ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

পোস্ট অফিসে দামাদামি

ক্লাস নাইন-টেনের ইতিহাস বই পড়ে যে দিন প্রথম জানতে পারলাম যে, শেরশাহ ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন, সেদিন ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। শেরশাহের আগে ঘোড়ার গলায় বা জিহ্বায় এমন কী ত্রুটি ছিল যে বেচারারা ডাকতে পর্যন্ত পারতো না! শেরশাহ এই অবলা জীবগুলোকে কী কৌশলে ডাকতে শেখালেন তা নিয়েও মনে মনে আমার গবেষণার অন্ত ছিল না।

 

যে দিন জানতে পারলাম যে, এই ঘোড়ার ডাক অর্থ “হ্রেষা”রব নয়, বরং জনসাধারণের চিঠি, মালপত্র, টাকাপয়সা ঘোড়ার সাহায্যে এক ডাকঘর থেকে অন্য ডাকঘরে নেয়া — তখন স্বস্তি পেলাম এবং নিজের বোকামীর কথা ভেবে আপনমনে হাসলাম।

 

বোয়ালমারীর কাঁচাবাজার লাগোয়া পোস্ট অফিসের সামনের রাস্তা তখন ইটের। ঘোড়ার গাড়িসহ অন্যান্য গাড়িঘোড়া চলাচলের কারণে রাস্তার মাঝখানটা উঁচু, দুইপাশ ঢালু। রাস্তার জায়গায় জায়গায় ইট খোয়া যাওয়ায় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে।

 

এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের সময় পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেক কিছু ভাবতাম। অফিসের গেটের সামনে দাঁড়ানো কালো টুপি পরা লাল রঙের গোলাকার পোস্টবক্সটাই আমাকে বেশি ভাবাতো।

 

আব্বা আমাকে মাঝে মাঝে চিঠি পোস্ট করতে পাঠাতেন। আমি সে চিঠি পোস্ট অফিসের সামনের ওই লাল বাক্সে ফেলে, একটু সরে এসে যথারীতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গবেষণা করতাম। গবেষণার বিষয় ছিল – বাক্সে ফেলা সব চিঠিপত্র কী করে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে যায়?

 

 

“গবেষণা” শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছাই — এই বক্সের নিচে দিয়ে অনেক প্লাস্টিকের পাইপ আছে, যার এক এক পাইপ দিয়ে এক এক জেলার চিঠি যায়। সেই ১৯৮৩ সালে, যখন আমি ক্লাস টেনের ছাত্র, তখন অবশ্য দেশে জেলা ছিল কুড়িটি।

 

বোয়ালমারীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের অনুরোধে আব্বা এর আগেই (১৯৮১) ঢাকার পোস্ট অফিস হাইস্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বোয়ালমারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

 

ঢাকায় থাকতে আম্মার নেতৃত্বে আমাদের ঈদের কেনাকাটা হতো গুলিস্তানে আর ফুলবাড়িয়ায়। ফলে ইতোমধ্যেই আমি জেনে গেছি যে, জিনিস কিনতে হয় কঠিন দরাদরি করে। আর গুলিস্তান ও ফুলবাড়িয়ায় কোনো জিনিসের দাম দোকানদার/হকার যা চাইবেন, দাম বলতে হবে তার তিন ভাগের এক ভাগ। অন্যান্য মার্কেটে অর্ধেক বললেও চলবে।

 

বোয়ালমারীতে এসে চাল, ডাল, তেল, চিনি এ ধরণের “পাকা” বাজার আমরা বাঁধা দোকান থেকে নেই। আব্বা মাস শেষে বিল দেন, আমাদের দরাদরির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মাছ, মাংস, শাকসবজি কিনতে আমার কিংবা আমার ছোট ভাইদের নিয়মিতই বাজারে আসতে হয়।

 

