ঢাকা , শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫, ৮ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আ. লীগ নেতা কৃষ্ণ চন্দ্র এখন এনসিপিতে Logo ইতিহাস ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ গোপালগঞ্জ -ভিপি নুরুল হক নুর Logo শহিদুল ইসলাম বাবুলের মুক্তির দাবিতে সদরপুর বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ Logo মধুখালীতে ইউনিয়ন কর্মী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, আহত ১০ Logo বৃহত্তর রাজশাহীর কৃষি শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান সুমন রাফি Logo মাগুরায় সাবেক এমপি কাজী কামাল ও যুবদল নেতা নয়নের গণ সংবর্ধনা Logo চট্টগ্রামের পটিয়ায় প্রধান শিক্ষকের উপর দুর্বৃত্তদের হামলা Logo আমরা সবাই মিলে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করবোঃ -মহম্মদপুরে কাজী কামাল  Logo কালুখালীতে শিল্প ও বনিক সমিতির আহ্বায়ক কমিটি গঠন Logo ঠাকুরগাঁওয়ে চাষ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপাইন জাতের আখ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

তাল ও তাল পাতার সেপাই

মুরাদ হোসেনঃ

 

তাল গ্রামীণ একটি ফল। বাংলার গ্রামীণ প্রান্তরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে তালগাছ, যেন প্রাকৃতিক এক সেপাই। তাল গাছ সাধারণত ৩০-৬০ ফুট পর্য়ন্ত লম্বা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তালগাছ ১০০ ফুট পর্য়ন্ত লম্বা হতে পারে। তলগাছ ছায়া দেয়, বাতাসে দোলে আবার ঝড় এলেও দৃঢ় থাকে। তার পাতা যেন ঢাল, সূর্য ও বৃষ্টির আঘাত থেকে রক্ষা করে আশ্রয়প্রার্থীকে।

 

আবার সঙ্গীতের ভাষায় তাল মূলত লয় বা ছন্দের একটি নিয়মিত ভাগ। এটি গান, বাদ্য ও নৃত্যের সময়কে নির্দিষ্ট ছন্দে আবদ্ধ করে। তালের প্রকারভেদ মূলত এর মাত্রার উপর নির্ভর করে। শাস্ত্রীয় সংগীতে তাল ভিন্ন অর্থ বহন করে। সংগীত বিদ্যায় তাল সমপদী ও বিষমপদী প্রধানত এই দুই প্রকার। সংগীতে পারদর্শী ব্যক্তিকে তাল সম্বন্ধে জানতে হয়। সুর, তাল, লয় যদি খাপের খাপ না মেলে তবে সে সংগীত শ্রুতিমধুর হয় না। গানের কথা যাই হোক না কেন সে গান জনপ্রিয়তা হারাতে বসে। এখানে তালের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন গানের ছাত্রকে অবশ্যই তাল সম্পর্কে জানতে হয়।

 

এবার ফিরে আসি তালগাছ সম্বন্ধে, এটি এশিয়া ও আফ্রিকার গ্রীষ্মকালীল গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম বোরাশাস ফ্লাবেলিফার। ইংরেজিতে এই গাছকে উড়ঁন ঢ়ষধস বলা হয়। এরা এরিকাসি পরিবারের বরাসুস গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এর আদি বাস মধ্য আফ্রিকায়। ভারতীয় উপমহাদেশে তালগাছ প্রায় সর্বত্র পাওয়া যায়।
এবার বলি তার গাছ থেকে কি কি উপকার পাওয়া যায়, তাল গাছের প্রায় সব অঙ্গ ব্যবহৃত হয় এবং উপকরণ তৈরি করা যায়। তাল পাতা শুধু ছায়া দেয়না, বাংলার সংস্কুতি ও জীবনে মহুমুখী কাজে ব্যবহুত হয়- ঘর ছাওয়া, হাতপাখা, তালপাতার চাটাই, মাদুর, আঁকার পট, লেখার পুঁথি, কুণ্ডলী, খেলনা। এমনকি হস্তশিপ্লেও তার অবদান। তালের কাণ্ড দিয়েও বাড়ি, নৌকা, হাউস বোট ইত্যাদি তৈরী হয়। এই প্রাকৃতিক সেপাই, তাল ও তার পাতা, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্রামীণ জীবনের নীরব রক্ষক, আমাদের ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

তালের ফল এবং বীজ দুইই বাঙালির খাদ্য, তালের ফলের ঘন নির্যাস থেকে তাল ফুলুরি তৈরী হয়। কাঁচা ও পাকা দুই অবস্থাতেই তালের বীজ খাওয়া হয়। কচি তালের বীজের মধ্যে থাকে জলে ভরা তালশাঁস। আর পাকা তালের বীজ রেখে দিলে বীজ মধ্যস্থ শাঁস তালের আঁটিতে পরিণত হয় এবং বাঙালিদের সেটা সুস্বাদু খাদ্য। পাকা তালের নির্যাস থেকে পিঠা তৈরী হয়, যা সবার প্রিয়। তাল গাছের কাণ্ড থেকে রস সংগ্রহ করে গুড়, পাটালি, মিছরি তৈরি হয়, যা দিয়ে নানা রকম মুখোরচক খাবার বানানো হয়। তালে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ও সি, জিংক, পটাশিয়াম, আয়রন ও ক্যালসিয়ামসহ আরো অনেক খনিজ উপাদান। এর সাথে আরো আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও এ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান।

