বিশ্বের ১১৭ দেশে এখন পর্যন্ত বিনামূল্যে ৬৯ কোটির কাছাকাছি সংখ্যক ডোজ কভিড-১৯-এর টিকা সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে বাংলাদেশ। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশকে মোট ১১ কোটি ৪৫ লাখ ৭০ হাজার ৮২০ ডোজ টিকা বিনামূল্যে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ টিকা অনুদানের পুরোটাই এসেছে কোভ্যাক্সের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশকে বিনামূল্যে দেয়া মার্কিন টিকার অধিকাংশই ফাইজারের-১০ কোটি ৮৩ লাখ ৯১ হাজার ডোজ। মডার্নার টিকা এসেছে ৫৫ লাখ ডোজের কিছু বেশি। জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা এসেছে ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৭৫০ ডোজ।
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে চুক্তির ভিত্তিতে এসব টিকা ক্রয় করছে মার্কিন সরকার। এর মধ্যে ফাইজার ও মডার্নার কাছ থেকে কেনা টিকার ভারযুক্ত গড় মূল্য ডোজপ্রতি ২০ ডলার ৬৯ সেন্ট। নিউইয়র্কভিত্তিক স্বাস্থ্য তথ্যসেবা প্রতিষ্ঠান মেডপেজ টুডে প্রকাশিত এ তথ্য বিবেচনায় নিলে দেশটি থেকে পাওয়া ফাইজার ও মডার্নার টিকার মোট মূল্য দাঁড়ায় ২৩৫ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের কিছু বেশিতে। আরেক হিসাব অনুযায়ী, জনসন অ্যান্ড জনসনের বাজারজাতকৃত জেনসেন ভ্যাকসিনের প্রতি ডোজের গড় মূল্য ১০ ডলারের কাছাকাছি। এ হিসাবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা এসেছে ৬৫ লাখ ডলারের কাছাকাছি মূল্যের। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অন্তত ২৩৬ কোটি ডলার মূল্যের কভিড-১৯ টিকা অনুদান হিসেবে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় এ অংক দাঁড়ায় ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশিতে।
তবে টিকা প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো এখন ভ্যাকসিনের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এর মধ্যে টিকা উত্পাদনকারী কোম্পানি ফাইজারের সঙ্গে গত বছরের জুনে সর্বশেষ ক্রয় চুক্তি সই করে মার্কিন সরকার। এতে প্রতি ডোজ ফাইজারের টিকার মূল্য আগের দুই বছরের চেয়ে বাড়িয়ে ধরা হয় ৩০ ডলার ৪৮ সেন্ট। এর আগে ২০২১ ও ২০২০ সালের জুলাইয়ের চুক্তিতে এ টিকার মূল্য নির্ধারণ হয়েছিল যথাক্রমে ২৪ ডলার ও ১৯ ডলার ৫০ সেন্ট। গত বছরের অক্টোবরে টিকার দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে প্রতি ডোজ ১১০ থেকে ১৩০ ডলারে নির্ধারণ করার পরিকল্পনার কথা জানায় ফাইজার। সর্বশেষ মডার্নাও গত মাসে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের দাম বর্তমানের ২৬ ডলার থেকে ১৩০ ডলারে নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
দেশে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি ব্যবস্থার বিপর্যয়ের মধ্যে গোটা বিশ্বে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে করোনার ভ্যাকসিন। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে কভিডের টিকা হয়ে ওঠে বড় এক কূটনৈতিক হাতিয়ার।
দক্ষিণ এশিয়ায় টিকাকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতাটি শুরুতে দৃশ্যমান ছিল শুধু ভারত ও চীনের মধ্যে। এর মধ্যে ভারতকে ঘিরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর আশা-ভরসা ছিল সবচেয়ে বেশি। ভারতের টিকা উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট এসব দেশে সুলভে সরবরাহের শর্তে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উত্পাদনের লাইসেন্স নিয়েছিল। এর বাইরেও দেশগুলোর টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গঠিত কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিতেও টিকা সরবরাহের কথা ছিল ভারতের।
এ অনুযায়ী ২০২১ সালের শুরুর দিকে বিভিন্ন দেশে বিনামূল্যে টিকা উপহার দেয়া শুরু করে ভারত। বিশ্বব্যাপী দেশটির একধরনের ইতিবাচক ভাবমূর্তিও তৈরি হয়। কিন্তু করোনার নিত্যনতুন ধরন ও একের পর এক সংক্রমণ প্রবাহে গোটা বিশ্বে মহামারী পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে চলে যায়। বিশেষ করে ভারতে সংক্রমণ বেশ মারাত্মক আকার ধারণ করে। কাঁচামাল সংকটসহ বিভিন্ন কারণে স্থানীয় চাহিদা পূরণই প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে সেরাম ইনস্টিটিউটের জন্য। এ অবস্থায় টিকা রফতানিতে কিছুদিনের জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করে ভারত। বিপাকে পড়ে যায় এ অঞ্চলে টিকার জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া দেশগুলো।
এ অবস্থায় বাংলাদেশসহ দেশে দেশে টিকার সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে কূটনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর প্রয়াস নিতে থাকে চীন। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও বেইজিংয়ের সরবরাহ করা ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভরতা বাড়ে বাংলাদেশের। যদিও কিছুদিনের মধ্যেই টিকার জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। একপর্যায়ে বাংলাদেশও হয়ে ওঠে মার্কিন টিকা অনুদানের সবচেয়ে বড় গন্তব্যস্থল।
২০২২ সালের নভেম্বরের শুরুর দিকে দেশে মার্কিন টিকা অনুদানের পরিমাণ ১০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। সে সময় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস নারায়ণগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘এই মাইলফলক আমাদের দুই দেশের মধ্যকার শক্তিশালী অংশীদারত্বের গুরুত্ব তুলে ধরে। বাংলাদেশ তার প্রায় ৭৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে যে দুর্দান্ত অগ্রগতি দেখিয়েছে, এটি তার একটি অংশ মাত্র। এটি এক অসাধারণ অর্জন।’