ঢাকা থেকে শিখে আসা দরাদরির কৌশল এখানে প্রয়োগ করতে যেয়ে বিক্রেতাদের সাথে তর্কাতর্কি হয়েছে কয়েকবার। কারণ, এখানে ফুলবাড়িয়া কিংবা গুলিস্তানের মত “গলাকাটা” দাম চাওয়া হয় না। কাজেই এখানে অর্ধেক কিংবা তিন ভাগের এক ভাগ দাম বলার থিওরি অচল। তিন ভাগের এক ভাগ দাম বলে একাধিকবার মাছঅলা, সব্জিঅলার কাছে শুনতে হয়েছে – মাল কিনতে আসছো, না ইয়ার্কি মারতে আসছো?

 

ঢাকায় থাকতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আব্বার যে ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ছাপা হতো সেগুলো তিনি হাতে হাতে পত্রিকা অফিসে পৌঁছাতেন। বোয়ালমারী এসে সেগুলো পাঠাতে হচ্ছে ডাকযোগে। আব্বা তাই প্রায়ই একসাথে অনেকগুলো এনভেলাপ নিয়ে আসতেন।

 

আব্বা স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকায় একদিন আমাকে পাঠালেন একটা মাত্র এনভেলাপ কেনার জন্য। এতদিন বাইরের বক্সে চিঠি ফেলে চলে গেছি, আজ পেলাম ভিতরে ঢোকার সুযোগ।

 

 

ঢুকেই দেখি একজন নাম-ঠিকানা লেখা এনভেলাপে দ্রুতগতিতে গোলাকার সীল মেরে যাচ্ছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম — এনভেলাপ আছে? তিনি দেখিয়ে দিলেন — এনভেলাপ ওই কর্ণারের কাউন্টারে। আমি সেই কাউন্টারে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম — এনভেলাপ আছে? কাউন্টারে বসা তরুণ ডাককর্মী আমার দিকে একবার চোখ তুলে তাকালেন, চোখে সামান্য বিস্ময় (পোস্ট অফিসে এনভেলাপ থাকবে না!)। মুখে বললেন — আছে।
— একখানের দাম কত?
— চার আনা।

আড়াই পয়সার কোনো কয়েন না থাকায় আমি অর্ধেক দাম না বলে আরেকটু কমিয়ে বললাম — দশ পয়সায় দেবেন? ডাককর্মীর বিস্ময় এবার সীমা ছাড়ালো। তিনি বললেন – এখানে দামাদামি নাই, একদাম।
মনে মনে ভাবলাম, দামাদামি নাই মানে! আমাকে বোকা পাইছেন? মুখে বললাম — পনেরো পয়সা রাখেন।

 

বিস্ময় এবার বিরক্তিতে পরিণত হলো। ডাককর্মী আমাকে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন — পঁচিশ পয়সার কম হবে না। আশেপাশের অন্য দু’একজন কর্মীও আমাকে বুঝালেন, এখানে দামাদামি চলে না, একদামে সব কিনতে হয়।

 

আমি তবু শেষবারের মতো আকুতি জানালাম — পাঁচটা পয়সা অন্তত কম রাখেন!
ধমকের মাত্রা এবার বাড়লো। ডাককর্মী বললেন — তুমি সাইডে দাঁড়াও, পিছনের জনকে কিনতে দেও।
আমি তখন নিরূপায় হয়ে বললাম — আচ্ছা, দেন একখান।
তিনি বললেন – পয়সা দাও।
আমি বললাম — আগে এনভেলাপ দেন!
জবাব পেলাম — এখানে আগে পয়সা দিতে হয়।
ওরা দলে ভারী। বয়সে সবাই আমার বড়। তাই আর কথা বাড়ানোর সাহস পেলাম না। কান্না চেপে আব্বার দেয়া পঁচিশ পয়সা নীরবে এগিয়ে দিলাম।
পাঁচটা পয়সাও কম নিল না! ওরা এত নিষ্ঠুর কেন?


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ
error: Content is protected !!

