বাঙালির মননে দীপ্তমান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও নওগাঁর পতিসরে কেটেছে তার জীবনের বড় একটি অংশ। এসব জায়গায় কুঠিবাড়িতে বসে লিখেছেন অনেক কবিতা, গান, প্রবন্ধ। তার লেখনির মাধ্যমে ফুটে ওঠে এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। শিলাইদহে অবস্থানের সময় পদ্মায় নৌকা ঘুরে বেড়িয়েছেন বরেণ্য এই কবি।
এ সময় পদ্মার বুকে পালতোলা নৌকা, বকুল তলার শান বাঁধানো ঘাট, একটু দূরে গড়াই নদীর সৌন্দর্য ছাড়াও গ্রামবাংলার সবুজের সমারোহে ভরা শিলাইদহ তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। কবির যখন ভরা যৌবন এবং কাব্য সৃষ্টির প্রকৃষ্ট সময়, তখনই তিনি বিচরণ করেছেন শিলাইদহে।
জমিদারি ও ব্যবসার কাজে তিনি কখনো স্বল্প সময়, কখনো দীর্ঘ সময় অবস্থান করেছেন। কখনো একাকী, কখনো স্ত্রী, পুত্র-কন্যা নিয়ে এসেছেন শিলাইদহে, পেতেছেন ক্ষণিকের সংসার। ঘুরে বেড়িয়েছেন বোটে, পালকিতে।
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে ছিলেন ১৯২২ সাল পর্যন্ত। সুদীর্ঘ ২৫ বছর এখানে অবস্থানকালে তিনি সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। সেই স্মৃতি বুকে ধারণ করে আজও শিলাইদহের বুকে দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্র স্মৃতিমাখা ঐতিহাসিক ‘কুঠিবাড়ি’।
বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী আজ ২৫ বৈশাখ। দিনটি উদযাপন উপলক্ষে শিলাইদহে আজ থেকে শুরু হচ্ছে দুদিনের উৎসব। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে এবং কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এ উৎসবকে ঘিরে কুঠিবাড়ি চত্বর পরিণত হচ্ছে রবীন্দ্রপ্রেমী ও ভক্তদের মিলন মেলায়।
প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ এলেই শিলাইদহ ‘কুঠিবাড়ি’ চত্বরে জমে ওঠে উৎসব। বসে গ্রামীণ মেলা, নামে রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষের ঢল। আগমন ঘটে দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য কবি, সাহিত্যিক ও গুণীজনসহ হাজার হাজার দর্শনার্থীর। এবারের আয়োজনেও কমতি নেই। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে কুঠিবাড়ি।
নিভৃত পল্লী শিলাইদহে কেটেছে কবিগুরুর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সময়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৈতৃক ভিটে কলকাতার ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি’। এটি জমিদার বাড়িও বটে। উত্তর কলকাতার চিৎপুর রোড ও বিবেকানন্দ রোডের সংযোগস্থল দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনে অবস্থিত অট্টালিকার আঁতুরঘরেই ২৫ বৈশাখ (১২৬৮ সন) জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আবার এ বাড়িতেই ২২ শ্রাবণ (১৩৪৮ সন) তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে।
জমিদার নীলমণিরাম ঠাকুরের রেখে যাওয়া জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারটিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা আর অতুলনীয় বিত্তবৈভবে প্রতিষ্ঠিত করেন রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)। তাঁর জীবনযাপন ছিল রাজসিক ও জাঁকজমকপূর্ণ। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হওয়ায় ঠাকুরবাড়ির গৌরব ও মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়। এ বাড়ি থেকেই তৎকালীন নদীয়া জেলার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জেরর শাহজাদপুর, রাজশাহীর কালীগ্রাম পরগণা এবং উড়িষ্যার পান্ডুয়া প্রভৃতি জায়গায় জমিদারি কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নির’ মাধ্যমে পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে সমগ্র জমিদারি সম্পত্তির সর্বময় কর্তৃত্ব পান ১৮৯৫ সালের ৮ আগস্ট। তিনি জমিদার হয়েই তৎকালীন নদীয়া জেলার (বর্তমান কুষ্টিয়া) শিলাইদহে আসেন ১৮৯৭ সাল নাগাদ। এখানে তিনি প্রথমেই পল্লী উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দেন। রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহ পর্যন্ত ছয় মাইল রাস্তা তৈরি করিয়ে দেন। পানিও জলের জন্য কুয়ো খোঁড়ার দায়িত্ব দেন গ্রামবাসীর ওপর।
