দীপঙ্কর পোদ্দার
জীবনে প্রথমবার ভারত যেতে ভিসার জন্য আবেদন করি অনেকটা কৌতূহলবশত। পাঁচ আগস্টের পর বাংলাদেশের এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশীদের জন্য যখন ভিসা ছাড়ের ক্ষেত্রে অনেক কড়াকড়ি, তখন ভিসাপ্রাপ্তি সৌভাগ্যেরই বিষয় বটে। যদিও ভারতীয় হাইকমিশন থেকে দীর্ঘক্ষণ ধরে নেওয়া বিভিন্ন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব প্রাপ্তির পর ছয় মাসের ভিসা মেলে। এ অবস্থায় ১২ সেপ্টেম্বর ভিসা পেয়ে সুযোগ হাতছাড়া না করে ভিসা প্রাপ্তির এক মাসের মধ্যেই চলতি বছরের ৯ অক্টোবর সড়কপথে একাকি ভারত প্রবেশ করি।
ভারতের পেট্রাপোল প্রবেশের পর দেখি সম্পূর্ণ নতুন এক দেশ। নতুন অভিজ্ঞতা। খুঁজতে থাকি দুই দেশের সাদৃশ্য আর বৈসাদৃশ্য। ভালো লাগা আর মন্দ লাগা। কারণ আগে কখনো নিজ দেশের বাইরে যাওয়া হয়নি। বলে রাখা ভালো নিজ দেশ থেকে বহির্গমণ না হওয়ায় এর আগের পাসপোর্টটা কোন কাজেই লাগেনি।
যাহোক অনেকেই পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে বিভিন্ন কারণে যায়- এ কৌতূহল থেকেই মূলত ভারত যাওয়ার জন্য আবেদন করি। আবেদনটা করি টুরিস্ট ভিসায়। তাই টুরিস্ট ভিসা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া থেকে ইমিগ্রেশনের মাধ্যমে ভারতে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আমাকে নিশ্চিত করতে হয়েছে আমি যেন ভারতে পেশাগত কাজে না যাই। অর্থাৎ আমার ভিসাটা হয়েছিল জার্নালিজম (সাংবাদিকতা) ক্যাটাগরিতে। তাই ওদেশে আমি যেন শুধুই পর্যটক হিসেবে ঘোরাঘুরির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখি। কোনরূপ সাংবাদিকতায় না জড়াই। ঘোরাঘুরির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেও ভারত বা আমার প্রথম ভারত ভ্রমণ নিয়ে কিছু না লেখার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।
৯ অক্টোবর ছিল দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর দিন। ভারত ভ্রমণের জন্য পূজার সময়টা বেছে নেওয়ার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ অবশ্য ছিল। পূজা ওদেশে খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়। কলকাতার ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে অবস্থিত একটি আবাসিক হোটেলে ছিলাম। তার আশেপাশেসহ কলকাতা নিউমার্কেট এলাকার মোড়ে মোড়ে আড়ম্বরের সাথে দুর্গাপূজা পালিত হতে দেখে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হিসেবে বেশ ভালো লাগলো। আসলে কলকাতার বিভিন্ন এলাকার মোড়ে মোড়ে বললে ভুল হবে, কয়েকটি দোকানের অব্যবহিত পরেই জাঁকজমকপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা পালিত হয়। পূজা মণ্ডপগুলোর আশেপাশে বেশ কিছু ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি জানান দিলো জাতিগত বৈচিত্রের দেশ ভারতে উৎসব সবার। একদিনেই অর্ধশতাধিক পূজামন্ডপ দর্শন করলাম। যা আমার নিকট সত্যিই এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ যেন এলাম এক নতুন দেশে। চারদিকে পূজা পূজা গন্ধ। যার স্বাদ অতীতে কখনো পাইনি। যে অনুভূতি ভাষায় অব্যক্ত।
যাহোক, পরদিন খানিকটা অসুস্থতা বোধ করায় অ্যাপোলো হাসপাতালে যাই ডাক্তার দেখানোর জন্য। কিন্তু পূজার মধ্যে ইমার্জেন্সি বিভাগ ছাড়া সব চিকিৎসক ছুটিতে থাকায় অ্যাপোলোতে ডাক্তার দেখাতে ব্যর্থ হলাম। পরে খোঁজ পাই অ্যাপোলো হাসপাতালের এক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের, যিনি কলকাতার হেমচন্দ্র নস্কর রোডস্থ ‘নিদান পলিক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার’-এ প্রতিদিন বেলা ১২টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। নাম এস কে দাস। পুরো নাম শরৎ কুমার দাস। ফোনে যোগাযোগের পর তাকে দেখাতে সমর্থ হই। কিন্তু বাদ সাধে আমার বাংলাদেশের চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন)। বাংলাদেশের এক ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞকে নিয়মিত দেখাতাম। তিনি আমাকে যে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিলেন তার ইমেজ আমার মোবাইলের ফটো গ্যালারিতে ছিল। ডা. শরৎ কুমার দাসকে আমি ওই ব্যবস্থাপত্রের ইমেজটি চিকিৎসা গ্রহণের সুবিধার্থে দেখিয়েছিলাম। যদিও পরে বুঝেছিলাম চিকিৎসকের নিকট আমার বাংলাদেশের চিকিৎসকের দেয়া ওই ব্যবস্থাপত্রের ইমেজ প্রদর্শন বোকামি হয়েছিলো।