পোস্ট অফিসে দামাদামি

আপডেট টাইম : ০৮:৩১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ মার্চ ২০২৪
গাজী শাহিদুজ্জামান লিটন :

ক্লাস নাইন-টেনের ইতিহাস বই পড়ে যে দিন প্রথম জানতে পারলাম যে, শেরশাহ ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন, সেদিন ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। শেরশাহের আগে ঘোড়ার গলায় বা জিহ্বায় এমন কী ত্রুটি ছিল যে বেচারারা ডাকতে পর্যন্ত পারতো না! শেরশাহ এই অবলা জীবগুলোকে কী কৌশলে ডাকতে শেখালেন তা নিয়েও মনে মনে আমার গবেষণার অন্ত ছিল না।

 

যে দিন জানতে পারলাম যে, এই ঘোড়ার ডাক অর্থ “হ্রেষা”রব নয়, বরং জনসাধারণের চিঠি, মালপত্র, টাকাপয়সা ঘোড়ার সাহায্যে এক ডাকঘর থেকে অন্য ডাকঘরে নেয়া — তখন স্বস্তি পেলাম এবং নিজের বোকামীর কথা ভেবে আপনমনে হাসলাম।

 

বোয়ালমারীর কাঁচাবাজার লাগোয়া পোস্ট অফিসের সামনের রাস্তা তখন ইটের। ঘোড়ার গাড়িসহ অন্যান্য গাড়িঘোড়া চলাচলের কারণে রাস্তার মাঝখানটা উঁচু, দুইপাশ ঢালু। রাস্তার জায়গায় জায়গায় ইট খোয়া যাওয়ায় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে।

 

এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের সময় পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেক কিছু ভাবতাম। অফিসের গেটের সামনে দাঁড়ানো কালো টুপি পরা লাল রঙের গোলাকার পোস্টবক্সটাই আমাকে বেশি ভাবাতো।

 

আব্বা আমাকে মাঝে মাঝে চিঠি পোস্ট করতে পাঠাতেন। আমি সে চিঠি পোস্ট অফিসের সামনের ওই লাল বাক্সে ফেলে, একটু সরে এসে যথারীতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গবেষণা করতাম। গবেষণার বিষয় ছিল – বাক্সে ফেলা সব চিঠিপত্র কী করে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে যায়?

 

 

“গবেষণা” শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছাই — এই বক্সের নিচে দিয়ে অনেক প্লাস্টিকের পাইপ আছে, যার এক এক পাইপ দিয়ে এক এক জেলার চিঠি যায়। সেই ১৯৮৩ সালে, যখন আমি ক্লাস টেনের ছাত্র, তখন অবশ্য দেশে জেলা ছিল কুড়িটি।

 

বোয়ালমারীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের অনুরোধে আব্বা এর আগেই (১৯৮১) ঢাকার পোস্ট অফিস হাইস্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বোয়ালমারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

 

ঢাকায় থাকতে আম্মার নেতৃত্বে আমাদের ঈদের কেনাকাটা হতো গুলিস্তানে আর ফুলবাড়িয়ায়। ফলে ইতোমধ্যেই আমি জেনে গেছি যে, জিনিস কিনতে হয় কঠিন দরাদরি করে। আর গুলিস্তান ও ফুলবাড়িয়ায় কোনো জিনিসের দাম দোকানদার/হকার যা চাইবেন, দাম বলতে হবে তার তিন ভাগের এক ভাগ। অন্যান্য মার্কেটে অর্ধেক বললেও চলবে।

 

বোয়ালমারীতে এসে চাল, ডাল, তেল, চিনি এ ধরণের “পাকা” বাজার আমরা বাঁধা দোকান থেকে নেই। আব্বা মাস শেষে বিল দেন, আমাদের দরাদরির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মাছ, মাংস, শাকসবজি কিনতে আমার কিংবা আমার ছোট ভাইদের নিয়মিতই বাজারে আসতে হয়।

 

