ঢাকা , সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

ততক্ষণই ভালো লাগায় মনটা ভরে যাবে

কবিগুরুর স্মৃতিধন্য দর্শনীয় টেগোর লজ ভবনে যতক্ষণ থাকবেন

কুষ্টিয়া জেলার সরকারি তথ্য বাতায়নে টেগোর লজ সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্য পাওয়া যায়। ১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। তিনি ও তাঁর দুই ভাগনে সুরেন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথের সহায়তায় শিলাইদহে টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি গড়ে তোলেন যৌথ মূলধনি ব্যবসা।

সে বছরই ব্যবসায়িক সুবিধার্থে টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত করেন। কোম্পানি দেখাশোনার জন্য কবি শহরের মিলপাড়ায় একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করেন। এখানে বসে কবি অসংখ্য কবিতা লেখেন, যা পরবর্তীকালে ‘ক্ষণিকা’, কথা ও কাহিনিতে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে এ ভবনটিও একটি দর্শনীয় স্থান।

কবিগুরুর মতো একজন মহান মানুষের স্মৃতিধন্য এই ভবন একেবারেই স্বল্প পরিচিত। কুষ্টিয়ায় কবিগুরুর স্মৃতি বলতে সবাই শিলাইদহ কুঠিবাড়ির উল্লেখ করেন। বিভিন্ন উপলক্ষে বনভোজন বা বেড়াতে সেখানে যান। সে তুলনায় টেগোর লজকে তেমন কেউ চেনে না। কুষ্টিয়ায় জন্ম নেওয়া এবং বেড়ে ওঠার কারণে নিজেকে সব সময়ই অনেক সৌভাগ্যবান মনে হয়। কতবার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। কিন্তু বাড়ির কাছের টেগোর লজে এক দিনও যাওয়া হয়নি।

অবশেষে সেই সুযোগটা এসে গেল এ বছরের মার্চ মাসে। জানুয়ারিতে আমাদের সঙ্গে বেড়াতে আসা শ্বশুর–শাশুড়িকে দেশে রেখে আসতে গিয়ে দুটো দিন হাতে পেয়ে গেলাম। সেই সুযোগে কুষ্টিয়া চলে গেলাম। ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার বাসগুলো কল্যাণপুর থেকে ছাড়ে। আপনি অনলাইনেই টিকিট করে নিতে পারেন। কুষ্টিয়ায় বাসগুলো যায় দুভাবে, পাটুরিয়া ফেরিঘাট দিয়ে আর যমুনা সেতু দিয়ে। আমি যে বাসগুলো ফেরি হয়ে যায়, সেটার টিকিট করে নিলাম। চার, সাড়ে চার ঘণ্টায় আপনি কুষ্টিয়া মজমপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যাবেন।

কুষ্টিয়া শহরে বেশ ভালো মানের কিছু থাকার হোটেল আছে। আর কুষ্টিয়ার যেকোনো রেস্তোরা থেকে আপনি দিনের যেকোনো সময়ের খাবার নিশ্চিন্তে খেয়ে নিতে পারেন। কুষ্টিয়া শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে রিকশা করে টেগোর লজে আসতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক মিনিট। মূল রাস্তার পাশে সাদা দেয়ালঘেরা লাল রঙের দোতলা ভবন টেগোর লজ। রিকশা থেকে নেমে আপনি শুরুতেই দেয়ালের লেখাগুলো পড়ে নিতে পারেন। এরপর সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই হাতের বাম পাশে কবিগুরুর আবক্ষ ভাস্কর্য আপনাকে স্বাগত জানাবে।

ওখান থেকেই আপনি ভবনের নিচতলার প্রবেশ দরজা দেখতে পারবেন। তার ওপরে ঝোলানো আছে কবিগুরুর একটি তেলচিত্র। এরপর ভেতরে প্রবেশ করলে আপনার মনে হবে আপনি যেন সময়ের ঘড়িতে চলে গেছেন ১০০ বছর পেছনে। ভবনের ঘরের মেঝে, ছাদ, দেয়াল, দরজা, জানালা, ঘুলঘুলি, বারান্দার রেলিং সবকিছুই আগের মতোই অক্ষত আছে। এগুলো আপনি হাত দিয়ে স্পর্শ করলে শরীরে একধরনের কম্পন অনুভব করবেন।

কারণ, এক সময় এই জায়গায় ঠিক আপনার মতোই কবিগুরু চলাফেরা করতেন। দেয়ালগুলোতে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থিরচিত্র আছে। পাশাপাশি আছে কবিগুরুর নিজস্ব হস্তাক্ষরের অনেক প্রতিলিপি।

এরপর পশ্চিম দিকের কামরার মধ্য দিয়ে লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। এই ধরনের সিঁড়ি এখন আর দেখা যায় না। আগেকার আমলে ডুপ্লেক্স বাড়ি মানেই এমন একটা সিঁড়ি থাকত। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলে সামনেই একটা বড় কক্ষ পড়বে। সেখানেও কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থিরচিত্র এবং লেখার প্রতিলিপি সংরক্ষণ করা আছে। আপনাকে সময় নিয়ে ছবি এবং লেখাগুলো দেখতে হবে। এখানে বিভিন্ন সংগঠন তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে থাকে। আশপাশের কক্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তখনকার সময়ের বেশ কিছু আসবাব। একটা কামরায় আমি পুরোনো আমলের একটা টেবিল দেখতে পেলাম।