‘শিলাইদহ’ গ্রামে রয়েছে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত ‘কুঠিবাড়ি’। কবি এখানে বসেই নোবেলজয়ী গীতাঞ্জলির অধিকাংশ রচনা করেন। তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন গ্রাম-বাংলার প্রকৃত রূপ। রবীন্দ্রনাথ এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ছিলেন আত্মার আত্মীয়। তিনি ছিলেন বাঙালি চেতনার প্রাণশক্তির জাগরণ। সাহিত্যের রস অন্বেষণে রবীন্দ্রনাথ বারবার ছুটে এসেছেন এই শিলাইদহে। তিনি যে লেখার জন্য নোবেল পুরস্কারে বিশ্বখ্যাত হয়েছিলেন; সেই গীতাঞ্জলির কাব্যরস যে শিলাইদহ থেকেই পেয়েছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কবির জীবনে শিলাইদহে অবস্থান ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা।
১৯১২ সালে ইংরেজি গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলির জন্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত শাহজাদপুর কাছারি বাড়ি। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে কাছারি বাড়িতে বিশ্বকবির শৈশব ও যৌবনের নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাঁর চিত্তে ও কর্মবোধের সর্বোচ্চ সমন্বয় ঘটেছিল শাহজাদপুরে এসেই, যা তিনি স্বীকার করেছেন লেখনীর মাধ্যমেই। কবিগুরু পিতার নির্দেশে জমিদারির কাজে শাহজাদপুরে বিভিন্ন সময় এসেছেন।
এখানে অবস্থানকালে তিনি শুধু জমিদারি দেখাশোনার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, প্রয়োজনকে ছাপিয়ে তার মনের মধ্যে জায়গা করে নেয় সাহিত্য সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। কুঠিবাড়িতে বসেই তিনি কালজয়ী সাহিত্য রচনা করেছেন। যেগুলো ‘সোনার তরী’ কাব্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ সময় তিনি কিছু ছোটগল্পও রচনা করেন। সেগুলোর মধ্যে ‘দুই পাখি’, ‘ব্যর্থ যৌবন’, ‘কুমার সম্ভবের গান’, ‘ইছামতি নদী’, ‘ পোস্ট মাস্টার’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘ছুটি’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘অতিথি’ বিশেষভাবে উলেখযোগ্য।
এর বাইরেও কবি এ সময় ছিন্নপত্র এবং ছিন্নপত্রাবলির আটত্রিশটি পত্র রচনা করেন। পাশাপাশি গানও তিনি রচনা করেছেন শাহজাদপুর কাচারিবাড়িতে বসে।
ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ভাগাভাগি হলে শাহজাদপুরের জমিদারি চলে যায় কবির অন্য শরিকদের হাতে। ফলে ১৮৯৭ সালের পর তিনি আর শাহজাদপুর আসেননি। শাহজাদপুর ছিল কবিগুরুর অত্যন্ত প্রিয় এবং ভালো লাগার স্থান।
বিভিন্ন লেখায় বিশেষ করে ছিন্নপত্রাবলিতে তিনি সে কথা গভীর আবেগে স্মরণ করেছেন। ১৮৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শাহজাদপুর থেকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছেন: এখানে (শাহজাদপুর) যেমন আমার মনে লেখার ভাব ও ইচ্ছা আসে, এমন কোথাও না। (ছিন্নপত্র-পত্র সংখ্যা ১২৯)। শাহজাদপুরের উন্মুক্ত উদার দ্বারে এসে নিখিল বিশ্বের সামনে কবিপ্রাণের গভীর বন্ধন সূচিত হয়।
১৯৬৯ সালে প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক বাহক রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নেওয়া হয়। তারও কিছুদিন পর ১৯৭২ সালে কাছারি বাড়িকে ‘জাদুঘর’ ঘোষণা করে সরকার। জাদুঘরের দোতলা ভবনের নিচ তলায় পর পর তিনটি কক্ষের দেয়ালে সুন্দর ও সুসজ্জিতভাবে রয়েছে কবির আকা কিছু মূল্যবান ছবি ও দুর্লভ আলোকচিত্র। জলরঙে আকা নারী প্রতিকৃতি এবং কয়েকটি নৈসর্গিক চিত্রকর্ম। এছাড়া কবির তিনটি পান্ডুলিপি এবং চারটি আলোকচিত্র এ দুটি কক্ষকে আরও আকর্ষণীয় করেছে। কবির ইতালিতে, বিলেতে এবং তার জন্মদিনে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে বিশেষ মুহূর্তের ছবিগুলো এখনো প্রাণবন্ত।
প্রিন্ট