 

তাল কিলিয়ে পাকানো যায় না। সাধারণ বর্ষা ঋতুতে তাল পাকে। পাকা তাল গাছ থেকে একটি একটি করে মাটিতে পড়ে। তাই ন্যাড়া কখনও তাল তলায় যায় না। কদাচিৎ গেলে মাথায় হাত রাখে। না হলে সংকেত না দিয়েই তাল টাকে পড়তে পারে। তার ফল তখন ভিন্ন মাত্রায় যাওয়া স্বাভাবিক। তাল ফলের নির্যাস থেকে তৈরি হয় পিঠা,পায়েস, বড়া আরও কত কি। শহুরে বা গ্রামীণ যে কারোর কাছেই তাল দিয়ে তৈরি খাবার দারুণ উপভোগ্য। চৈত্রের প্রচণ্ড খরতাপের সময় অনেকের কাছেই তালের রস উপাদেয়।

 

তালে তাল মিলিয়ে চলা, এটা আমাদের দৈনিন্দন জীবনে নিয়ম হয়ে গেছে- অফিসের বড় কর্তা, রাজনৈতিক নেতা, এলাকার বড় ভাই, সুদ, ঘুষ, দূর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সাথে তাল মিলান! এমনকি গ্রামের মাতব্বরের সঙ্গে তাল না মিলালে বিয়ে বাড়ির দাওয়াত ও পাওয়া যায় না। মাতব্বরের সঙ্গে সঠিকভাবে তাল মিলাতে পারলেই মেলে আকাঙ্খিত দাওয়াতের চিঠি। অনেকেই এজন্য বিপদ এড়াতে পথে, ঘাটে, বাড়িতে, অফিসে, সমাজে এমনকি মসজিদ, মন্দিরে পর্যন্ত তাল মিলিয়ে চলেন।

 

গ্রামীণ প্রবাদ আছে, ‘তাল পাতার সেপাই’। এর অর্থ হল অতিশয় দুর্বল বা শক্তিহীন। এটি দিয়ে মূলত এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যিনি দেখতে শক্তিশালী বা সৈনিকের মতো হলেও আসলে খুবই দুর্বল বা ভীতু। আরেকটি প্রবাদ আছে ‘তাল পাকলে কাকের কি’। এটি মূলত এসেছে কোন কিছুর সাথে সম্পর্কহীনতার কারণে। কাক যেমন তালের শক্ত আবরণের জন্য তার কোন উপকারে লাগে না। মূলত কাক তাল খেতে পারে না। অনুরুপভাবে সবাই সব কাজে পারদর্শী নয়। যিনি যে কাজ করেন তাকে সেই কাজেই মানায়।


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আ. লীগ নেতা কৃষ্ণ চন্দ্র এখন এনসিপিতে

error: Content is protected !!

তাল ও তাল পাতার সেপাই

আপডেট টাইম : ০৪:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫
মুরাদ হোসেন, মহম্মদপুর (মাগুরা) প্রতিনিধি :

মুরাদ হোসেনঃ

 

তাল গ্রামীণ একটি ফল। বাংলার গ্রামীণ প্রান্তরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে তালগাছ, যেন প্রাকৃতিক এক সেপাই। তাল গাছ সাধারণত ৩০-৬০ ফুট পর্য়ন্ত লম্বা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তালগাছ ১০০ ফুট পর্য়ন্ত লম্বা হতে পারে। তলগাছ ছায়া দেয়, বাতাসে দোলে আবার ঝড় এলেও দৃঢ় থাকে। তার পাতা যেন ঢাল, সূর্য ও বৃষ্টির আঘাত থেকে রক্ষা করে আশ্রয়প্রার্থীকে।

 

আবার সঙ্গীতের ভাষায় তাল মূলত লয় বা ছন্দের একটি নিয়মিত ভাগ। এটি গান, বাদ্য ও নৃত্যের সময়কে নির্দিষ্ট ছন্দে আবদ্ধ করে। তালের প্রকারভেদ মূলত এর মাত্রার উপর নির্ভর করে। শাস্ত্রীয় সংগীতে তাল ভিন্ন অর্থ বহন করে। সংগীত বিদ্যায় তাল সমপদী ও বিষমপদী প্রধানত এই দুই প্রকার। সংগীতে পারদর্শী ব্যক্তিকে তাল সম্বন্ধে জানতে হয়। সুর, তাল, লয় যদি খাপের খাপ না মেলে তবে সে সংগীত শ্রুতিমধুর হয় না। গানের কথা যাই হোক না কেন সে গান জনপ্রিয়তা হারাতে বসে। এখানে তালের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন গানের ছাত্রকে অবশ্যই তাল সম্পর্কে জানতে হয়।

 

