১৯৮১ সালের ২৯ মে তৎকালীন সার্কিট হাউজের ৪ নম্বর কক্ষে উঠেছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সারাদিন ব্যস্ত ছিলেন নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে। গভীর রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। এর মধ্যে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। সেই রাতে অনেকের মতো ঘুম ভাঙে চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি একরামুল করিমের। সার্কিট হাউজের কাছাকাছি বাসা হওয়ায় সকাল হতেই বেরিয়ে পড়েন কী হয়েছে জানতে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সার্কিট হাউজের কাছে যেতেই থামিয়ে দেওয়া হয় তাদের। সকাল ৮টার দিকে মহানগর বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও যুবদলের ক’জন গিয়ে জানার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। শহীদ জিয়ার রক্তে ভেজা সেই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃহস্পতিবার এসব কথা বলেন চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি একরামুল করিম।
–
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থেকে নির্বাচিত হয়ে জামাল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে। অপরদিকে ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্বে ছিলেন নগরীর ডবলমুরিং থেকে নির্বাচিত সংসদ-সদস্য ব্যারিস্টার সুলতান আহমেদ চৌধুরী। তৎকালীন মহানগর বিএনপির কমিটি নিয়ে জামাল উদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিস্টার সুলতান আহমেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্ব নিরসন করতেই মূলত চট্টগ্রাম এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
–
তিনি আরও বলেন, জিয়াউর রহমান যেদিন চট্টগ্রামে আসবেন, সেদিন জামাল উদ্দিন ও ব্যারিস্টার সুলতান আহমেদকে চট্টগ্রামে আসতে নিষেধ করেছিলেন। ওনার সঙ্গে (জিয়াউর রহমান) এসেছিলেন দলের তৎকালীন স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ডা. বি. চৌধুরী, একরামুল হক, আমেনা বেগমসহ আরও তিন-চার জন। আর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেই রাতটিই ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়ার জীবনের শেষ রাত। গভীর রাতে এখানেই তিনি শহীদ হন।
–
জানা যায়, ১৯৮১ সালের ৩ জুন তৎকালীন সার্কিট হাউজকে একটি জাদুঘরে রূপান্তরের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৯৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এর উদ্বোধন হয়। এখানে জিয়াউর রহমানের ব্যবহৃত ব্যক্তিগত বেশকিছু সামগ্রী এবং কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে আনা স্বাধীনতা ঘোষণার ট্রান্সমিটারটি সংরক্ষিত রয়েছে। তৎকালীন সার্কিট হাউজটি পরে ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘর’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এটি বন্ধে নানা পরিকল্পনা হয়েছিল। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন চট্টগ্রামের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। ক্ষমতার দাপটে তার নেতৃত্বে মুছে দেওয়া হয়েছিল নামফলক। জাদুঘরটির এখন বেহাল দশা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে শত বছরের ভবনটি সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন দর্শনার্থী ও বিএনপি নেতারা।
–
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শত বছরের ভবনটিতে এখন কয়েক কদম পরপর বড় বড় ফাটল ধরেছে। পলেস্তারা খসে পড়ছে। রং উঠে পরিবেশ স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। পর্যাপ্ত লাইট ও ফ্যান নেই। একটু বৃষ্টি হলেই ছাদের টিন বেয়ে পানি পড়ে নষ্ট হয় সব। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সংযুক্ত শোকেস, ডায়োরামা, আলোকচিত্র ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে মূল অডিটোরিয়াম ভবনটি বন্ধ হয়ে আছে। সেমিনার হল কক্ষের এসি, জেনারেটর ও আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম না থাকায় মাত্র দুটি মাইক্রোফোন দিয়ে কোনোরকমে চালু রাখা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে জাদুঘরটি পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। বর্তমানে এই জাদুঘরে ৪৩টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৩০ জন। তাদের মধ্যে দুজন অস্থায়ী ভিত্তিতে। কিউরেটর, হিসাবরক্ষক, লাইব্রেরিয়ানসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে খালি। কর্মকর্তারা জানান, লোকবল সংকটে তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। একেকজনকে একের অধিক পদের কাজ করতে হচ্ছে।
–
১৯ মে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জিয়া স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। পরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পরিকল্পনা তুলে ধরেন। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘর আমরা পরিদর্শন করেছি। এটা শুধু চট্টগ্রামের বিষয় নয়। জিয়াউর রহমানের পূর্ণাঙ্গ জীবন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা, কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে শুরু করে উনার পূর্ণাঙ্গ জীবনী, রাষ্ট্র পরিচালনায় উনি কী কী সিগনিফিকেন্ট কাজ করেছেন, সবগুলো জিনিস যেন আসে। এ জিনিসগুলো কীভাবে প্রপারলি অডিয়েন্সের কাছে রিপ্রেজেন্ট করা যায়, এজন্য একটা কিউরেটর টিম লাগবে, সেই টিমটা আমরা তৈরি করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা ১৫-১৬ বছর অলমোস্ট ইনঅ্যাক্টিভ ছিল। এটা আমার মন্ত্রণালয়ের অধীনেই একটি প্রতিষ্ঠান। ফলে এটা আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এজন্য মাসতিনেক আগে আমরা মন্ত্রণালয়ে একটা ইন্টারনাল সভা করেছি। সেই মিটিংয়ে প্রথম কাজটা আমরা করেছি, এটার যে বরাদ্দ ছিল, সেটা আমরা দ্বিগুণ করেছি। এবার এখানে এসে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনের পর আমরা সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। শুধু বরাদ্দ বাড়ানোই গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এটাকে একটি পূর্ণাঙ্গ মিউজিয়ামে রূপান্তর করা। সেটা করার জন্য দরকার হচ্ছে প্রপার কিউরেটর, যারা বিষয়গুলো জানবেন।’
–
এদিকে শুক্রবার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল ও অঙ্গ সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। এরইমধ্যে বৃহস্পতিবার মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে রাঙ্গুনিয়াস্থ মাজারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়।
–
প্রসঙ্গত, তৎকালীন দ্বিতল সেই সার্কিট হাউজ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার পাশে গড়ে তোলা হয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট নতুন সার্কিট হাউজ। সেখানে সরকারের মন্ত্রী-এমপি আমলাসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা চট্টগ্রামে সফরকালে অবস্থান করেন।
প্রিন্ট