এই কক্ষগুলোর পরেই আছে টানা বারান্দা। বারান্দার সুদৃশ্য মোটা মোটা থামের ফাঁকে আছে লোহার রডের রেলিং। সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই এক হালকা বাতাস এসে গায়ে লাগল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম কবিগুরুও নিশ্চয়ই গরমের দিনে এখানে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেন। ওখান থেকে নিচে চোখ পড়তেই নজরে এল ভবনের ছোট আয়তাকার পেছনের খোলা জায়গাটা।

তার দুই কোনায় দুটো ঝাঁকড়া বকুলগাছ লাগানো। নিশ্চয় কবিগুরু বর্ষায় বকুলের সুবাস নিতেন। আর ঠিক মাঝবরাবর বসার জন্য আছে এম্পিথিয়েটারের আদলের কংক্রিটের উঁচু বেদি। এরপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। আমার আগ্রহ দেখে তদারককারীদের একজন আলো জ্বেলে দিলেন।

এভাবে প্রায় কয়েক ঘণ্টা সময় ওখানে পার করলাম। যতক্ষণ ছিলাম, ততক্ষণই একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ভরে ছিল। আর খারাপ লাগছিল এভাবে যে এত কাছে কবিগুরু স্মৃতিধন্য এমন একটা সুন্দর স্থাপনা কেন এত দিনেও দেখতে আসিনি। আমি আরও বহুবার এই ভবনে যেতে চাই, স্পর্শ করতে চাই এই ভবনের সবকিছুই। টেগোর লজ নিয়ে প্রচার–প্রচারণা বলতে তেমন কিছুই দেখিনি।

 

কুষ্টিয়া জেলার তথ্য বাতায়ন ছাড়া আর তেমন কোনো প্রচার খুঁজে পাইনি। যাহোক, আমার মনে হয় কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে এই ভবনটার প্রচারের পাশাপাশি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবে। জিনিসপত্রগুলো একটু গুছিয়ে নিয়মিত ঝাড়পোছ করে পরিষ্কার রাখলে মনে হয় দর্শনার্থীর অভাব হবে না।

Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

error: Content is protected !!

ততক্ষণই ভালো লাগায় মনটা ভরে যাবে

কবিগুরুর স্মৃতিধন্য দর্শনীয় টেগোর লজ ভবনে যতক্ষণ থাকবেন

আপডেট টাইম : ০৭:৫৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪

কুষ্টিয়া জেলার সরকারি তথ্য বাতায়নে টেগোর লজ সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্য পাওয়া যায়। ১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। তিনি ও তাঁর দুই ভাগনে সুরেন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথের সহায়তায় শিলাইদহে টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি গড়ে তোলেন যৌথ মূলধনি ব্যবসা।

সে বছরই ব্যবসায়িক সুবিধার্থে টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত করেন। কোম্পানি দেখাশোনার জন্য কবি শহরের মিলপাড়ায় একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করেন। এখানে বসে কবি অসংখ্য কবিতা লেখেন, যা পরবর্তীকালে ‘ক্ষণিকা’, কথা ও কাহিনিতে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে এ ভবনটিও একটি দর্শনীয় স্থান।

কবিগুরুর মতো একজন মহান মানুষের স্মৃতিধন্য এই ভবন একেবারেই স্বল্প পরিচিত। কুষ্টিয়ায় কবিগুরুর স্মৃতি বলতে সবাই শিলাইদহ কুঠিবাড়ির উল্লেখ করেন। বিভিন্ন উপলক্ষে বনভোজন বা বেড়াতে সেখানে যান। সে তুলনায় টেগোর লজকে তেমন কেউ চেনে না। কুষ্টিয়ায় জন্ম নেওয়া এবং বেড়ে ওঠার কারণে নিজেকে সব সময়ই অনেক সৌভাগ্যবান মনে হয়। কতবার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। কিন্তু বাড়ির কাছের টেগোর লজে এক দিনও যাওয়া হয়নি।

অবশেষে সেই সুযোগটা এসে গেল এ বছরের মার্চ মাসে। জানুয়ারিতে আমাদের সঙ্গে বেড়াতে আসা শ্বশুর–শাশুড়িকে দেশে রেখে আসতে গিয়ে দুটো দিন হাতে পেয়ে গেলাম। সেই সুযোগে কুষ্টিয়া চলে গেলাম। ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার বাসগুলো কল্যাণপুর থেকে ছাড়ে। আপনি অনলাইনেই টিকিট করে নিতে পারেন। কুষ্টিয়ায় বাসগুলো যায় দুভাবে, পাটুরিয়া ফেরিঘাট দিয়ে আর যমুনা সেতু দিয়ে। আমি যে বাসগুলো ফেরি হয়ে যায়, সেটার টিকিট করে নিলাম। চার, সাড়ে চার ঘণ্টায় আপনি কুষ্টিয়া মজমপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যাবেন।