এবার ফিরে আসি তালগাছ সম্বন্ধে, এটি এশিয়া ও আফ্রিকার গ্রীষ্মকালীল গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম বোরাশাস ফ্লাবেলিফার। ইংরেজিতে এই গাছকে উড়ঁন ঢ়ষধস বলা হয়। এরা এরিকাসি পরিবারের বরাসুস গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এর আদি বাস মধ্য আফ্রিকায়। ভারতীয় উপমহাদেশে তালগাছ প্রায় সর্বত্র পাওয়া যায়।
এবার বলি তার গাছ থেকে কি কি উপকার পাওয়া যায়, তাল গাছের প্রায় সব অঙ্গ ব্যবহৃত হয় এবং উপকরণ তৈরি করা যায়। তাল পাতা শুধু ছায়া দেয়না, বাংলার সংস্কুতি ও জীবনে মহুমুখী কাজে ব্যবহুত হয়- ঘর ছাওয়া, হাতপাখা, তালপাতার চাটাই, মাদুর, আঁকার পট, লেখার পুঁথি, কুণ্ডলী, খেলনা। এমনকি হস্তশিপ্লেও তার অবদান। তালের কাণ্ড দিয়েও বাড়ি, নৌকা, হাউস বোট ইত্যাদি তৈরী হয়। এই প্রাকৃতিক সেপাই, তাল ও তার পাতা, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্রামীণ জীবনের নীরব রক্ষক, আমাদের ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

তালের ফল এবং বীজ দুইই বাঙালির খাদ্য, তালের ফলের ঘন নির্যাস থেকে তাল ফুলুরি তৈরী হয়। কাঁচা ও পাকা দুই অবস্থাতেই তালের বীজ খাওয়া হয়। কচি তালের বীজের মধ্যে থাকে জলে ভরা তালশাঁস। আর পাকা তালের বীজ রেখে দিলে বীজ মধ্যস্থ শাঁস তালের আঁটিতে পরিণত হয় এবং বাঙালিদের সেটা সুস্বাদু খাদ্য। পাকা তালের নির্যাস থেকে পিঠা তৈরী হয়, যা সবার প্রিয়। তাল গাছের কাণ্ড থেকে রস সংগ্রহ করে গুড়, পাটালি, মিছরি তৈরি হয়, যা দিয়ে নানা রকম মুখোরচক খাবার বানানো হয়। তালে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ও সি, জিংক, পটাশিয়াম, আয়রন ও ক্যালসিয়ামসহ আরো অনেক খনিজ উপাদান। এর সাথে আরো আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও এ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান।

 

তাল কিলিয়ে পাকানো যায় না। সাধারণ বর্ষা ঋতুতে তাল পাকে। পাকা তাল গাছ থেকে একটি একটি করে মাটিতে পড়ে। তাই ন্যাড়া কখনও তাল তলায় যায় না। কদাচিৎ গেলে মাথায় হাত রাখে। না হলে সংকেত না দিয়েই তাল টাকে পড়তে পারে। তার ফল তখন ভিন্ন মাত্রায় যাওয়া স্বাভাবিক। তাল ফলের নির্যাস থেকে তৈরি হয় পিঠা,পায়েস, বড়া আরও কত কি। শহুরে বা গ্রামীণ যে কারোর কাছেই তাল দিয়ে তৈরি খাবার দারুণ উপভোগ্য। চৈত্রের প্রচণ্ড খরতাপের সময় অনেকের কাছেই তালের রস উপাদেয়।

 

তালে তাল মিলিয়ে চলা, এটা আমাদের দৈনিন্দন জীবনে নিয়ম হয়ে গেছে- অফিসের বড় কর্তা, রাজনৈতিক নেতা, এলাকার বড় ভাই, সুদ, ঘুষ, দূর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সাথে তাল মিলান! এমনকি গ্রামের মাতব্বরের সঙ্গে তাল না মিলালে বিয়ে বাড়ির দাওয়াত ও পাওয়া যায় না। মাতব্বরের সঙ্গে সঠিকভাবে তাল মিলাতে পারলেই মেলে আকাঙ্খিত দাওয়াতের চিঠি। অনেকেই এজন্য বিপদ এড়াতে পথে, ঘাটে, বাড়িতে, অফিসে, সমাজে এমনকি মসজিদ, মন্দিরে পর্যন্ত তাল মিলিয়ে চলেন।

 

গ্রামীণ প্রবাদ আছে, ‘তাল পাতার সেপাই’। এর অর্থ হল অতিশয় দুর্বল বা শক্তিহীন। এটি দিয়ে মূলত এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যিনি দেখতে শক্তিশালী বা সৈনিকের মতো হলেও আসলে খুবই দুর্বল বা ভীতু। আরেকটি প্রবাদ আছে ‘তাল পাকলে কাকের কি’। এটি মূলত এসেছে কোন কিছুর সাথে সম্পর্কহীনতার কারণে। কাক যেমন তালের শক্ত আবরণের জন্য তার কোন উপকারে লাগে না। মূলত কাক তাল খেতে পারে না। অনুরুপভাবে সবাই সব কাজে পারদর্শী নয়। যিনি যে কাজ করেন তাকে সেই কাজেই মানায়।


প্রিন্ট