ঢাকা , শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

‘১১ মাস লবণাক্ত পানি আর পাঁচ টাকার রুটি খেয়ে বেঁচে ছিলাম’

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • আপডেট টাইম : ১২:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪
  • ২৫৫ বার পঠিত

-সহজলভ্য ঋণে মরণযাত্রা।

জীবনঝুঁকি সত্ত্বেও ইউরোপ পাড়ি দিতে পারলেই বদলাবে ভাগ্যের চাকা। অল্প দিনেই হওয়া যাবে বিত্তবৈভবের মালিক। সচ্ছলতা ফিরবে সংসারে, হওয়া যাবে বাড়ি-গাড়ির মালিক। এমন রঙিন স্বপ্নে বিভর হয়ে প্রতি বছর কয়েক হাজার তরুণ উত্তাল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে মরণযাত্রার পথে পা বাড়ায়। আর তাদের এ পথে নিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে দালাল চক্রের সদস্যরা।

 

যারা গ্রামের অল্পশিক্ষিত ও অসচ্ছল পরিবারগুলোকে লক্ষ্য বানায়, তাদের উন্নত জীবনযাপন ও ভালো আয়সহ অন্যের সফলতার চমকপ্রদ গল্প শুনিয়ে লোভের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। এভাবে দালালদের প্রলোভন ও ইউরোপের উন্নত জীবনের মোহে পড়ে প্রতি বছর শত শত তরুণ সাগরে ডুবে মারা পড়ছে। আবার অসহনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইবার পাশাপাশি উচ্চঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরছে বহু তরুণ।

 

এমনই এক যুবক শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারিয়া ইউনিয়নের উত্তর ভাসানচর গ্রামের ফেরদাউস মাদবর। দালালের উচ্চাভিলাষী কথায় ২০২২ সালের মার্চে ১১ লাখ টাকার বিনিময়ে তার মতো আরও অনেকের সঙ্গে সাগরপথে ইউরোপযাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন। কিন্তু লিবিয়ায় গিয়ে তার যাত্রা থেমে যায়। কারণ সেখানে বাংলাদেশের দালাল চক্রের সদস্যরা তাকে ওই দেশের দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারপর মুক্তিপণ হিসেবে সেই দালালরা দাবি করে ১১ লাখ টাকা। পরিবার টাকা দিতে না পারায় ১১ মাস অন্ধকার বদ্ধঘরে বন্দি ছিলেন। বন্দিজীবনের ওই সময়ে তাকে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছে দালালরা। শেষমেশ ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে গত ডিসেম্বরে অসুস্থ শরীর নিয়ে দেশে ফিরেছেন। সঙ্গে কাঁধে করে এনেছেন লাখ লাখ টাকা ঋণের বোঝা।

 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফেরদাউস বলেন, ‘১১ মাস লবণাক্ত পানি আর পাঁচ টাকার রুটি খেয়ে বেঁচে ছিলাম। শুধু জীবনটুকু নিয়ে গত ডিসেম্বরে বাড়ি ফিরেছি। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরেও এখনো শরীর অনেক দুর্বল। কোনো কাজ করতে পারি না। এদিকে ঋণের টাকার সুদ বাড়ছেই। ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে স্থানীয় এক সুদ কারবারির কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ করেছিল আমার বাবা। শর্ত ছিল লাখে মাসে সুদ দিতে হবে ২ হাজার টাকা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ না হলে সুদের টাকা আরও বাড়বে। সুদ নেওয়ার সময় স্থানীয় মুরব্বিদের সাক্ষী রাখা হয়েছিল। আর বাকি ৫ লাখ টাকা নিয়েছিলাম কয়েকটি এনজিও থেকে।’

 

ভুক্তভোগী এই যুবক আরও বলেন, ‘এনজিও থেকে ঋণ নিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিতে হয়। কয়েকজন আত্মীয়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিয়ে আলাদা আলাদা ১ লাখ করে ৫ লাখ টাকা জোগাড় করেছিলাম। এ টাকা সংগ্রহের সময় তেমন কষ্ট হয়নি। কিন্তু এখন ঋণের টাকা শোধ তো করতে পারছিই না, উল্টো সুদের টাকা যোগ হচ্ছে। খুবই অর্থকষ্টে খেয়ে না খেয়ে দিন পার হচ্ছে।’

 

