মোঃ আলম মৃধাঃ
নরসিংদীতে গত বছরের জুলাই মাসে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন দুই ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অনির্বাণ চৌধুরী এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সাইফুল ইসলাম। তবে এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা হিসেবে যাঁদের নাম উঠে আসছে, তাঁরা এখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা হলেন তৎকালীন পুলিশ সুপার মুস্তাফিজুর রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ডিবির ওসি খোকন চন্দ্র সরকার।
.
বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ১৮ জুলাইয়ের সেই বিভীষিকাময় দিনে পুলিশ সুপার মুস্তাফিজুর রহমানের সরাসরি নির্দেশে ও নেতৃত্বে সংঘটিত হয় রক্তাক্ত এই অভিযান। সকাল থেকে বেলা পর্যন্ত রাঁধুনি হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে জেলখানার মোড় পর্যন্ত এলাকায় কয়েক দফা গুলিবর্ষণ চলে। দুপুরবেলা এই অভিযানের নেতৃত্বে আসেন এসপি মোস্তাফিজুর রহমান এবং তিনি সরাসরি গুলি করার নির্দেশ দেন। এখানে কোন ম্যাজিস্ট্রেট ছিল না। গুলি করার মত তেমন কোন পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। পুলিশ ছাত্রদের চলে যেতে বলেন,ছাত্ররা না গেলে তিনি রাগান্বিত হয়ে গুলি করার নির্দেশ দেন বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী নিশ্চিত করেন। পরে আবার জেলখানার মোড় থেকে রাঁধুনীতে ফিরে এসে পুনরায় নির্বিচারে গুলি ছোঁড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
.
সূত্রমতে, অভিযানে খরচ হয় প্রায় ১২০০ থেকে ১৫০০ রাউন্ড গুলি। গুলির শিকার হন শত শত সাধারণ মানুষ, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী ও স্থানীয় পথচারী। ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় নবম শ্রেণির ছাত্র তাহমিদ ভূঁইয়া তামিম (১৫)। তার মৃত্যুতে উত্তাল হয়ে উঠে পুরো জেলা। পরে তামিমের লাশ স্ট্রেচারে করে ডিসি রোডে রেখে প্রতিবাদ জানাতে গেলে আবারো পুলিশের গুলি চলে।
.
তৎকালীন এসপি মুস্তাফিজ নিজেই উপস্থিত থেকে এই অভিযান পরিচালনা করেন বলে জানায় একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী। একই সঙ্গে ডিবির ওসি খোকন চন্দ্র সরকার ছিলেন তার ছায়াসঙ্গী হিসেবে। আন্দোলনকারীদের দাবি, কাঁঠালি কালার গেঞ্জি পরা ছাত্র সমন্বয়ককে চিহ্নিত করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এসপির নির্দেশেই। হত্যাকাণ্ডের আগে ওই ছাত্রের সাথে কয়েকবার কথাও বলেন এসপি।
.
এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ২০ জন ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করছে জুলাই আন্দোলনের নেতারা। আহত হয়েছেন শতাধিক বেশি। অথচ মূল দুই অভিযুক্ত—মুস্তাফিজুর রহমান ও খোকন সরকার—তদন্ত ও বিচারের আওতার বাইরে থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। একটি গোপন সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে তারা ভারত পালিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন।
.
জুলাই আন্দোলনের পক্ষে মুখপাত্ররা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যে এসপি নিজ হাতে এই গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি আজও অধরা! এটা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। যতদিন না এই দুই খুনিকে গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হবে, ততদিন আমাদের আন্দোলন চলবে।”
.
এ বিষয়ে পুলিশ সুপারের ও ডিবির ওসি খোকনের মোবাইল নাম্বারে ফোন দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে মেসেজ পাঠিয়ে তাদের বক্তব্য চাইলে তারা মেসেজের উত্তর করেননি।
.
নরসিংদীর মানুষ এখনো সেই রক্তাক্ত স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি ভেঙে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে সারা দেশের সচেতন নাগরিকসমাজ।
প্রিন্ট