বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আপত্তি ও দাবির মুখে অবশেষে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এর কিছু ধারা বাতিল হচ্ছে। আর এ আইনটি পরিবর্তন করে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ নামে নতুন আইন করা হচ্ছে। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।
পরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। শুধু শাস্তি হবে জরিমানা, সেই জরিমানা অনাদায়ে তিন থেকে ছয় মাসের কারাদণ্ড থাকবে। সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে।’
আইনমন্ত্রী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে বাতিল না বলে পরিবর্তন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, ‘আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে, সেই অধিবেশনে বিলটি পেশ হবে।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থাকা বর্তমান মামলাগুলোর কী হবে; এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘চলমান মামলাগুলো স্বাভাবিকভাবে সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে যাবে।’
গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠক উপলক্ষে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনেও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ নামে নতুন আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদনের তথ্য জানান। এই খসড়াটি উপস্থাপন করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।
মাহবুব হোসেন বলেন, ‘২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে আমাদের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এর মধ্যে আইসিটি-সংক্রান্ত অপরাধের ব্যাপ্তিও পরিবর্তন হয়েছে। সেগুলোকে রেখেই সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩-এর খসড়া করা হয়েছে। এ আইনটি বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি থাকবে, যা আইনের আলোকে বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।’ এদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) পরিবর্তে প্রস্তাবিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ যেন কোনোভাবেই স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা সাধুবাদ জানিয়ে বলছে, নতুন আইন যেন ভিন্নমত দমনের হাতিয়ারে পরিণত না হয়। তা যেন শুধু সাইবার অবকাঠামোর নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
গতকাল টিআইবির এক বিবৃতিতে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনটি যেন নতুন মোড়কে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের রূপান্তর হয়ে ফিরে না আসে। অন্যথায় আইনটির নাম বদল হলেও কার্যত তা হবে একটি কালাকানুনকে প্রতিস্থাপন করে ভিন্ন নাম ধারণ করা আরেকটি কালাকানুন মাত্র। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারা মূলত ভিন্নমত দমন, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে বহুল অপব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে অন্তর্ভুক্ত না করার আহ্বান জানান।
তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চেয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন আরও ভয়াবহ ও বিপজ্জনক বলে মনে করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশি-বিদেশি চাপে তারা আইওয়াশ হিসেবে এটি করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চেয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন আরও ভয়াবহ ও বিপজ্জনক হবে।’
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত নতুন আইনে সাজা যেমন কমানো হয়েছে, তেমনি অনেকগুলো অজামিনযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, মানহানি মামলার ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের বিধান বাদ দিয়ে শুধু অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আবারও বলছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করা হয়েছে, বাতিল করা হয়নি। নামটা নতুন করে দেওয়া হয়েছে। ধারাগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে। আমরা মনে করেছি, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকবে না এবং এটা সঠিক।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারা ছিল সেসব ধারা প্রস্তাবিত আইনে অক্ষুন্ন থাকবে। তবে, কিছু ধারায় পরিবর্তন আসবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানির অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধানের কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে মানহানির অপরাধে কারাদণ্ডের বিষয়টি বাদ দিয়ে অনধিক ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তিন মাস থেকে ছয় মাস কারাদণ্ডের বিধান রাখা হবে। এ ধারায় অর্থদণ্ড ২০ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে বেশ কিছু ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে বলে জানান আইনমন্ত্রী। একই সঙ্গে কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তিও কমানো হবে বলে জানান তিনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২১ ধারা মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে এ সাজা কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। এ ছাড়া অনেক আইনে দ্বিতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে সাজা দ্বিগুণ থাকলেও সাইবার নিরাপত্তা আইনে তা বাতিল করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় ইলেকট্রিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ধারায় অপরাধ বিদ্যমান আইনে অজামিনযোগ্য। প্রস্তাবিত আইনে এ ধারার অপরাধকে জামিনযোগ্য করা হবে। আর এ ধরনের অপরাধে সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছর। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায় ডিজিটাল বিন্যাসে বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা বা ঘৃণা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটালে অনধিক সাত বছর ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে এ ধারায় সাজা কমিয়ে পাঁচ বছর করা হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গেও অপরাধে অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে এ ধারায় সাজা কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনও বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কাঠামোতে অজামিনযোগ্য যেসব ধারা ছিল নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সেগুলোর বেশিরভাগই জামিনযোগ্য করা হয়েছে। আর সাজার ক্ষেত্রে চলমান আইনে জেলের ওপর বেশি ফোকাস ছিল। কিন্তু নতুন আইনে সেটা কমিয়ে আর্থিক জরিমানা বাড়ানো হয়েছে।’
দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তি ও উদ্বেগের মধ্যে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনের অধীনে পুলিশ কাউকে বিনা ওয়ারেন্টে আটক করতে পারে। বিভিন্ন মহল থেকে এই আইন বাতিল বা সংশোধনের দাবি দীর্ঘদিন থেকে করা হচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালে কারাগারে মারা যাওয়ার পর ওই আইন বাতিলের দাবিতে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছিল। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদকরা মানববন্ধন করেছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে।
এরপর আইনের ‘অপব্যবহার’ বন্ধে আইনমন্ত্রীর আশ্বাসের মধ্যেও সংবাদকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার থেমে থাকেনি।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকারকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের আহ্বান জানান। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি উদ্বিগ্ন যে, বাংলাদেশে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি, ভয় দেখানোর জন্য এবং অনলাইনে সমালোচকদের কণ্ঠস্বরকে দমিয়ে রাখতে ব্যবহার করা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।’
এরপর মে মাসে বিশ্বমুক্ত গণমাধ্যম দিবসের অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে না, তবে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তেমন কিছু সংশোধন আনা হবে।
এ ছাড়া গতকালের মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ আইনের খসড়া, বাংলাদেশ অ্যালাইড হেল্ড শিক্ষা বোর্ড আইনের খসড়া এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অধিবাসী আইনের খসড়ারও নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।
প্রিন্ট