ঢাকা , শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫, ৮ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আ. লীগ নেতা কৃষ্ণ চন্দ্র এখন এনসিপিতে Logo ইতিহাস ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ গোপালগঞ্জ -ভিপি নুরুল হক নুর Logo শহিদুল ইসলাম বাবুলের মুক্তির দাবিতে সদরপুর বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ Logo মধুখালীতে ইউনিয়ন কর্মী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, আহত ১০ Logo বৃহত্তর রাজশাহীর কৃষি শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান সুমন রাফি Logo মাগুরায় সাবেক এমপি কাজী কামাল ও যুবদল নেতা নয়নের গণ সংবর্ধনা Logo চট্টগ্রামের পটিয়ায় প্রধান শিক্ষকের উপর দুর্বৃত্তদের হামলা Logo আমরা সবাই মিলে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করবোঃ -মহম্মদপুরে কাজী কামাল  Logo কালুখালীতে শিল্প ও বনিক সমিতির আহ্বায়ক কমিটি গঠন Logo ঠাকুরগাঁওয়ে চাষ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপাইন জাতের আখ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

ভিক্ষা ছেড়ে দুধ বিক্রি করে স্বাবলম্বী প্রতিবন্ধী আবুল হোসেন

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের ভাড়ালিয়ারচর গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী যুবক মো. আবুল হোসেন (৩৬)। ৭-৮ বছর ভিক্ষা করে নিজের ও মায়ের জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কিন্তু এখন আর ভিক্ষা নয়। ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিনে দুধ ও রাতে চা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।

 

মা হাসিনা বেগমকে (৫৬) নিয়ে আবুল হোসেনের সংসার। বছর তিনেক আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান বাবা ছত্তার বিশ্বাস। তারা দুই ভাই। বড় ভাই হাসান বিশ্বাস একই বাড়িতে থাকেন। তবে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। মা-ভাইয়ের খোঁজ নেন না। ভিটের মাত্র তিন শতক জায়গা ছাড়া কিছুই নেই। প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে তিন মাস পর পর পান মাত্র ২৬০০ টাকা। এ দিয়ে সংসার চলে না। তাই মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে চলতে হতো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জন্মের এক বছর পর হঠাৎ করে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাত-পাসহ পুরো শরীর শুকিয়ে যায় আবুল হোসেনের। তারপর থেকে পঙ্গুত্ববরণ করেন তিনি। কোনো উপায় না পেয়ে ভ্যানভাড়া করে ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য হন। দীর্ঘ ৮ বছর ভিক্ষা করেন, কিন্তু ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভিক্ষা করে পাননি মানসিক শান্তি। এরপর ৮-৯ মাস আগে মানবতার ফেরীওয়ালা খ্যাত বোয়ালমারীর সুমন রাফির সহোযোগিতায় ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দুধের ব্যবসা শুরু করেন। সুমন রাফি বিভিন্ন সরঞ্জামসহ দশ হাজার টাকা পুঁজি দেন। সেই টাকা দিয়ে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে দুধ সংগ্রহ করে বোয়ালমারী বাজারে মিষ্টির দোকানে বিক্রি করেন। এ কাজে সহযোগিতা করেন ভ্যানচালক রাজন বিশ্বাস। প্রতিদিন ২-৩ মণ দুধ বিক্রির পাশাপাশি এখন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বাড়ির সামনে চা বিক্রি করেন আবুল হোসেন। সবমিলিয়ে এখন গড়ে তার প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার হয়।

 

সরেজমিনে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ছোট্ট একটি বাড়িতে ছোট দুটি কক্ষ। ভ্যান নিয়ে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন আবুল হোসেন। বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠানে দাঁড়ানো ভ্যানটি। অন্যের ওপর ভর করেই চলতে হয় তাকে। সেক্ষেত্রে মা ও ভ্যানচালকের সাহায্য নিয়ে যান জীবিকার সন্ধানে।

 

স্থানীয় দাউদ হোসেন বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে আবুল হোসেন সকালে দুধ বিক্রি করে। দুপুরের পর বাড়ির সামনে চা বিক্রি করে মাকে নিয়ে সংসার চালায়। স্থানীয় বাসিন্দা সাহেদা পারভিন বলেন, আবুল হোসেন আগে ভিক্ষা করতো। এখন দুধ বিক্রি করে। পথে-ঘাটে দেখা হলে আমরাও তার কাছ থেকে দুধ কিনি।

