ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

ইলিশের ডিম নিয়ে একি ঝামেলা !

১.

ইলিশ মাছের ডিমের লোভে কি নাজেহালটাইনা হতে হয়েছিল সেবার!

এ ঘটনা ১৯৮৪ সালের। আমার এসএসসি রেজাল্টের পর মেজভাই গাজী কামরুজ্জামান টোকন আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন, ভালো কলেজে ভর্তি করবেন বলে। মেজভাই তখন পড়াশোনা করেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে (তেজগাঁওয়ে অবস্থিত)। টিউশনি করে প্রতি মাসে ভালোই আয় রোজগার করেন।

ঢাকা কলেজ আর নটরডেম কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। চান্স হলো না। ঢাকার অন্য কোনো সাধারণ কলেজে পড়ার চেয়ে বোয়ালমারীতে পড়াই উত্তম মনে হলো। এবার তাই বাড়ি ফেরার পালা।

একা একা কখনো বেশি দূরে যাইনি। মেজভাই তাই উদ্বুদ্ধ করলেন – আজ বাদে কাল কলেজে ভর্তি হচ্ছিস, এখন নিজের পায়ে চলতে হবে, একা একা বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে চলে যাওয়ার সাহস করতে হবে।

২.

দূরপাল্লার বাস তখন ছাড়ত গুলিস্তান কিংবা ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে। মেজভাই টিকেট কেটে আমাকে ফরিদপুরের ডাইরেক্ট বাসে উঠিয়ে দিলেন। আর হাতে দিলেন নগদ ৫০ টাকা। পঞ্চাশ টাকা তখন আমার কাছে অ নে ক টাকা!

বাস আমাদের আরিচা ঘাটে নামিয়ে দিল। সুপারভাইজার সব যাত্রীকে নিয়ে লঞ্চে উঠলেন। দৌলতদিয়ায় নেমে একই কোম্পানির বাসে তিনি আমাদের ফরিদপুর নিয়ে যাবেন।

দৌলতদিয়ায় নেমে জানা গেল , আমাদের এপারের বাস এখনও এসে পৌঁছায়নি। ফলে, যাত্রীরা পান, বিড়ি, চা, সিগারেট কিংবা হালকা নাস্তা খেতে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ল।

বাসস্ট্যান্ডের সাথেই সারি সারি ভাতের হোটেল। সব হোটেলের সামনেই একজন বা দুইজন কর্মচারী হেঁকে চলেছে – আসেন ভাই, আসেন। গরম ভাত, ইলিশ মাছ!

৩.

গরম ভাতের ধোঁয়া উড়ছে। তার সুঘ্রাণ নাসারন্ধ্রের ভিতর দিয়ে সারা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যাচ্ছে। ভাতের ঘ্রাণের চেয়ে সুগন্ধি পৃথিবীতে আর কীইবা আছে!
বাস আসতে যেহেতু দেরি হবে, এই অবস্থায় ভাতের আহ্বানকে অবহেলা করা রীতিমত অন্যায় হবে ভেবে ঢুকে পড়লাম নিকটতম “ধোঁয়া উড়া” ভাতের হোটেলে। ঠকে যাওয়ার ভয়ে দাম জেনে নিলাম আগেই – ইলিশ মাছ ৮ টাকা পিস, ভাত প্রতি প্লেট দুই টাকা।
আমি এক প্লেট ভাত আর এক পিস ইলিশ মাছের অর্ডার দিলাম। ওদের অনুরোধ করলাম, বাস আসলে যেন আমাকে ডেকে দেয়। ম্যানেজার ও একজন ওয়েটার এ বিষয়ে আমাকে জোরালোভাবে আশ্বস্ত করলেন, বললেন – তুমি নিশ্চিন্ত মনে খাও।

ভাত এলো। এলো বেগুন–আলু–ইলিশ মাছের ঝোল। আর সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয়, মাছের সাথে ওরা ইলিশের ডিমও দিয়েছে বড়সড় এক টুকরো। কত যে আনন্দ হলো! পদ্মাপাড়ের হোটেলগুলোতে এই তাহলে ব্যাপার! পদ্মার ইলিশের সাথে ইলিশের ডিমও মেলে ফাউ!