অবৈধপথে ইউরোপযাত্রায় মুক্তিপণের ৬ লাখ ও ঋণের সুদের টাকাসহ মোট ২২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে জানিয়ে ফেরদাউস বলেন, ‘১৮ লাখ টাকা আমি সুদ কারবারি ও এনজিওর মাধ্যমে পেয়েছি। এখনো সুদের ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। কারণ বছর শেষ হলে সুদের টাকাও বাড়তে থাকে। আমার মতো আরও দুজন সুদ ও এনজিও থেকে টাকা নিয়ে গিয়েছিল। এখন তাদের বাড়ি বিক্রি করে দেনা শোধ করতে হচ্ছে।’

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদেশযাত্রায় মোটা অঙ্কের এমন টাকা জোগাড়ে মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে অভিবাসীপ্রত্যাশীদের পরিবার। জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ভিসা বা পাসপোর্টের ফটোকপি, জমির দলিল জমা ও স্ট্যাম্পে সই দিলেই প্রথম পর্যায়ে চড়া সুদে মিলে ৪-৫ লাখ টাকা। এমন সহজলভ্য ঋণ নিয়ে অবৈধপথে সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশমুখী হচ্ছেন তরুণরা। মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের একাধিক যুবকের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানা গেছে। মাদারীপুরের পাঁচটি উপজেলার মধ্যে সুদে টাকা লেনদেনের শীর্ষে রয়েছে ডাসার। নতুন উপজেলা হওয়ায় সেখানে এনজিওর সংখ্যা তুলনামূলক কম। আর জেলার সদর, রাজৈর ও কালকিনি উপজেলায় এনজিওর সংখ্যা বেশি।

 

চড়া সুদে ঋণের পাশাপাশি অবৈধপথে ইউরোপে যেতে এনজিও থেকেও অর্থ নেন অভিবাসীপ্রত্যাশীরা। এতে প্রকারভেদে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, জমির দলিল, ভিসা ও পাসপোর্টের ফটোকপি জমা দিতে হয়। তার বিনিময়ে মেলে লাখ টাকা। যে টাকায় দালালদের মাধ্যমে ইউরোপযাত্রায় পা বাড়ান অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। এ যাত্রায় ভাগ্য প্রসন্ন হলে অনেকে স্বপ্নের দেশে পা রাখতে পারেন। আর ভাগ্য সহায় না হলে সাগরে ডুবে মরতে হয়। আর নয়তো ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ফিরতে হয় বাড়িতে। ঋণের চাপে তাদের মধ্যে অনেক তরুণ বাড়িছাড়া হয়ে মাসের পর মাস থাকেন ঢাকায়। বিভিন্ন কাজ করে ঋণের টাকা পরিশোধের চেষ্টা করেন তারা। আবার অনেককে জমি ও বাড়ি বিক্রি করে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয়।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর এ দুই জেলায় ছোট-বড় প্রায় ১০০টির মতো এনজিও রয়েছে। এসব এনজিও কয়েক ভাগে ঋণ দিয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ক্ষুদ্র ও বিশেষ ঋণ প্রকল্প। ক্ষুদ্র ঋণে জাতীয় পরিচয়পত্রকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। একজনের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিয়ে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া যায়। আর বিশেষ ঋণে মেলে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা। তবে প্রবাসীরা ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিয়ে কয়েক লাখ টাকা ঋণ করতে পারেন। প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকে ঋণ নিতে গেলে যেসব জটিলতা সৃষ্টি হয় এনজিও থেকে ঋণ পেতে তেমন জটিলতা হয় না। সব মিলিয়ে বিদেশগামীরা খুব সহজে ঋণ নিতে পারেন।

 

তবে এনজিও থেকে সহজে ঋণ মেলে সুদ কারবারিদের কাছ থেকে। জমির দলিল কিংবা স্ট্যাম্পে স্থানীয় মুরব্বিদের সাক্ষী রেখে সই দিলেই মেলে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা। কয়েক দফায় এই টাকা নেওয়া যায়। তার বিপরীতে লাখ প্রতি গুনতে হয় দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা। প্রতি মাসে অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে চক্রবৃদ্ধি হারে তা বাড়তে থাকে। মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে উপজেলাভেদে সুদের তারতম্য লক্ষ করা গেছে।

 

