ঢাকা , রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

বিরহের সুরে ভাঙলো কুষ্টিয়ার ‘সাধুর হাট’

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, ফকির লালন কয় জাতের কিরূপ দেখলামনা এ সংসারে…ডুবলে পারে রতনপাবি, বাউল সাঁইজির এসব আধ্যাত্মিক গানের সুরে গত তিন দিন মজে ছিল বাউল-সাধুরা ছেউড়িয়া আখড়াবাড়ি। বিরহের সুরে শেষ হলো মরমী সাধক ফকির লালন শাহের ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণ উৎসব।

 

বাউলের শিরোমণি ফকির লালন শাহের তীর্থভূমি কুষ্টিয়ার ছেউঁড়িয়াস্থ লালন আখড়ায় শনিবার রাতে ভাঙলো সাধুর হাট। লাখো জনতার ঢলে মুখরিত লালন আখড়ায় বেজে উঠেছে বিদায়ের সুর। শনিবার (১৯ অক্টোবর) সমাপনী অনুষ্ঠান শেষে বাউল-সাধুরা ফিরে গেছেন নিজ নিজ আশ্রমে। ভাব জগতের মরমী গান, ভাবের আদান-প্রদান, গুরু ভক্তি, সাধুসঙ্গ ও জমকালো সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে তিনদিনের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।

 

এর আগে, গতকাল দুপুরে পূর্ণ সেবার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে সাধু সংঘ। সাধু সংঘ শেষ হলেও আত্মার তৃপ্তি মেটাতে এখনও অনেক অনুসারী থেকে গেছেন আখড়াবাড়িতে।

 

একতারা, দোতারা আর ঢোল-বাঁশির সুরে প্রকম্পিত হয়ে ওঠা ভবের হাটের সাধুসংঘ শেষ হয়েছে। আখড়াবাড়ি ছাড়ছেন লালন অনুসারী ও সাধুরা। মহামানবের দর্শন, নিজেকে চেনা, অজানাকে জানার জন্য কয়েক দিন ধরে অবস্থান নেওয়া সাধু ভক্তরা বলছেন, অর্জিত লালন শিক্ষা নিজের ও পৃথিবীর শান্তির পথ হবে।

 

সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ। বিশেষ অতিথি ছিলেন খুলনা রেঞ্জের পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি জয়দেব কুমার ভদ্র, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) ৪৭-ব্যাটালিয়ন কুষ্টিয়ার অধিনায়ক মো. মাহবুব মোর্শেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, ছাত্র-জনতা প্রতিনিধি মোজাক্কির রহমান রাব্বি ও মো. সাজেদুর রহমান। প্রধান আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক অ্যাডভোকেট লালিম হক। সভায় সভাপতিত্ব করেন কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোছা. শারমিন আখতার।

 

বক্তারা বলেন, লালনের ফকিরের আধ্যাত্মিকতা ও দর্শন নিয়ে দেশ-বিদেশে গবেষণা হচ্ছে। ফকির লালন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। আত্মপরিচয়ে তিনি ছিলেন নীরব। লালনের প্রধান কীর্তি হচ্ছে তাঁর গানের কথা ও সুর। তিনি জাত-পাতের ঊর্ধ্বে গানের মাধ্যমে মানব প্রেম ও মানবতার জয়গান গেয়ে গেছেন। সমাজের সকল অনাচার ও বৈষম্য দূরীকরণে লালনের অহিংস বানী ছড়িয়ে দেওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন বক্তারা।

 

আব্দুল গাফ্ফার না‌মে এক দর্শনার্থী বলেন, লালনের গানে মানবতা বোধ, অহিংস ভাব ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে দিন দিন তার গানের ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। লালন সাঁইজির এ আদর্শ অনুসরণ করলে দেশে বর্তমান হানাহানি বন্ধ হয়ে যেত ব‌লে ম‌নে ক‌রেন তি‌নি।

 

নবীন-প্রবীণ বাউল শিল্পীদের পরিবেশনায় লালনের অসংখ্য হৃদয়গ্রাহী ও মনোমুগ্ধকর গান রাতভর পরিবেশিত হয়। এছাড়া মরা কালি নদীর পাড়ে বাউলদের খন্ড গানের জলসা দর্শক-শ্রোতারা ঘুরে ঘুরে উপভোগ করেন।