ঢাকা থেকে শিখে আসা দরাদরির কৌশল এখানে প্রয়োগ করতে যেয়ে বিক্রেতাদের সাথে তর্কাতর্কি হয়েছে কয়েকবার। কারণ, এখানে ফুলবাড়িয়া কিংবা গুলিস্তানের মত “গলাকাটা” দাম চাওয়া হয় না। কাজেই এখানে অর্ধেক কিংবা তিন ভাগের এক ভাগ দাম বলার থিওরি অচল। তিন ভাগের এক ভাগ দাম বলে একাধিকবার মাছঅলা, সব্জিঅলার কাছে শুনতে হয়েছে – মাল কিনতে আসছো, না ইয়ার্কি মারতে আসছো?

 

ঢাকায় থাকতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আব্বার যে ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ছাপা হতো সেগুলো তিনি হাতে হাতে পত্রিকা অফিসে পৌঁছাতেন। বোয়ালমারী এসে সেগুলো পাঠাতে হচ্ছে ডাকযোগে। আব্বা তাই প্রায়ই একসাথে অনেকগুলো এনভেলাপ নিয়ে আসতেন।

 

আব্বা স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকায় একদিন আমাকে পাঠালেন একটা মাত্র এনভেলাপ কেনার জন্য। এতদিন বাইরের বক্সে চিঠি ফেলে চলে গেছি, আজ পেলাম ভিতরে ঢোকার সুযোগ।

 

 

ঢুকেই দেখি একজন নাম-ঠিকানা লেখা এনভেলাপে দ্রুতগতিতে গোলাকার সীল মেরে যাচ্ছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম — এনভেলাপ আছে? তিনি দেখিয়ে দিলেন — এনভেলাপ ওই কর্ণারের কাউন্টারে। আমি সেই কাউন্টারে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম — এনভেলাপ আছে? কাউন্টারে বসা তরুণ ডাককর্মী আমার দিকে একবার চোখ তুলে তাকালেন, চোখে সামান্য বিস্ময় (পোস্ট অফিসে এনভেলাপ থাকবে না!)। মুখে বললেন — আছে।
— একখানের দাম কত?
— চার আনা।

আড়াই পয়সার কোনো কয়েন না থাকায় আমি অর্ধেক দাম না বলে আরেকটু কমিয়ে বললাম — দশ পয়সায় দেবেন? ডাককর্মীর বিস্ময় এবার সীমা ছাড়ালো। তিনি বললেন – এখানে দামাদামি নাই, একদাম।
মনে মনে ভাবলাম, দামাদামি নাই মানে! আমাকে বোকা পাইছেন? মুখে বললাম — পনেরো পয়সা রাখেন।

 

বিস্ময় এবার বিরক্তিতে পরিণত হলো। ডাককর্মী আমাকে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন — পঁচিশ পয়সার কম হবে না। আশেপাশের অন্য দু’একজন কর্মীও আমাকে বুঝালেন, এখানে দামাদামি চলে না, একদামে সব কিনতে হয়।

 

আমি তবু শেষবারের মতো আকুতি জানালাম — পাঁচটা পয়সা অন্তত কম রাখেন!
ধমকের মাত্রা এবার বাড়লো। ডাককর্মী বললেন — তুমি সাইডে দাঁড়াও, পিছনের জনকে কিনতে দেও।
আমি তখন নিরূপায় হয়ে বললাম — আচ্ছা, দেন একখান।
তিনি বললেন – পয়সা দাও।
আমি বললাম — আগে এনভেলাপ দেন!
জবাব পেলাম — এখানে আগে পয়সা দিতে হয়।
ওরা দলে ভারী। বয়সে সবাই আমার বড়। তাই আর কথা বাড়ানোর সাহস পেলাম না। কান্না চেপে আব্বার দেয়া পঁচিশ পয়সা নীরবে এগিয়ে দিলাম।
পাঁচটা পয়সাও কম নিল না! ওরা এত নিষ্ঠুর কেন?


প্রিন্ট