এদিকে নির্দিষ্ট সময়ে টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বাড়ির গরু-ছাগল, গহনা ও জমি বিক্রির চাপ দেওয়া হয়। এমনকি নানা ভয়ভীতি দেখানো হয়। বাধ্য হয়ে ভুক্তভোগীরা নিজের শেষ সম্বল বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করেন। এলাকার প্রভাবশালীরা এসব কাজে জড়িত বলে জানিয়েছেন একাধিক ভুক্তভোগী। বিদেশগামী মানুষদের স্বপ্নকে কাজে লাগিয়ে চড়া সুদে টাকা দিয়ে থাকে কারবারিরা। আর ঋণের এ সহজলভ্যতা এই দুই জেলার তরুণ-যুবকদের অবৈধপথে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সুদ কারবারি বলেন, ‘এটা আমার ব্যবসা, নিজের টাকা দিয়ে ব্যবসা করি। আমরা এনজিওর মতো শর্ত দিয়ে টাকা দিই না। টাকা দেওয়ার সময় শুধু একটা ব্যাংক চেক, সাক্ষী কিংবা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। মানুষের সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা দিয়ে থাকি। আর এ তালিকায় অগ্রাধিকার দিই বিদেশগামীদের।’

 

ঋণের সহজলভ্যতার বিষয়ে জানতে চাইলে মাদারীপুরের মোস্তফাপুর ইউনিয়নের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিসের (এসএসএস) ব্যবস্থাপক মো. মুকুল বলেন, ‘আমরা ক্ষুদ্র ঋণে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা দিয়ে থাকি। তবে বিদেশগামীদের ক্ষেত্রে বৈধ কাগজপত্র দেখে ৫ লাখ পর্যন্ত ঋণ দিই। তবে জেলা জুড়ে ব্যবসায়ীদের থেকেই বিদেশগামীরা বেশি ঋণ নিয়ে থাকে। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া আমরা টাকা দিই না। অবৈধ পন্থায় বিদেশগামীরা তথ্য গোপণ করে ঋণ নিতে পারে, তবে আমরা তাদের ঋণ না দিতে চেষ্টা করি।’

 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওবায়দুল রহমান খান বলেন, ‘জেলার বহু তরুণ অবৈধপথে বিদেশে পাড়ি জমায়। এতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে সুদ কারবারিরা। তারা শুরুতে তরুণদের অর্থের নিশ্চয়তা প্রদান করে প্রলোভন দেখায়। এতে উৎসাহিত হয়ে অনেক তরুণ বিদেশে যাওয়ার জন্য বাবা-মাকে চাপ দেয়। বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা সুদ কারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তা সন্তানদের হাতে তুলে দেয়। এ সংক্রান্ত থানায় অনেক মামলা রয়েছে। আবার কিছু ঘটনা স্থানীয় সালিশের মাধ্যমেও সমাধান করা হয়। অনেক সুদকারবারি জেল খেটে এসে ফের একই কাজের সঙ্গে জড়িত হয়।’

 

মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে এ জেলায় মানবপাচারের ৩২৯টি মামলা হয়েছে। তবে এসব মামলার একটিরও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এ ছাড়া গত ১০ বছরে দালালদের খপ্পরে পড়ে অবৈধপথে বিদেশ যাওয়ার পথে মাদারীপুরের প্রায় ১০০ যুবকের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৩-২৩ এ ১০ বছরে মাদারীপুরের বিভিন্ন থানায় ২৯২টি ও আদালতে ৩৭টি মামলা করে ভুক্তভোগীর পরিবার। এসব মামলায় আসামি ১ হাজার ৪৬৬ জন হলেও গ্রেপ্তার হয়েছে ২৮৭ জন। আর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয় ৯৬টি মামলার। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত দুপক্ষের মধ্যে মীমাংসা হওয়ায় ১১১টি মামলা বাদী প্রত্যাহার করেছে। আর গত ১০ বছরে অবৈধপথে ইতালি পাড়ি জমিয়েছে ৫ হাজার ৫০০ জন।

 