 

আবুল হোসেনকে বহনকারী ভ্যানচালক রাজন বিশ্বাস বলেন, আবুল ভাইয়ের শরীরের যে অবস্থা, কারো সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। আগে আমি বাড়ি থেকে ভ্যানে তুলে নিয়ে উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতাম ভিক্ষা করতে। এতে নিজের কাছেও খারাপ লাগতো। এখন ব্যাবসা করে সংসার চলে।

 

আবুল হোসেন বলেন, ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এটা তার মনকে সায় দিচ্ছিল না। নিজের শারীরিক অবস্থা যাই হোক, ভিক্ষা করতে লজ্জা করতো। বোয়ালমারীর সুমন রাফি ভাইয়ের আর্থিক সহযোগিতায় ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুধের ব্যবসা করি এবং বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চা বিক্রি করি। মানসিকভাবে শান্তিতে আছি। তবে আমার এখন একটি ইলেকট্রিক হুইল চেয়ার হলে চলাফেরায় সুবিধা হতো।

 

আবুল হোসেনের মা হাসিনা বেগম বলেন, জন্মের পর আবুল হোসেন ভালো ছিল। ছোটবেলায় জ্বর হওয়ার পর থেকে তার শরীরের অবস্থা এমন হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ভিক্ষা করছে। গরিবের বন্ধু সুমন রাফির সার্বিক সহযোগিতায় ভিক্ষা ছেড়ে দিয়েছে। এখন দুধের ব্যবসা ও চা বিক্রি করে। আমরা বেশ ভালো আছি।

 

কথা হয় সুমন রাফির সঙ্গে। তিনি বলেন, বাজারে চলতে গিয়ে প্রায়ই আবুল হোসেনের সঙ্গে আমার দেখা হতো। সে অন্যের সহযোগিতার জন্য বসে থাকতো। একদিন আমি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করি এবং তার পরিবারের খোঁজ খবর নেই। জানতে পারি শুধুমাত্র মাকে নিয়ে সংসার তার। আমি তখন তার কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিই। দুধের ব্যবসা করার জন্য পরামর্শ ও পুঁজি দিই। পরে তাকে একটি চায়ের দোকানের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

 

ঘোষপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, তার নামে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারি বেসরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা পেলে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর হাসান চৌধুরী বলেন, ভিক্ষাবৃত্তির পেশা ছেড়ে কর্মসংস্থানের জন্য তাকে ধন্যবাদ। আবুল হোসেন আমাদের সমাজের জন্য একজন অনুকরণীয় মানুষ। তার জন্য সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আ. লীগ নেতা কৃষ্ণ চন্দ্র এখন এনসিপিতে

error: Content is protected !!

ভিক্ষা ছেড়ে দুধ বিক্রি করে স্বাবলম্বী প্রতিবন্ধী আবুল হোসেন

আপডেট টাইম : ০১:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের ভাড়ালিয়ারচর গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী যুবক মো. আবুল হোসেন (৩৬)। ৭-৮ বছর ভিক্ষা করে নিজের ও মায়ের জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কিন্তু এখন আর ভিক্ষা নয়। ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিনে দুধ ও রাতে চা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।

 

মা হাসিনা বেগমকে (৫৬) নিয়ে আবুল হোসেনের সংসার। বছর তিনেক আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান বাবা ছত্তার বিশ্বাস। তারা দুই ভাই। বড় ভাই হাসান বিশ্বাস একই বাড়িতে থাকেন। তবে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। মা-ভাইয়ের খোঁজ নেন না। ভিটের মাত্র তিন শতক জায়গা ছাড়া কিছুই নেই। প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে তিন মাস পর পর পান মাত্র ২৬০০ টাকা। এ দিয়ে সংসার চলে না। তাই মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে চলতে হতো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জন্মের এক বছর পর হঠাৎ করে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাত-পাসহ পুরো শরীর শুকিয়ে যায় আবুল হোসেনের। তারপর থেকে পঙ্গুত্ববরণ করেন তিনি। কোনো উপায় না পেয়ে ভ্যানভাড়া করে ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য হন। দীর্ঘ ৮ বছর ভিক্ষা করেন, কিন্তু ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভিক্ষা করে পাননি মানসিক শান্তি। এরপর ৮-৯ মাস আগে মানবতার ফেরীওয়ালা খ্যাত বোয়ালমারীর সুমন রাফির সহোযোগিতায় ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দুধের ব্যবসা শুরু করেন। সুমন রাফি বিভিন্ন সরঞ্জামসহ দশ হাজার টাকা পুঁজি দেন। সেই টাকা দিয়ে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে দুধ সংগ্রহ করে বোয়ালমারী বাজারে মিষ্টির দোকানে বিক্রি করেন। এ কাজে সহযোগিতা করেন ভ্যানচালক রাজন বিশ্বাস। প্রতিদিন ২-৩ মণ দুধ বিক্রির পাশাপাশি এখন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বাড়ির সামনে চা বিক্রি করেন আবুল হোসেন। সবমিলিয়ে এখন গড়ে তার প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার হয়।