কুষ্টিয়া শহরে বেশ ভালো মানের কিছু থাকার হোটেল আছে। আর কুষ্টিয়ার যেকোনো রেস্তোরা থেকে আপনি দিনের যেকোনো সময়ের খাবার নিশ্চিন্তে খেয়ে নিতে পারেন। কুষ্টিয়া শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে রিকশা করে টেগোর লজে আসতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক মিনিট। মূল রাস্তার পাশে সাদা দেয়ালঘেরা লাল রঙের দোতলা ভবন টেগোর লজ। রিকশা থেকে নেমে আপনি শুরুতেই দেয়ালের লেখাগুলো পড়ে নিতে পারেন। এরপর সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই হাতের বাম পাশে কবিগুরুর আবক্ষ ভাস্কর্য আপনাকে স্বাগত জানাবে।

ওখান থেকেই আপনি ভবনের নিচতলার প্রবেশ দরজা দেখতে পারবেন। তার ওপরে ঝোলানো আছে কবিগুরুর একটি তেলচিত্র। এরপর ভেতরে প্রবেশ করলে আপনার মনে হবে আপনি যেন সময়ের ঘড়িতে চলে গেছেন ১০০ বছর পেছনে। ভবনের ঘরের মেঝে, ছাদ, দেয়াল, দরজা, জানালা, ঘুলঘুলি, বারান্দার রেলিং সবকিছুই আগের মতোই অক্ষত আছে। এগুলো আপনি হাত দিয়ে স্পর্শ করলে শরীরে একধরনের কম্পন অনুভব করবেন।

কারণ, এক সময় এই জায়গায় ঠিক আপনার মতোই কবিগুরু চলাফেরা করতেন। দেয়ালগুলোতে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থিরচিত্র আছে। পাশাপাশি আছে কবিগুরুর নিজস্ব হস্তাক্ষরের অনেক প্রতিলিপি।

এরপর পশ্চিম দিকের কামরার মধ্য দিয়ে লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। এই ধরনের সিঁড়ি এখন আর দেখা যায় না। আগেকার আমলে ডুপ্লেক্স বাড়ি মানেই এমন একটা সিঁড়ি থাকত। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলে সামনেই একটা বড় কক্ষ পড়বে। সেখানেও কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থিরচিত্র এবং লেখার প্রতিলিপি সংরক্ষণ করা আছে। আপনাকে সময় নিয়ে ছবি এবং লেখাগুলো দেখতে হবে। এখানে বিভিন্ন সংগঠন তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে থাকে। আশপাশের কক্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তখনকার সময়ের বেশ কিছু আসবাব। একটা কামরায় আমি পুরোনো আমলের একটা টেবিল দেখতে পেলাম।

এই কক্ষগুলোর পরেই আছে টানা বারান্দা। বারান্দার সুদৃশ্য মোটা মোটা থামের ফাঁকে আছে লোহার রডের রেলিং। সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই এক হালকা বাতাস এসে গায়ে লাগল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম কবিগুরুও নিশ্চয়ই গরমের দিনে এখানে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেন। ওখান থেকে নিচে চোখ পড়তেই নজরে এল ভবনের ছোট আয়তাকার পেছনের খোলা জায়গাটা।

তার দুই কোনায় দুটো ঝাঁকড়া বকুলগাছ লাগানো। নিশ্চয় কবিগুরু বর্ষায় বকুলের সুবাস নিতেন। আর ঠিক মাঝবরাবর বসার জন্য আছে এম্পিথিয়েটারের আদলের কংক্রিটের উঁচু বেদি। এরপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। আমার আগ্রহ দেখে তদারককারীদের একজন আলো জ্বেলে দিলেন।

এভাবে প্রায় কয়েক ঘণ্টা সময় ওখানে পার করলাম। যতক্ষণ ছিলাম, ততক্ষণই একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ভরে ছিল। আর খারাপ লাগছিল এভাবে যে এত কাছে কবিগুরু স্মৃতিধন্য এমন একটা সুন্দর স্থাপনা কেন এত দিনেও দেখতে আসিনি। আমি আরও বহুবার এই ভবনে যেতে চাই, স্পর্শ করতে চাই এই ভবনের সবকিছুই। টেগোর লজ নিয়ে প্রচার–প্রচারণা বলতে তেমন কিছুই দেখিনি।

 

কুষ্টিয়া জেলার তথ্য বাতায়ন ছাড়া আর তেমন কোনো প্রচার খুঁজে পাইনি। যাহোক, আমার মনে হয় কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে এই ভবনটার প্রচারের পাশাপাশি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবে। জিনিসপত্রগুলো একটু গুছিয়ে নিয়মিত ঝাড়পোছ করে পরিষ্কার রাখলে মনে হয় দর্শনার্থীর অভাব হবে না।