আয়েশ করে খাচ্ছি। কি যে স্বাদ! আমাদের বাসের আরেক যাত্রী সামনের টেবিলে বসে খাচ্ছিলেন। অর্ধেক খাবার রেখে হঠাৎ তিনি তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন। আমার হাসি পেল। এত তাড়াহুড়োর কি আছে? বাস আসলেতো এরা ডেকেই দেবে!

৪.

আমি আয়েশ করে খেয়ে, সাবান-পানি দিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে, ক্যাশ কাউন্টারের সামনে এসে, কেটে রাখা খবরের কাগজের টুকরো দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে ৫০ টাকার নোটখানা ক্যাশে বসা ম্যানেজার সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি নোটটা ক্যাশে রেখে আমাকে ত্রিশ টাকা ফেরত দিলেন। আমি আর দশ টাকার আশায় হাত বাড়িয়ে রাখলাম। কারণ, আমার হিসাবে বিল হয় ১০ টাকা। মাছ এক পিস ৮ টাকা, এক প্লেট ভাত ২ টাকা।

আমার হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে ম্যানেজার বললেন — কী ব্যাপার? আমি বললাম — আর দশ টাকা। বললেন – তোমার বিলতো হয়েছে কুড়ি টাকা। ভাত এক প্লেট দুই টাকা, মাছ আট টাকা, মাছের ডিম দশ টাকা। শুনে আমার বুক ধড়ফড় করে উঠলো, গলা গেলো শুকিয়ে। মুহূর্তে বুঝে গেলাম, পদ্মায় যত ইলিশই পাওয়া যাক, তার একটা আঁশও এখানে ফাউ পাওয়া যাবে না।

আমি মিনমিন করে বললাম – ডিমতো আমি চাই নাই। ওরা বললো — চাও নাই, তয় খাইছো কেন? কেন যে খেয়েছি তা খুলে বললে হাস্যকর শোনাবে ভেবে চেপে গেলাম। ত্রিশ টাকা পকেটে ঢুকিয়ে ভগ্নহৃদয়ে বাসের খবর নিতে এগোলাম। কাউন্টারে এসে শুনলাম, বাস এসে যাত্রী নিয়ে চলে গেছে সেতো অনেকক্ষণ হলো! বুঝলাম, সামনের টেবিলের যাত্রী যখন ভাত ফেলে দৌড়েছিল, বাস এসেছিল তখনই। খবর শুনে পাথর হয়ে গেলাম। অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর!

৫.

গল্পের এখানেই শেষ নয়। বাকি ত্রিশ টাকা কীভাবে গচ্ছা গেল, সে ইতিহাস আরো করুণ! চুপচাপ কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে শোক একটু কাটালাম। এখন ফরিদপুর যাই কী করে?ঢাকা থেকে তরুণ ভাইজান (খালাতো বোনের বর) একটা চিঠি দিয়েছেন, সেটা ফরিদপুরে খালাতো বোনের কাছে পৌঁছাতে হবে। ওপার থেকে আসা যাত্রীদের নিয়ে সোহাগ পরিবহনের একটা বাস যাত্রা শুরু করেছে। আমি লাফ দিয়ে সেটায় উঠলাম। গেটে থাকা হেল্পার তেড়ে এলো — নামো, নামো, এটা পরিবহনের বাস। এই পর্যায়ে আমি কেঁদে ফেললাম। বললাম – আমার বাস ফেল করেছি, ফরিদপুরে যাবো কী করে? বাস তখন অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। আমার কান্না দেখে কিছু যাত্রীর এই “বালকের” প্রতি দয়া হলো। তারা বললেন – থাক, থাক। রাজবাড়ির রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিও। “ডাইরেক্ট” বাস বলে সুপারভাইজার আমার কাছে বিশ টাকা ভাড়া দাবি করলো। আমার অনুনয় বিনয় এবং দয়ার্দ্র যাত্রীদের সুপারিশে দশ টাকা দিয়ে পার পেলাম।

রাজবাড়ি রাস্তার মোড়ে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম খালার বাসা টেপাখোলার উদ্দেশ্যে। হোক অনেকটা পথ, কিন্তু বাকি বিশ টাকা আমি কিছুতেই খরচ করবো না।

বোনের কাছে চিঠি হস্তান্তর করে খেতে বসলাম। গরম ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল নিয়ে আসলেন খালাম্মা। তার মধ্যে ছোট একটুকরো ইলিশের ডিমও পাওয়া গেলো। খেতে খেতে আবার কান্না পেয়ে গেলো – কী দরকার ছিলো ঘাটে বসে ভাত খাওয়ার! একটু ধৈর্য্য ধরে খালার বাসায় পৌঁছালেইতো ইলিশের ডিম খেতে পারতাম! বাসটাও ফেল করতাম না!