এর আগে প্রায় সাত হাজার বাউল ফকিরকে রাতের খাবার খিচুড়ি (অধিবাস) সকালের নাস্তা (বাল্যসেবা) পায়েস ও মুড়ি এবং দুপুরের খাবার (পূন্যসেবা) সাদা ভাত, ডাল ও সবজি খাবার দেওয়া হয়। পরে দধি দিয়ে মিষ্টিমুখ করানো হয় বাউল ও অতিথিদের। আঁখড়া বাড়িতে তিন বেলার খাবার গ্রহন বাউল-সাধুদের আচার অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষন ও পরমাত্মার পরম শান্তির অনন্য পরশ।

মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার কুমারীডাঙ্গা গ্রামের বাউল ফকির জসিম উদ্দীন জানান, লালনের মৃত্যুবার্ষিকী ও দোল পূর্ণিমার তিথিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাঁইজির মাজারে ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য মনের টানে ছুটে আসেন লালন আখড়ায়। ফকির লালনের দর্শন ও তার নির্দেশিত পথ অনুসরণের মাধ্যমে আত্মার প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব বলে তিনি জানান।

 

 

এবারও দেশ-বিদেশের হাজার হাজার লালন ভক্ত-অনুসারীর মিলন ঘটে সাঁইজির ধামে। সাধুদের মিলনমেলাকে ঘিরে একাডেমির পাশে কালি নদীর ধারে গ্রাম্য মেলা চলছে বেশ জোরেশোরে। শুধু বাউল নয় লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে লালন মেলায়।
মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইজি ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় অবস্থিত লালন আখড়া বাড়িতে দেহ সংবরণ করেন। এ দিনটিকে তিরোধান দিবস বলা হয়। ভক্ত-শিষ্যরা দিনটি পালন করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। আজ ১৯ অক্টোবর শনিবার রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে মেলার সকল কার্যক্রম শেষ হয়।


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ
error: Content is protected !!

বিরহের সুরে ভাঙলো কুষ্টিয়ার ‘সাধুর হাট’

আপডেট টাইম : ১২:০১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ অক্টোবর ২০২৪
ইসমাইল হােসেন বাবু, ষ্টাফ রিপােটার :

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, ফকির লালন কয় জাতের কিরূপ দেখলামনা এ সংসারে…ডুবলে পারে রতনপাবি, বাউল সাঁইজির এসব আধ্যাত্মিক গানের সুরে গত তিন দিন মজে ছিল বাউল-সাধুরা ছেউড়িয়া আখড়াবাড়ি। বিরহের সুরে শেষ হলো মরমী সাধক ফকির লালন শাহের ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণ উৎসব।

 

বাউলের শিরোমণি ফকির লালন শাহের তীর্থভূমি কুষ্টিয়ার ছেউঁড়িয়াস্থ লালন আখড়ায় শনিবার রাতে ভাঙলো সাধুর হাট। লাখো জনতার ঢলে মুখরিত লালন আখড়ায় বেজে উঠেছে বিদায়ের সুর। শনিবার (১৯ অক্টোবর) সমাপনী অনুষ্ঠান শেষে বাউল-সাধুরা ফিরে গেছেন নিজ নিজ আশ্রমে। ভাব জগতের মরমী গান, ভাবের আদান-প্রদান, গুরু ভক্তি, সাধুসঙ্গ ও জমকালো সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে তিনদিনের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।

 

এর আগে, গতকাল দুপুরে পূর্ণ সেবার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে সাধু সংঘ। সাধু সংঘ শেষ হলেও আত্মার তৃপ্তি মেটাতে এখনও অনেক অনুসারী থেকে গেছেন আখড়াবাড়িতে।

 

একতারা, দোতারা আর ঢোল-বাঁশির সুরে প্রকম্পিত হয়ে ওঠা ভবের হাটের সাধুসংঘ শেষ হয়েছে। আখড়াবাড়ি ছাড়ছেন লালন অনুসারী ও সাধুরা। মহামানবের দর্শন, নিজেকে চেনা, অজানাকে জানার জন্য কয়েক দিন ধরে অবস্থান নেওয়া সাধু ভক্তরা বলছেন, অর্জিত লালন শিক্ষা নিজের ও পৃথিবীর শান্তির পথ হবে।