শুধু টিকা নয়, করোনার সময় আরো নানাভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউএসএআইডির তথ্য অনুযায়ী, মহামারী মোকাবেলায় বাংলাদেশকে প্রায় ১৪ কোটি ডলারের সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে ৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার এসেছে ইউএসএআইডির মাধ্যমে উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তা হিসেবে। দেশে করোনার টিকাদান কার্যক্রম, ডায়াগনস্টিক ও ল্যাবরেটরি সক্ষমতা বৃদ্ধি, সরবরাহ চেইন ও লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ মহামারী মোকাবেলায় ইউএসএআইডি সহায়তা করেছে বলে সংস্থাটির সাম্প্রতিক এক ফ্যাক্টশিটে উঠে এসেছে।
মহামারীকালীন ব্যবস্থাপনা ও কর্মসূচির সফলতার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র টিকা সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে বলে দাবি করছেন স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি রোল মডেল। করোনা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা ভালো করেছি। যুক্তরাষ্ট্রসহ যারা আমাদের টিকা উপহার দিয়েছে, তারা বিবেচনা করেছে আমরা সেগুলো প্রান্তিক পর্যায়ে সঠিক তাপমাত্রায় পৌঁছে দিতে পারব কিনা। বিশেষ করে ফাইজারের টিকা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ, পরিবহন ও প্রয়োগ করতে হয়। আমরা প্রান্তিক পর্যায়েও সে টিকা সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছি। টিকা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের সব কার্যক্রম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ও গাইডলাইন অনুযায়ী করা হয়েছে। এবং তারা আমাদের সে কার্যক্রমের প্রশংসাও করে। এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ যারা আমাদের উপহার দিয়েছে, তারা যখন দেখল আমরা এগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারছি, তখন তারা আমাদের আরো উপহার দিল।’
মহামারী শুরুর পর থেকেই অ্যান্তনিও ফাউসিসহ মার্কিন জনস্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারকদের সুপারিশ ছিল, মার্কিন টিকার বণ্টন যাতে ভূরাজনীতিনির্ভর হয়ে না ওঠে। এছাড়া যেসব দেশে মার্কিন নাগরিকদের উপস্থিতি এবং আসা-যাওয়া বেশি, অনুদানের ক্ষেত্রে সেসব জায়গাকে প্রাধান্য দেয়ার কথাও হয়েছে অনেক। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতো বিনামূল্যে টিকা সরবরাহের বিষয়টিতে অনুমোদন ছিল সাধারণ মার্কিন নাগরিকদেরও। ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত এক জরিপে অংশগ্রহণকারী মার্কিন নাগরিকদের ৮০ শতাংশেরও বেশি তুলনামূলক কম আয়ের দেশগুলোয় বিনামূল্যে টিকা সরবরাহের বিষয়টিকে সমর্থন করেছিলেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভ্যাকসিন কূটনীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এসব সুপারিশ ও দাবিকে আমলে নিয়েছে। যেসব দেশে মার্কিন নাগরিকদের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বিদেশীর সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, সেগুলোয় অধিক সংখ্যক টিকা পাঠিয়েছে ওয়াশিংটন। আবার তুলনামূলক কম আয়ের দেশগুলোকেও বিনামূল্যে টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর ডিভিশন অব সোস্যাল সায়েন্সেসের বিশেষজ্ঞ মিন বিয়ুং চায়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনেও বিষয়গুলোর সমর্থন পাওয়া যায়। কভিডকালে বিভিন্ন দেশে মার্কিন টিকা অনুদান ও সহায়তা নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কভিত্তিক সোস্যাল সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্কে (এসএসআরএন) গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে উঠে আসে, যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত গ্রহীতা এবং নিজের মিত্র দেশগুলোর প্রয়োজনের ভিত্তিতেই টিকা সহায়তা দিয়েছে।
মার্কিন টিকা সরবরাহে বাংলাদেশের প্রাধান্য পাওয়ার ক্ষেত্রে এশিয়া অঞ্চলের প্রতি দেশটির বাড়তি মনোযোগ এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল হিসেবে ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক সম্ভাবনার মতো বিষয়গুলোও বড় ভূমিকা রেখেছে বলে অভিমত কূটনীতিক মহলের। তবে এক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘করোনাকালে মার্কিন টিকার সবচেয়ে বড় গন্তব্য হওয়ার বিষয়টি আমার কাছে একদমই স্বাভাবিক মনে হয়। কৃষির আধুনিকায়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ নানা বিষয়ে তারা আমাদের সহায়তা করছে। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে পাঁচ শতাধিক আশ্রয় কেন্দ্র শেল্টার আছে। সেগুলো তো কোনো কারণ ছাড়াই করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের নানামুখী কার্যক্রম রয়েছে। দ্বিপক্ষীয়ভাবেও নিরাপত্তা, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের জায়গাগুলো আমাদের মধ্যে রয়েছে। কাজেই সেদিক থেকেও আমরা অর্থনৈতিকভাবে তাদের সহযোগিতা পেয়ে আসছি। এখন এশিয়া অঞ্চলের প্রতি তাদের একটু নজর বেশি। তার মধ্যে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পাশে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, এটা তারাও বলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেয়া বক্তব্যে জো বাইডেনও এ কথা গুরুত্বের সঙ্গে বলেছেন। এছাড়া দক্ষিণ এ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগ পয়েন্ট হিসেবেও তাদের আমাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর একটি সুযোগ রয়েছে।’
প্রিন্ট