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত শুধু ইতালিতে অবৈধভাবে পাড়ি দিয়েছে ২২ হাজার ৭৭৮ বাংলাদেশি, যা দেশটিতে মোট অবৈধ অভিবাসীর ১৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মিসিং মাইগ্রেন্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের বছরগুলোর তুলনায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে মৃত্যু এবং নিখোঁজের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২১ সালে ২ হাজার ৪৮ জন, পরের বছর ২ হাজার ১১ এবং ২০২৩ সালে ৩ হাজার ৪১ জন নিখোঁজ অথবা ডুবে মারা গেছে ভূমধ্যসাগরে। তাদের মধ্যে কয়েকশ বাংলাদেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সাল পর্যন্ত সোয়া এক লাখ বাংলাদেশি অবৈধভাবে জোটভুক্ত দেশগুলোতে ছিল। ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইতালিতে অবৈধভাবে ১৫ হাজার ২২৮ এবং ২০২১ সালে ৭ হাজার ৮৩৮ জন যায়, তাদের ৯৮ শতাংশই লিবিয়া হয়ে।

 

তবে ঋণের সহজলভ্যতায় তরুণরা বিদেশমুখী এমনটি মনে করেন না বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার মানুষরা মূলত নিজের জমি বা আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমান। কারণ ওই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ ইতালিতে থাকে এবং আত্মীয়দের সহযোগিতায় তারা এ মরণযাত্রায় অংশ নেন।’

 

তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘অবৈধপথে বিদেশগামিতার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তার মধ্যে সহজে ঋণ পাওয়ার বিষয়টি একটি ফ্যাক্টর। কারণ সহজে টাকা পাওয়া গেলে তরুণরা ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে। সেই কাজটি মূলত মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এ ছাড়া ওই দুই জেলায় অনেক মানুষ সাগরপথে ইউরোপে গিয়ে অর্থ উপার্জন করায় অন্যরা উৎসাহিত হয়ে এ পথ বেছে নেয়।’

 

এ বিষয়ে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, ‘মাদারীপুরের বেশিরভাগ মানুষের অবৈধভাবে দালালের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা বেশি। আর এ সুযোগে সুদ কারবারিরা সক্রিয়। তবে এ সংক্রান্ত অভিযোগ পেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এ ছাড়া আমরা বিভিন্ন সময় ক্যাম্পেইন করছি, যাতে দালালদের প্রলোভনে তারা উৎসাহিত না হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবুও তরুণরা এ পথে পা বাড়াচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের সব থেকে বেশি সচেতন হতে হবে। নয়তো এ প্রবণতা কমবে না।’

Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

error: Content is protected !!

‘১১ মাস লবণাক্ত পানি আর পাঁচ টাকার রুটি খেয়ে বেঁচে ছিলাম’

আপডেট টাইম : ১২:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪
ডেস্ক রিপোর্ট :

জীবনঝুঁকি সত্ত্বেও ইউরোপ পাড়ি দিতে পারলেই বদলাবে ভাগ্যের চাকা। অল্প দিনেই হওয়া যাবে বিত্তবৈভবের মালিক। সচ্ছলতা ফিরবে সংসারে, হওয়া যাবে বাড়ি-গাড়ির মালিক। এমন রঙিন স্বপ্নে বিভর হয়ে প্রতি বছর কয়েক হাজার তরুণ উত্তাল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে মরণযাত্রার পথে পা বাড়ায়। আর তাদের এ পথে নিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে দালাল চক্রের সদস্যরা।

 

যারা গ্রামের অল্পশিক্ষিত ও অসচ্ছল পরিবারগুলোকে লক্ষ্য বানায়, তাদের উন্নত জীবনযাপন ও ভালো আয়সহ অন্যের সফলতার চমকপ্রদ গল্প শুনিয়ে লোভের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। এভাবে দালালদের প্রলোভন ও ইউরোপের উন্নত জীবনের মোহে পড়ে প্রতি বছর শত শত তরুণ সাগরে ডুবে মারা পড়ছে। আবার অসহনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইবার পাশাপাশি উচ্চঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরছে বহু তরুণ।

 

এমনই এক যুবক শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারিয়া ইউনিয়নের উত্তর ভাসানচর গ্রামের ফেরদাউস মাদবর। দালালের উচ্চাভিলাষী কথায় ২০২২ সালের মার্চে ১১ লাখ টাকার বিনিময়ে তার মতো আরও অনেকের সঙ্গে সাগরপথে ইউরোপযাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন। কিন্তু লিবিয়ায় গিয়ে তার যাত্রা থেমে যায়। কারণ সেখানে বাংলাদেশের দালাল চক্রের সদস্যরা তাকে ওই দেশের দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারপর মুক্তিপণ হিসেবে সেই দালালরা দাবি করে ১১ লাখ টাকা। পরিবার টাকা দিতে না পারায় ১১ মাস অন্ধকার বদ্ধঘরে বন্দি ছিলেন। বন্দিজীবনের ওই সময়ে তাকে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছে দালালরা। শেষমেশ ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে গত ডিসেম্বরে অসুস্থ শরীর নিয়ে দেশে ফিরেছেন। সঙ্গে কাঁধে করে এনেছেন লাখ লাখ টাকা ঋণের বোঝা।