খালার বাসায় খেয়ে, সামান্য জিরিয়ে বেরিয়ে পড়ি। তখন ফরিদপুর থেকে বোয়ালমারী যেতে হলে আগে মধুখালী পৌঁছাতে হতো, সেখান থেকে ট্রেনে বোয়ালমারী। আবারও হেঁটেই বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। এখন যেটাকে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড বলা হয়, তখন সেটাই ছিলো ফরিদপুরের মূল বাসস্ট্যান্ড। ছোট খালুজান তখন জেলা বাসমালিক সমিতির ক্লার্ক ছিলেন। তিনি আমাকে বাসে উঠিয়ে দিলেন। বিনা ভাড়ায় পৌঁছে গেলাম মধুখালী রেলগেটে। আমার পকেটে থাকা বিশ টাকা তখনও মৃদু উষ্ণতা ছড়াচ্ছে আমার দেহ মন জুড়ে। এই টাকা কীভাবে ছোট ভাইবোনকে দেখিয়ে গর্বের হাসি হাসবো, এ টাকায় কয়টা মালাই (আইসক্রিম), কয়টা লজেন্স, লেবেনচুষ পাওয়া যাবে এই হিসাব কষতে কষতে মধুখালী রেলস্টেশনে পৌঁছে যাই। এই লাইনের ট্রেন নিয়ে তখন কৌতুক প্রচলিত ছিল যে – “এক যাত্রী সকাল নয়টার ট্রেন ঠিক নয়টায়ই স্টেশনে চলে আসায় অবাক হয় স্টেশনমাস্টারকে বললেন যে, এই লাইনের ট্রেন এত সময় মেনে আসলো কীভাবে?! স্টেশনমাস্টার গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন, ওটা গতকাল সকাল নয়টার ট্রেন”। অর্থাৎ চব্বিশ ঘণ্টা লেট!

স্টেশনে খানিকটা ঘোরাঘুরি করে যাত্রীদের কথায় কান পেতে বোঝা গেলো, গতকাল যে ট্রেন ভাটিয়াপাড়া গেছে ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় সেটা আর কাল ফিরতে পারেনি। ইঞ্জিন মেরামত করে ফিরতি পথ ধরেছে ঘন্টাখানেক আগে। সে ট্রেন রাজবাড়ি পৌঁছে আবার যখন ফিরবে তখন সেটায় চড়ে আমার বোয়ালমারী আসতে হবে। অন্তত: ঘন্টা চারেক!

সময় কাটাতে আমি চলে গেলাম স্টেশন থেকে মাইলখানেক দূরে আমার বোনের বাড়িতে। ভরপেটেও সেখানে আবার খেতে হলো। বোনের ননদরা নিরীহ পেয়ে আমাকে অনেক “জ্বালালো”। ঘন্টা দুয়েক আমোদে কাটিয়ে স্টেশনের পথ ধরলাম। দুলাভাইও বের হলেন আমার সাথে, রেলগেটে তার কাজ আছে।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দুলাভাই বললেন – ভাই, খুব সংকটে আছি। তোমার কাছে টাকা থাকলে আমাকে দেও। আমি ঈদের সময় এসে দিয়ে দেবো। মিথ্যা বলা তখনও শিখিনি (এখন বলতে হয় অল্পবিস্তর)। তাই অকপটে আমার পকেটে থাকা বিশ টাকার কথা অকপটে স্বীকার করলাম এবং দুলাভাইয়ের বাড়িয়ে দেয়া হাতে সে টাকা হস্তান্তর করলাম।

সকালে পঞ্চাশ টাকার গর্বিত মালিক বিনা টিকেটের যাত্রী হয়ে সেদিন সন্ধ্যার খানিক পরে কপর্দকহীন অবস্থায় বোয়ালমারী রেলস্টেশনে পদার্পণ করলেন।

সেই ঈদ আজও আসেনি!


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ
error: Content is protected !!

ইলিশের ডিম নিয়ে একি ঝামেলা !