আমি দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছি শুনে কোন প্রকার টেস্ট ছাড়াই এমনকি ইসিজি ছাড়াই বাংলাদেশের চিকিৎসক আমাকে হার্ট সুস্থ থাকার একটি ওষুধ দিয়েছিলেন, যার দাম বাংলাদেশী টাকায় ১০ টাকা। আবার এসজিপিটি সেরাম (লিভারের একটি টেস্ট) পরীক্ষায় ৮৩ ইউএল (স্বাভাবিক ৪২ ইউএল) হওয়ায় লিভার ভালো থাকার জন্য একটি ওষুধ দিয়েছিলেন, যার দাম বাংলাদেশী টাকায় ৩২ টাকা। অথচ ভারতীয় ডাক্তার এস কে দাস বাংলাদেশের ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র দেখেই বললেন, আপনারতো হার্টের সমস্যা। প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে বললেন এইযে হার্টের ওষুধ খাচ্ছেন। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমার হার্টে কোন সমস্যা নেই। হার্ট যাতে ভালো থাকে তাই ওই ওষুধটা দিয়েছে। কোন ইসিজিও করেননি। কিন্তু ভারতের ডা. এস কে দাস তা মানলেন না। তিনি ইসিজিতো দিলেনই, ইকোও করালেন। এরপর বললেন, আপনারতো লিভারেও সমস্যা, এইযে লিভারের ওষুধ খাচ্ছেন। আমি বললাম লিভার যাতে ভালো থাকে সেজন্য লিভারের ওষুধটা দিয়েছে। এবারও ডা. এস কে দাস মানলেন না। বললেন সমস্যা না থাকলে দেয়নি। এরপর এসজিপিটি সেরামের একাধিক টেস্ট দিলেন, সাথে কালার আল্ট্রাসনোগ্রাম দিলেন। টেস্ট দিলেন সর্বমোট ১৭টি। ভারতীয় রূপিতে বিল হলো ১০ হাজার ৫০০ টাকা, যা বাংলাদেশী টাকায় ১৫ হাজার টাকার মতো। বলে রাখা ভালো ডাক্তার এস কে দাসের ভিজিট ২ হাজার টাকা (তবে অ্যাপোলোতে দেখালে ৫০০ টাকা বেশি), যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৩ হাজার টাকা। মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশে এসজিপিটি সেরাম (লিভারের একটি টেস্ট) পরীক্ষায় ৮৩ ইউএল (স্বাভাবিক ৪২ ইউএল) হলেও কলকাতায় টেস্টে তার রেজাল্ট এসেছে মাত্র ২৫ ইউএল। মানে বছরের পর বছর খামোখা ৩২ টাকার ট্যাবলেট খেয়েছি। কলকাতার টেস্টে ইসিজি, ইকোতেও কোন সমস্যা ধরা পড়ে নাই। বাংলাদেশের দুটি নামকরা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সেরাম ক্রিয়েটিনিন (কিডনির টেস্ট) পরীক্ষায় ১.১ ও ১.৩ এমজি হলেও কলকাতার ডায়াগনস্টিকে করা পরীক্ষায় মাত্র ০.৮৮ হয়েছে।
কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল! এখানেও এক নতুন অভিজ্ঞতা।
বিভিন্ন টেস্টের দরুণ দীর্ঘক্ষণ কলকাতার ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অবস্থান করায় কথা হয় কর্মরত বিভিন্ন স্টাফের সাথে। তাতেতো আমার চোখ ছানাবড়া। যিনি রক্তের স্যাম্পল নিলেন তিনি একজন এমবিবিএস। যিনি ইসিজি করলেন তিনিও একজন এমবিবিএস। অপরজন যিনি রোগীর ওজন, প্রেসার ও তাপমাত্রা মাপলেন, তিনিও এমবিবিএস। অর্থাৎ কোন টেকনিশিয়ানই এমবিবিএস ছাড়া নেই। আমাদের দেশের ল্যাব এসিস্ট্যান্টরা এমবিবিএস হয় কি-না জানিনা। ভারতে চিকিৎসক নিজেই কিন্তু রোগীর প্রেসার মেপে দেখেন। আমাদের দেশের চিকিৎসকের কম্পাউন্ডারদের প্রেসার মাপতে দেখি। এখন বুঝলাম কেন রোগীরা দলে দলে ভারতে যায় চিকিৎসা করাতে।
যাহোক, কলকাতার দর্শনীয় কোন স্থানের নয়নাভিরাম দৃশ্যই প্রথমবারের ভারত ভ্রমণে অবলোকন করা হয়নি। আর তাই দ্বিতীয়বার ভারত ভ্রমণের অপেক্ষায়। অপেক্ষায় নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের।
লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক
প্রিন্ট