 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফেরদাউস বলেন, ‘১১ মাস লবণাক্ত পানি আর পাঁচ টাকার রুটি খেয়ে বেঁচে ছিলাম। শুধু জীবনটুকু নিয়ে গত ডিসেম্বরে বাড়ি ফিরেছি। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরেও এখনো শরীর অনেক দুর্বল। কোনো কাজ করতে পারি না। এদিকে ঋণের টাকার সুদ বাড়ছেই। ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে স্থানীয় এক সুদ কারবারির কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ করেছিল আমার বাবা। শর্ত ছিল লাখে মাসে সুদ দিতে হবে ২ হাজার টাকা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ না হলে সুদের টাকা আরও বাড়বে। সুদ নেওয়ার সময় স্থানীয় মুরব্বিদের সাক্ষী রাখা হয়েছিল। আর বাকি ৫ লাখ টাকা নিয়েছিলাম কয়েকটি এনজিও থেকে।’

 

ভুক্তভোগী এই যুবক আরও বলেন, ‘এনজিও থেকে ঋণ নিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিতে হয়। কয়েকজন আত্মীয়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিয়ে আলাদা আলাদা ১ লাখ করে ৫ লাখ টাকা জোগাড় করেছিলাম। এ টাকা সংগ্রহের সময় তেমন কষ্ট হয়নি। কিন্তু এখন ঋণের টাকা শোধ তো করতে পারছিই না, উল্টো সুদের টাকা যোগ হচ্ছে। খুবই অর্থকষ্টে খেয়ে না খেয়ে দিন পার হচ্ছে।’

 

অবৈধপথে ইউরোপযাত্রায় মুক্তিপণের ৬ লাখ ও ঋণের সুদের টাকাসহ মোট ২২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে জানিয়ে ফেরদাউস বলেন, ‘১৮ লাখ টাকা আমি সুদ কারবারি ও এনজিওর মাধ্যমে পেয়েছি। এখনো সুদের ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। কারণ বছর শেষ হলে সুদের টাকাও বাড়তে থাকে। আমার মতো আরও দুজন সুদ ও এনজিও থেকে টাকা নিয়ে গিয়েছিল। এখন তাদের বাড়ি বিক্রি করে দেনা শোধ করতে হচ্ছে।’

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদেশযাত্রায় মোটা অঙ্কের এমন টাকা জোগাড়ে মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে অভিবাসীপ্রত্যাশীদের পরিবার। জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ভিসা বা পাসপোর্টের ফটোকপি, জমির দলিল জমা ও স্ট্যাম্পে সই দিলেই প্রথম পর্যায়ে চড়া সুদে মিলে ৪-৫ লাখ টাকা। এমন সহজলভ্য ঋণ নিয়ে অবৈধপথে সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশমুখী হচ্ছেন তরুণরা। মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের একাধিক যুবকের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানা গেছে। মাদারীপুরের পাঁচটি উপজেলার মধ্যে সুদে টাকা লেনদেনের শীর্ষে রয়েছে ডাসার। নতুন উপজেলা হওয়ায় সেখানে এনজিওর সংখ্যা তুলনামূলক কম। আর জেলার সদর, রাজৈর ও কালকিনি উপজেলায় এনজিওর সংখ্যা বেশি।

 