আপডেট টাইম : ১১:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
গাজী শাহিদুজ্জামান লিটন :

১.

ইলিশ মাছের ডিমের লোভে কি নাজেহালটাইনা হতে হয়েছিল সেবার!

এ ঘটনা ১৯৮৪ সালের। আমার এসএসসি রেজাল্টের পর মেজভাই গাজী কামরুজ্জামান টোকন আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন, ভালো কলেজে ভর্তি করবেন বলে। মেজভাই তখন পড়াশোনা করেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে (তেজগাঁওয়ে অবস্থিত)। টিউশনি করে প্রতি মাসে ভালোই আয় রোজগার করেন।

ঢাকা কলেজ আর নটরডেম কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। চান্স হলো না। ঢাকার অন্য কোনো সাধারণ কলেজে পড়ার চেয়ে বোয়ালমারীতে পড়াই উত্তম মনে হলো। এবার তাই বাড়ি ফেরার পালা।

একা একা কখনো বেশি দূরে যাইনি। মেজভাই তাই উদ্বুদ্ধ করলেন – আজ বাদে কাল কলেজে ভর্তি হচ্ছিস, এখন নিজের পায়ে চলতে হবে, একা একা বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে চলে যাওয়ার সাহস করতে হবে।

২.

দূরপাল্লার বাস তখন ছাড়ত গুলিস্তান কিংবা ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে। মেজভাই টিকেট কেটে আমাকে ফরিদপুরের ডাইরেক্ট বাসে উঠিয়ে দিলেন। আর হাতে দিলেন নগদ ৫০ টাকা। পঞ্চাশ টাকা তখন আমার কাছে অ নে ক টাকা!

বাস আমাদের আরিচা ঘাটে নামিয়ে দিল। সুপারভাইজার সব যাত্রীকে নিয়ে লঞ্চে উঠলেন। দৌলতদিয়ায় নেমে একই কোম্পানির বাসে তিনি আমাদের ফরিদপুর নিয়ে যাবেন।

দৌলতদিয়ায় নেমে জানা গেল , আমাদের এপারের বাস এখনও এসে পৌঁছায়নি। ফলে, যাত্রীরা পান, বিড়ি, চা, সিগারেট কিংবা হালকা নাস্তা খেতে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ল।

বাসস্ট্যান্ডের সাথেই সারি সারি ভাতের হোটেল। সব হোটেলের সামনেই একজন বা দুইজন কর্মচারী হেঁকে চলেছে – আসেন ভাই, আসেন। গরম ভাত, ইলিশ মাছ!

৩.

গরম ভাতের ধোঁয়া উড়ছে। তার সুঘ্রাণ নাসারন্ধ্রের ভিতর দিয়ে সারা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যাচ্ছে। ভাতের ঘ্রাণের চেয়ে সুগন্ধি পৃথিবীতে আর কীইবা আছে!
বাস আসতে যেহেতু দেরি হবে, এই অবস্থায় ভাতের আহ্বানকে অবহেলা করা রীতিমত অন্যায় হবে ভেবে ঢুকে পড়লাম নিকটতম “ধোঁয়া উড়া” ভাতের হোটেলে। ঠকে যাওয়ার ভয়ে দাম জেনে নিলাম আগেই – ইলিশ মাছ ৮ টাকা পিস, ভাত প্রতি প্লেট দুই টাকা।
আমি এক প্লেট ভাত আর এক পিস ইলিশ মাছের অর্ডার দিলাম। ওদের অনুরোধ করলাম, বাস আসলে যেন আমাকে ডেকে দেয়। ম্যানেজার ও একজন ওয়েটার এ বিষয়ে আমাকে জোরালোভাবে আশ্বস্ত করলেন, বললেন – তুমি নিশ্চিন্ত মনে খাও।

ভাত এলো। এলো বেগুন–আলু–ইলিশ মাছের ঝোল। আর সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয়, মাছের সাথে ওরা ইলিশের ডিমও দিয়েছে বড়সড় এক টুকরো। কত যে আনন্দ হলো! পদ্মাপাড়ের হোটেলগুলোতে এই তাহলে ব্যাপার! পদ্মার ইলিশের সাথে ইলিশের ডিমও মেলে ফাউ!