 

সরেজমিনে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ছোট্ট একটি বাড়িতে ছোট দুটি কক্ষ। ভ্যান নিয়ে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন আবুল হোসেন। বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠানে দাঁড়ানো ভ্যানটি। অন্যের ওপর ভর করেই চলতে হয় তাকে। সেক্ষেত্রে মা ও ভ্যানচালকের সাহায্য নিয়ে যান জীবিকার সন্ধানে।

 

স্থানীয় দাউদ হোসেন বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে আবুল হোসেন সকালে দুধ বিক্রি করে। দুপুরের পর বাড়ির সামনে চা বিক্রি করে মাকে নিয়ে সংসার চালায়। স্থানীয় বাসিন্দা সাহেদা পারভিন বলেন, আবুল হোসেন আগে ভিক্ষা করতো। এখন দুধ বিক্রি করে। পথে-ঘাটে দেখা হলে আমরাও তার কাছ থেকে দুধ কিনি।

 

আবুল হোসেনকে বহনকারী ভ্যানচালক রাজন বিশ্বাস বলেন, আবুল ভাইয়ের শরীরের যে অবস্থা, কারো সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। আগে আমি বাড়ি থেকে ভ্যানে তুলে নিয়ে উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতাম ভিক্ষা করতে। এতে নিজের কাছেও খারাপ লাগতো। এখন ব্যাবসা করে সংসার চলে।

 

আবুল হোসেন বলেন, ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এটা তার মনকে সায় দিচ্ছিল না। নিজের শারীরিক অবস্থা যাই হোক, ভিক্ষা করতে লজ্জা করতো। বোয়ালমারীর সুমন রাফি ভাইয়ের আর্থিক সহযোগিতায় ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুধের ব্যবসা করি এবং বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চা বিক্রি করি। মানসিকভাবে শান্তিতে আছি। তবে আমার এখন একটি ইলেকট্রিক হুইল চেয়ার হলে চলাফেরায় সুবিধা হতো।

 

আবুল হোসেনের মা হাসিনা বেগম বলেন, জন্মের পর আবুল হোসেন ভালো ছিল। ছোটবেলায় জ্বর হওয়ার পর থেকে তার শরীরের অবস্থা এমন হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ভিক্ষা করছে। গরিবের বন্ধু সুমন রাফির সার্বিক সহযোগিতায় ভিক্ষা ছেড়ে দিয়েছে। এখন দুধের ব্যবসা ও চা বিক্রি করে। আমরা বেশ ভালো আছি।

 

কথা হয় সুমন রাফির সঙ্গে। তিনি বলেন, বাজারে চলতে গিয়ে প্রায়ই আবুল হোসেনের সঙ্গে আমার দেখা হতো। সে অন্যের সহযোগিতার জন্য বসে থাকতো। একদিন আমি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করি এবং তার পরিবারের খোঁজ খবর নেই। জানতে পারি শুধুমাত্র মাকে নিয়ে সংসার তার। আমি তখন তার কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিই। দুধের ব্যবসা করার জন্য পরামর্শ ও পুঁজি দিই। পরে তাকে একটি চায়ের দোকানের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

 

ঘোষপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, তার নামে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারি বেসরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা পেলে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর হাসান চৌধুরী বলেন, ভিক্ষাবৃত্তির পেশা ছেড়ে কর্মসংস্থানের জন্য তাকে ধন্যবাদ। আবুল হোসেন আমাদের সমাজের জন্য একজন অনুকরণীয় মানুষ। তার জন্য সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।


প্রিন্ট