মিনা আপা পড়েন কলেজে, বি.এ. প্রথম বর্ষ। আমি ক্লাস এইটে। আমরা তখন ঢাকায় থাকি। বাসা খিলগাঁও বাগিচায়। আব্বা (মতিঝিল) পোস্ট অফিস হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। এটা ১৯৮০/৮১ সালের কথা।
বাগিচায় মিনা আপা আর আমাদের বাসা পাশাপাশি। আমরা ছোটরা মাঝেমধ্যেই মিনা আপাদের বাসায় ঢুঁ মারি। কারণ, সেখানে কখনো সখনো চকলেট, বিস্কুট এমন কি চানাচুরও মেলে! মিনা আপারাও আমাদের বাসায় আসেন, কালেভদ্রে।
সেদিন স্কুল বন্ধ। বেলা তখন এগারোটা বা সাড়ে এগারোটা হবে। ভাবলাম, যাই একটু মিনা আপাদের বাসায় ঢুঁ মেরে আসি।
আমাকে দেখে আপা আজ যেন একটু বেশিই খুশি হলেন। আমাকে বসতে বলে পিরিচে সেমাই নিয়ে আসলেন। বেশ স্বাদ সেমাইয়ের।
আমার খাওয়া শেষ হলে আপা একটা টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন – ভাই, আমাকে একটু লতি এনে দেও, রান্না করবো। টাকাটা হাতে নিয়ে আমি চিন্তা করতে লাগলাম — লতি কাকে বলে আর তা পাওয়াই বা যাবে কোথায়?
আমি লতি চিনি না — এ কথা মিনা আপাকে বলতে আমার “পৌরুষে” বাধলো। আপা আমাকে জানেন বুদ্ধিমান , ভালো ছাত্র হিসাবে। লতি চিনি না বললে চিরতরে আপার কাছে “ছোট” হয়ে যাবো। এমন ছোট হওয়ার ঝুঁকি কিছুতেই নেয়া যাবে না! চিন্তিত মনে, ম্লান মুখে তাই পথে নামলাম।
প্রথমে সামনে পড়লো পাড়ার মুদি দোকান। আমাদের বাসার কয়েকটি বাসা পরেই দোকানটি। এ দোকানে লতির কথা জিজ্ঞেস করবো কিনা ভাবতে ভাবতে দোকানটি পেরিয়ে এলাম। কারণ, মন যুক্তি দেখালো — এত কাছের দোকানে যদি লতি পাওয়া যেত, তবে আপা৷ নিজেই এখানে এসে নিয়ে যেতেন।
পরের দোকানপাটগুলো কিছুটা দূরে, শাহজানপুরের শুরুতে। সে দোকানগুলোরও প্রথমটা মুদি দোকান। সাহস সঞ্চয় করে দোকানীর কাছে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম — ভাই, লতি আছে? দোকানী বললেন — আছেতো। ওই যে লতি। বলে লাটিম ঘুরানোর লতি দেখিয়ে দিলেন। ভাবলাম, এ লতিতো রেঁধে খাওয়া যায় না। আবার চুলার জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করলেইবা কতটুকু সময় জ্বলবে? তা ছাড়া মিনা আপাদেরতো গ্যাসের চুলা। তাই সিদ্ধান্তে আসলাম, আপা এ লতি নিতে বলেননি। ফলে না-সূচক মাথা নেড়ে আমি এগিয়ে গেলাম।
এরপর পড়লো একটা হোটেল। সেখানে আমার প্রশ্নের জবাবে বলা হলো — লতি নাই। গুড়ো মাছের চচ্চড়ি, রুই মাছ, খাসির মাংস আছে। কিন্তু ওসবতো আপা নিতে বলেননি, ভেবে এগোতে লাগলাম।
সিদ্ধান্ত নিলাম, লতি যে চিনি না এটা এবার স্বীকার করতে হবে। অচেনা লোকদের কাছে স্বীকার করলে মানসম্মানের “ততটা” ক্ষতি হবে না! সিদ্ধান্ত নিতে নিতে সামনে পড়লো এক সাইনবোর্ডহীন জুয়েলার্স। আমি ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম – লতি কোথায় পাওয়া যাবে, বলতে পারেন? স্বর্ণশিল্পী আমার মূর্খতায় অবাক হয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। বললেন – লতি এখানে পাওয়া যায় না! বলে মাথা নিচু করে আবার কাজে মন দিলেন। আমি মন খারাপ করে বেরিয়ে আসলাম।
পরের দোকানটা বইয়ের। শুনেছি, যারা বই পড়েন তাদের হৃদয় নাকি কোমল হয়। সেই ফর্মুলা অনুসারে অনুসিদ্ধান্তে আসলাম — বই যারা বিক্রি করেন, তাদের হৃদয়তো অন্তত বইপাঠকের অর্ধেক কোমল হবে!
আশায় বুক বেঁধে তাই বইয়ের দোকানে ঢুকলাম। সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – ভাই, লতি পাওয়া যায় কোথায়? তিনি বললেন – কীসের লতি? মিনা আপার কথামতো আমি বললাম – রান্না করার। বইয়ের দোকানী দু’ সেকেন্ড ভেবে বললেন – খিলগাঁও বাজারে চলে যাও। মনের বল একটু বাড়লো। যা হোক একটা ঠিকানাতো পাওয়া গেছে।
আমি হাঁটার গতি দ্বিগুণ করে অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম খিলগাঁও বাজারে। বাজারের প্রবেশমুখেই ঝোলা গুড়ের দোকান। কোলায় ঝোলা গুড় নিয়ে ডানে বামে বসে আছেন চারজন বিক্রেতা। তাদের একজনের কাছে জানতে চাইলাম – ভাই, লতি পাওয়া যায় কোথায়? তিনি বললেন – সামনের তরিতরকারির দোকানে চলে যাও। ঠিকানা এবার আরো স্পষ্ট হলো।
আমি সব্জীর দোকানে যেয়ে সব্জীর দিকে না তাকিয়ে দোকানীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি – ভাই, লতি আছে? প্রথম দোকানী বললেন – না। দ্বিতীয় দোকানী বললেন – এইতো লতি। বলে তিনি যেদিকে তর্জনী নির্দেশ করলেন , দেখলাম সেখানে রাখা কয়েক মুঠি “কচুর বও”। অমনি আমার ঝাঁ করে মনে পড়ে গেলো আব্বার (গাজী খোরশেদুজ্জামান) লেখা লিমেরিক —
“আগুন! আগুন! কোথায় আগুন? কিসে আগুন?
আটা, চাউল, গোস্ত এবং ফিশে আগুন!
কচুর লতি, চৈতা বাগুন,
কলার মোচা, তাতেও আগুন!
বিষ খেয়ে যে মরবো তা সে বিষেও আগুন!”
মিনা আপা যদি কচুর লতি বলে দিতেন, তবেতো আগেই চিনতে পারতাম। শুধু লতি বলাতেইতো এই বিপত্তি! দোষ কী আমার একার?