আয়েশ করে খাচ্ছি। কি যে স্বাদ! আমাদের বাসের আরেক যাত্রী সামনের টেবিলে বসে খাচ্ছিলেন। অর্ধেক খাবার রেখে হঠাৎ তিনি তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন। আমার হাসি পেল। এত তাড়াহুড়োর কি আছে? বাস আসলেতো এরা ডেকেই দেবে!

৪.

আমি আয়েশ করে খেয়ে, সাবান-পানি দিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে, ক্যাশ কাউন্টারের সামনে এসে, কেটে রাখা খবরের কাগজের টুকরো দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে ৫০ টাকার নোটখানা ক্যাশে বসা ম্যানেজার সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি নোটটা ক্যাশে রেখে আমাকে ত্রিশ টাকা ফেরত দিলেন। আমি আর দশ টাকার আশায় হাত বাড়িয়ে রাখলাম। কারণ, আমার হিসাবে বিল হয় ১০ টাকা। মাছ এক পিস ৮ টাকা, এক প্লেট ভাত ২ টাকা।

আমার হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে ম্যানেজার বললেন — কী ব্যাপার? আমি বললাম — আর দশ টাকা। বললেন – তোমার বিলতো হয়েছে কুড়ি টাকা। ভাত এক প্লেট দুই টাকা, মাছ আট টাকা, মাছের ডিম দশ টাকা। শুনে আমার বুক ধড়ফড় করে উঠলো, গলা গেলো শুকিয়ে। মুহূর্তে বুঝে গেলাম, পদ্মায় যত ইলিশই পাওয়া যাক, তার একটা আঁশও এখানে ফাউ পাওয়া যাবে না।

আমি মিনমিন করে বললাম – ডিমতো আমি চাই নাই। ওরা বললো — চাও নাই, তয় খাইছো কেন? কেন যে খেয়েছি তা খুলে বললে হাস্যকর শোনাবে ভেবে চেপে গেলাম। ত্রিশ টাকা পকেটে ঢুকিয়ে ভগ্নহৃদয়ে বাসের খবর নিতে এগোলাম। কাউন্টারে এসে শুনলাম, বাস এসে যাত্রী নিয়ে চলে গেছে সেতো অনেকক্ষণ হলো! বুঝলাম, সামনের টেবিলের যাত্রী যখন ভাত ফেলে দৌড়েছিল, বাস এসেছিল তখনই। খবর শুনে পাথর হয়ে গেলাম। অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর!

৫.

গল্পের এখানেই শেষ নয়। বাকি ত্রিশ টাকা কীভাবে গচ্ছা গেল, সে ইতিহাস আরো করুণ! চুপচাপ কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে শোক একটু কাটালাম। এখন ফরিদপুর যাই কী করে?ঢাকা থেকে তরুণ ভাইজান (খালাতো বোনের বর) একটা চিঠি দিয়েছেন, সেটা ফরিদপুরে খালাতো বোনের কাছে পৌঁছাতে হবে। ওপার থেকে আসা যাত্রীদের নিয়ে সোহাগ পরিবহনের একটা বাস যাত্রা শুরু করেছে। আমি লাফ দিয়ে সেটায় উঠলাম। গেটে থাকা হেল্পার তেড়ে এলো — নামো, নামো, এটা পরিবহনের বাস। এই পর্যায়ে আমি কেঁদে ফেললাম। বললাম – আমার বাস ফেল করেছি, ফরিদপুরে যাবো কী করে? বাস তখন অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। আমার কান্না দেখে কিছু যাত্রীর এই “বালকের” প্রতি দয়া হলো। তারা বললেন – থাক, থাক। রাজবাড়ির রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিও। “ডাইরেক্ট” বাস বলে সুপারভাইজার আমার কাছে বিশ টাকা ভাড়া দাবি করলো। আমার অনুনয় বিনয় এবং দয়ার্দ্র যাত্রীদের সুপারিশে দশ টাকা দিয়ে পার পেলাম।

রাজবাড়ি রাস্তার মোড়ে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম খালার বাসা টেপাখোলার উদ্দেশ্যে। হোক অনেকটা পথ, কিন্তু বাকি বিশ টাকা আমি কিছুতেই খরচ করবো না।

বোনের কাছে চিঠি হস্তান্তর করে খেতে বসলাম। গরম ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল নিয়ে আসলেন খালাম্মা। তার মধ্যে ছোট একটুকরো ইলিশের ডিমও পাওয়া গেলো। খেতে খেতে আবার কান্না পেয়ে গেলো – কী দরকার ছিলো ঘাটে বসে ভাত খাওয়ার! একটু ধৈর্য্য ধরে খালার বাসায় পৌঁছালেইতো ইলিশের ডিম খেতে পারতাম! বাসটাও ফেল করতাম না!