চড়া সুদে ঋণের পাশাপাশি অবৈধপথে ইউরোপে যেতে এনজিও থেকেও অর্থ নেন অভিবাসীপ্রত্যাশীরা। এতে প্রকারভেদে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, জমির দলিল, ভিসা ও পাসপোর্টের ফটোকপি জমা দিতে হয়। তার বিনিময়ে মেলে লাখ টাকা। যে টাকায় দালালদের মাধ্যমে ইউরোপযাত্রায় পা বাড়ান অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। এ যাত্রায় ভাগ্য প্রসন্ন হলে অনেকে স্বপ্নের দেশে পা রাখতে পারেন। আর ভাগ্য সহায় না হলে সাগরে ডুবে মরতে হয়। আর নয়তো ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ফিরতে হয় বাড়িতে। ঋণের চাপে তাদের মধ্যে অনেক তরুণ বাড়িছাড়া হয়ে মাসের পর মাস থাকেন ঢাকায়। বিভিন্ন কাজ করে ঋণের টাকা পরিশোধের চেষ্টা করেন তারা। আবার অনেককে জমি ও বাড়ি বিক্রি করে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয়।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর এ দুই জেলায় ছোট-বড় প্রায় ১০০টির মতো এনজিও রয়েছে। এসব এনজিও কয়েক ভাগে ঋণ দিয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ক্ষুদ্র ও বিশেষ ঋণ প্রকল্প। ক্ষুদ্র ঋণে জাতীয় পরিচয়পত্রকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। একজনের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিয়ে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া যায়। আর বিশেষ ঋণে মেলে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা। তবে প্রবাসীরা ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিয়ে কয়েক লাখ টাকা ঋণ করতে পারেন। প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকে ঋণ নিতে গেলে যেসব জটিলতা সৃষ্টি হয় এনজিও থেকে ঋণ পেতে তেমন জটিলতা হয় না। সব মিলিয়ে বিদেশগামীরা খুব সহজে ঋণ নিতে পারেন।

 

তবে এনজিও থেকে সহজে ঋণ মেলে সুদ কারবারিদের কাছ থেকে। জমির দলিল কিংবা স্ট্যাম্পে স্থানীয় মুরব্বিদের সাক্ষী রেখে সই দিলেই মেলে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা। কয়েক দফায় এই টাকা নেওয়া যায়। তার বিপরীতে লাখ প্রতি গুনতে হয় দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা। প্রতি মাসে অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে চক্রবৃদ্ধি হারে তা বাড়তে থাকে। মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে উপজেলাভেদে সুদের তারতম্য লক্ষ করা গেছে।

 

এদিকে নির্দিষ্ট সময়ে টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বাড়ির গরু-ছাগল, গহনা ও জমি বিক্রির চাপ দেওয়া হয়। এমনকি নানা ভয়ভীতি দেখানো হয়। বাধ্য হয়ে ভুক্তভোগীরা নিজের শেষ সম্বল বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করেন। এলাকার প্রভাবশালীরা এসব কাজে জড়িত বলে জানিয়েছেন একাধিক ভুক্তভোগী। বিদেশগামী মানুষদের স্বপ্নকে কাজে লাগিয়ে চড়া সুদে টাকা দিয়ে থাকে কারবারিরা। আর ঋণের এ সহজলভ্যতা এই দুই জেলার তরুণ-যুবকদের অবৈধপথে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সুদ কারবারি বলেন, ‘এটা আমার ব্যবসা, নিজের টাকা দিয়ে ব্যবসা করি। আমরা এনজিওর মতো শর্ত দিয়ে টাকা দিই না। টাকা দেওয়ার সময় শুধু একটা ব্যাংক চেক, সাক্ষী কিংবা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। মানুষের সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা দিয়ে থাকি। আর এ তালিকায় অগ্রাধিকার দিই বিদেশগামীদের।’

 

ঋণের সহজলভ্যতার বিষয়ে জানতে চাইলে মাদারীপুরের মোস্তফাপুর ইউনিয়নের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিসের (এসএসএস) ব্যবস্থাপক মো. মুকুল বলেন, ‘আমরা ক্ষুদ্র ঋণে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা দিয়ে থাকি। তবে বিদেশগামীদের ক্ষেত্রে বৈধ কাগজপত্র দেখে ৫ লাখ পর্যন্ত ঋণ দিই। তবে জেলা জুড়ে ব্যবসায়ীদের থেকেই বিদেশগামীরা বেশি ঋণ নিয়ে থাকে। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া আমরা টাকা দিই না। অবৈধ পন্থায় বিদেশগামীরা তথ্য গোপণ করে ঋণ নিতে পারে, তবে আমরা তাদের ঋণ না দিতে চেষ্টা করি।’