 

সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ। বিশেষ অতিথি ছিলেন খুলনা রেঞ্জের পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি জয়দেব কুমার ভদ্র, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) ৪৭-ব্যাটালিয়ন কুষ্টিয়ার অধিনায়ক মো. মাহবুব মোর্শেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, ছাত্র-জনতা প্রতিনিধি মোজাক্কির রহমান রাব্বি ও মো. সাজেদুর রহমান। প্রধান আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক অ্যাডভোকেট লালিম হক। সভায় সভাপতিত্ব করেন কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোছা. শারমিন আখতার।

 

বক্তারা বলেন, লালনের ফকিরের আধ্যাত্মিকতা ও দর্শন নিয়ে দেশ-বিদেশে গবেষণা হচ্ছে। ফকির লালন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। আত্মপরিচয়ে তিনি ছিলেন নীরব। লালনের প্রধান কীর্তি হচ্ছে তাঁর গানের কথা ও সুর। তিনি জাত-পাতের ঊর্ধ্বে গানের মাধ্যমে মানব প্রেম ও মানবতার জয়গান গেয়ে গেছেন। সমাজের সকল অনাচার ও বৈষম্য দূরীকরণে লালনের অহিংস বানী ছড়িয়ে দেওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন বক্তারা।

 

আব্দুল গাফ্ফার না‌মে এক দর্শনার্থী বলেন, লালনের গানে মানবতা বোধ, অহিংস ভাব ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে দিন দিন তার গানের ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। লালন সাঁইজির এ আদর্শ অনুসরণ করলে দেশে বর্তমান হানাহানি বন্ধ হয়ে যেত ব‌লে ম‌নে ক‌রেন তি‌নি।

 

নবীন-প্রবীণ বাউল শিল্পীদের পরিবেশনায় লালনের অসংখ্য হৃদয়গ্রাহী ও মনোমুগ্ধকর গান রাতভর পরিবেশিত হয়। এছাড়া মরা কালি নদীর পাড়ে বাউলদের খন্ড গানের জলসা দর্শক-শ্রোতারা ঘুরে ঘুরে উপভোগ করেন।

এর আগে প্রায় সাত হাজার বাউল ফকিরকে রাতের খাবার খিচুড়ি (অধিবাস) সকালের নাস্তা (বাল্যসেবা) পায়েস ও মুড়ি এবং দুপুরের খাবার (পূন্যসেবা) সাদা ভাত, ডাল ও সবজি খাবার দেওয়া হয়। পরে দধি দিয়ে মিষ্টিমুখ করানো হয় বাউল ও অতিথিদের। আঁখড়া বাড়িতে তিন বেলার খাবার গ্রহন বাউল-সাধুদের আচার অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষন ও পরমাত্মার পরম শান্তির অনন্য পরশ।

মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার কুমারীডাঙ্গা গ্রামের বাউল ফকির জসিম উদ্দীন জানান, লালনের মৃত্যুবার্ষিকী ও দোল পূর্ণিমার তিথিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাঁইজির মাজারে ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য মনের টানে ছুটে আসেন লালন আখড়ায়। ফকির লালনের দর্শন ও তার নির্দেশিত পথ অনুসরণের মাধ্যমে আত্মার প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব বলে তিনি জানান।

 

 

এবারও দেশ-বিদেশের হাজার হাজার লালন ভক্ত-অনুসারীর মিলন ঘটে সাঁইজির ধামে। সাধুদের মিলনমেলাকে ঘিরে একাডেমির পাশে কালি নদীর ধারে গ্রাম্য মেলা চলছে বেশ জোরেশোরে। শুধু বাউল নয় লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে লালন মেলায়।
মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইজি ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় অবস্থিত লালন আখড়া বাড়িতে দেহ সংবরণ করেন। এ দিনটিকে তিরোধান দিবস বলা হয়। ভক্ত-শিষ্যরা দিনটি পালন করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। আজ ১৯ অক্টোবর শনিবার রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে মেলার সকল কার্যক্রম শেষ হয়।


প্রিন্ট