খালার বাসায় খেয়ে, সামান্য জিরিয়ে বেরিয়ে পড়ি। তখন ফরিদপুর থেকে বোয়ালমারী যেতে হলে আগে মধুখালী পৌঁছাতে হতো, সেখান থেকে ট্রেনে বোয়ালমারী। আবারও হেঁটেই বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। এখন যেটাকে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড বলা হয়, তখন সেটাই ছিলো ফরিদপুরের মূল বাসস্ট্যান্ড। ছোট খালুজান তখন জেলা বাসমালিক সমিতির ক্লার্ক ছিলেন। তিনি আমাকে বাসে উঠিয়ে দিলেন। বিনা ভাড়ায় পৌঁছে গেলাম মধুখালী রেলগেটে। আমার পকেটে থাকা বিশ টাকা তখনও মৃদু উষ্ণতা ছড়াচ্ছে আমার দেহ মন জুড়ে। এই টাকা কীভাবে ছোট ভাইবোনকে দেখিয়ে গর্বের হাসি হাসবো, এ টাকায় কয়টা মালাই (আইসক্রিম), কয়টা লজেন্স, লেবেনচুষ পাওয়া যাবে এই হিসাব কষতে কষতে মধুখালী রেলস্টেশনে পৌঁছে যাই। এই লাইনের ট্রেন নিয়ে তখন কৌতুক প্রচলিত ছিল যে – “এক যাত্রী সকাল নয়টার ট্রেন ঠিক নয়টায়ই স্টেশনে চলে আসায় অবাক হয় স্টেশনমাস্টারকে বললেন যে, এই লাইনের ট্রেন এত সময় মেনে আসলো কীভাবে?! স্টেশনমাস্টার গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন, ওটা গতকাল সকাল নয়টার ট্রেন”। অর্থাৎ চব্বিশ ঘণ্টা লেট!

স্টেশনে খানিকটা ঘোরাঘুরি করে যাত্রীদের কথায় কান পেতে বোঝা গেলো, গতকাল যে ট্রেন ভাটিয়াপাড়া গেছে ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় সেটা আর কাল ফিরতে পারেনি। ইঞ্জিন মেরামত করে ফিরতি পথ ধরেছে ঘন্টাখানেক আগে। সে ট্রেন রাজবাড়ি পৌঁছে আবার যখন ফিরবে তখন সেটায় চড়ে আমার বোয়ালমারী আসতে হবে। অন্তত: ঘন্টা চারেক!

সময় কাটাতে আমি চলে গেলাম স্টেশন থেকে মাইলখানেক দূরে আমার বোনের বাড়িতে। ভরপেটেও সেখানে আবার খেতে হলো। বোনের ননদরা নিরীহ পেয়ে আমাকে অনেক “জ্বালালো”। ঘন্টা দুয়েক আমোদে কাটিয়ে স্টেশনের পথ ধরলাম। দুলাভাইও বের হলেন আমার সাথে, রেলগেটে তার কাজ আছে।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দুলাভাই বললেন – ভাই, খুব সংকটে আছি। তোমার কাছে টাকা থাকলে আমাকে দেও। আমি ঈদের সময় এসে দিয়ে দেবো। মিথ্যা বলা তখনও শিখিনি (এখন বলতে হয় অল্পবিস্তর)। তাই অকপটে আমার পকেটে থাকা বিশ টাকার কথা অকপটে স্বীকার করলাম এবং দুলাভাইয়ের বাড়িয়ে দেয়া হাতে সে টাকা হস্তান্তর করলাম।

সকালে পঞ্চাশ টাকার গর্বিত মালিক বিনা টিকেটের যাত্রী হয়ে সেদিন সন্ধ্যার খানিক পরে কপর্দকহীন অবস্থায় বোয়ালমারী রেলস্টেশনে পদার্পণ করলেন।

সেই ঈদ আজও আসেনি!


প্রিন্ট