপোর্ট ইতোমধ্যে বাতিল হলেও আবদুল হামিদের পাসপোর্ট বাতিল হয়নি। যা নিয়ে এখন নানারকম প্রশ্ন ডালপালা মেলছে।
.
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতিরা আমৃত্যু বিচারপতির পদমর্যাদা ভোগ করে থাকেন। এছাড়া বিদ্যমান আইনেও সাবেক রাষ্ট্রপতিদের ব্যবহৃত পাসপোর্ট সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। তবে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের অন্যতম দোসর হিসেবে সরকার চাইলে আবদুল হামিদের পাসপোর্ট বাতিলে বিশেষ নির্দেশনা দিতে পারত। যেহেতু করা হয়নি, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, কোনো বিশেষ কারণেই করা হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত এভাবে তাকে দেশত্যাগ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রকৃত সত্য জানতে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে বৈকি।
.
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বরাষ্ট্র বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও আবদুল হামিদের পাসপোর্টের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এর ফলে তিনি সম্পূর্ণ বৈধ পাসপোর্টে দেশত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছেন। এখন লাল পাসপোর্টে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরে তিনি কূটনৈতিক হিসাবে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করবেন। এছাড়া বিদ্যমান নিয়মানুযায়ী তিনি বেশ কয়েকটি দেশে ভিসামুক্ত চলাচলেরও সুবিধা পাবেন।
.
সংশ্লিষ্টরা জানান, আবদুল হামিদের সফরসঙ্গী ছেলে রিয়াদ আহমেদ ও শ্যালক ডা. এনএম নওশাদ খানের হাতে সাধারণ পাসপোর্ট রয়েছে। রিয়াদ আহমেদের পাসপোর্টের (নম্বর বি০০০৬৯৮৮০) মেয়াদ রয়েছে ২০৩০ সালের ২২ নভেম্বর এবং নওশাদ খানের পাসপোর্টের (নম্বর এ০৭৯৫০৬৯১) মেয়াদ ২০৩৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
.
সূত্র জানায়, বিমানবন্দরে আবদুল হামিদের গন্তব্য থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক দেখানো হলেও দিল্লি পর্যন্ত তার টিকিট রয়েছে। এছাড়া ১৬ জুন তার দেশে ফেরার টিকিট কনফার্ম করা আছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি বা এ ধরনের কোনো ভিআইপি কেউ বিমাবন্দরে এলে নিয়মানুযায়ী আগে থেকেই সিভিল এভিয়েশনসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য সংস্থাগুলোকে জানাতে হয়। কিন্তু আবদুল হামিদের ক্ষেত্রে এসব নিয়মের কিছুই মানা হয়নি। মূলত পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আবদুল হামিদের দেশত্যাগের মিশন সফল করতে পুরো বিষয়টি গোপন রাখা হয়।
প্রিন্ট