 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওবায়দুল রহমান খান বলেন, ‘জেলার বহু তরুণ অবৈধপথে বিদেশে পাড়ি জমায়। এতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে সুদ কারবারিরা। তারা শুরুতে তরুণদের অর্থের নিশ্চয়তা প্রদান করে প্রলোভন দেখায়। এতে উৎসাহিত হয়ে অনেক তরুণ বিদেশে যাওয়ার জন্য বাবা-মাকে চাপ দেয়। বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা সুদ কারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তা সন্তানদের হাতে তুলে দেয়। এ সংক্রান্ত থানায় অনেক মামলা রয়েছে। আবার কিছু ঘটনা স্থানীয় সালিশের মাধ্যমেও সমাধান করা হয়। অনেক সুদকারবারি জেল খেটে এসে ফের একই কাজের সঙ্গে জড়িত হয়।’

 

মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে এ জেলায় মানবপাচারের ৩২৯টি মামলা হয়েছে। তবে এসব মামলার একটিরও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এ ছাড়া গত ১০ বছরে দালালদের খপ্পরে পড়ে অবৈধপথে বিদেশ যাওয়ার পথে মাদারীপুরের প্রায় ১০০ যুবকের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৩-২৩ এ ১০ বছরে মাদারীপুরের বিভিন্ন থানায় ২৯২টি ও আদালতে ৩৭টি মামলা করে ভুক্তভোগীর পরিবার। এসব মামলায় আসামি ১ হাজার ৪৬৬ জন হলেও গ্রেপ্তার হয়েছে ২৮৭ জন। আর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয় ৯৬টি মামলার। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত দুপক্ষের মধ্যে মীমাংসা হওয়ায় ১১১টি মামলা বাদী প্রত্যাহার করেছে। আর গত ১০ বছরে অবৈধপথে ইতালি পাড়ি জমিয়েছে ৫ হাজার ৫০০ জন।

 

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত শুধু ইতালিতে অবৈধভাবে পাড়ি দিয়েছে ২২ হাজার ৭৭৮ বাংলাদেশি, যা দেশটিতে মোট অবৈধ অভিবাসীর ১৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মিসিং মাইগ্রেন্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের বছরগুলোর তুলনায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে মৃত্যু এবং নিখোঁজের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২১ সালে ২ হাজার ৪৮ জন, পরের বছর ২ হাজার ১১ এবং ২০২৩ সালে ৩ হাজার ৪১ জন নিখোঁজ অথবা ডুবে মারা গেছে ভূমধ্যসাগরে। তাদের মধ্যে কয়েকশ বাংলাদেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সাল পর্যন্ত সোয়া এক লাখ বাংলাদেশি অবৈধভাবে জোটভুক্ত দেশগুলোতে ছিল। ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইতালিতে অবৈধভাবে ১৫ হাজার ২২৮ এবং ২০২১ সালে ৭ হাজার ৮৩৮ জন যায়, তাদের ৯৮ শতাংশই লিবিয়া হয়ে।

 

তবে ঋণের সহজলভ্যতায় তরুণরা বিদেশমুখী এমনটি মনে করেন না বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার মানুষরা মূলত নিজের জমি বা আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমান। কারণ ওই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ ইতালিতে থাকে এবং আত্মীয়দের সহযোগিতায় তারা এ মরণযাত্রায় অংশ নেন।’

 

তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘অবৈধপথে বিদেশগামিতার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তার মধ্যে সহজে ঋণ পাওয়ার বিষয়টি একটি ফ্যাক্টর। কারণ সহজে টাকা পাওয়া গেলে তরুণরা ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে। সেই কাজটি মূলত মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এ ছাড়া ওই দুই জেলায় অনেক মানুষ সাগরপথে ইউরোপে গিয়ে অর্থ উপার্জন করায় অন্যরা উৎসাহিত হয়ে এ পথ বেছে নেয়।’

 

এ বিষয়ে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, ‘মাদারীপুরের বেশিরভাগ মানুষের অবৈধভাবে দালালের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা বেশি। আর এ সুযোগে সুদ কারবারিরা সক্রিয়। তবে এ সংক্রান্ত অভিযোগ পেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এ ছাড়া আমরা বিভিন্ন সময় ক্যাম্পেইন করছি, যাতে দালালদের প্রলোভনে তারা উৎসাহিত না হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবুও তরুণরা এ পথে পা বাড়াচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের সব থেকে বেশি সচেতন হতে হবে। নয়তো এ প্রবণতা কমবে না।’