মোঃ আরিফুল মিয়াঃ
ফরিদপুর সেনা ক্যাম্প এবং পুলিশের সমন্বয়ে পরিচালিত এক সফল অভিযানে দেশের অন্যতম বৃহৎ মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা ও আন্তর্জাতিক অর্থ পাচার চক্রের মূলহোতাসহ পাঁচ সক্রিয় সদস্যকে আটক করা হয়েছে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই সমন্বিত অভিযান পরিচালিত হয়।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি ফরিদপুর সেনা ক্যাম্পে একাধিক অভিযোগ জমা পড়ে যেখানে ভুক্তভোগীরা বিকাশ, নগদ ও অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ভুয়া কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি সেজে প্রতারিত হওয়ার কথা জানান। প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায়, প্রতারক চক্র গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট, পিন ও ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে অবৈধভাবে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছিল। অভিযোগগুলো বিশদভাবে পর্যালোচনা করে ও কমন মোবাইল নম্বর গুলো গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ট্রেস করে দেখা যায় যে, প্রতারিত অর্থের উৎস দেশের বিভিন্ন জেলা হলেও এর চূড়ান্ত গন্তব্য মূলত ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার ডোমাইন ইউনিয়নের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কেন্দ্রীভূত।
১৫ রিভারাইন ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বে তিন দিনব্যাপী এই চক্রের প্রযুক্তিগত ব্যবহার, ভৌগোলিক অবস্থান এবং আর্থিক লেনদেন পদ্ধতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে। তথ্য বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসে যে, প্রতারিত অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশে সক্রিয় শতাধিক অনলাইন জুয়া ও বেটিং সাইটে প্রবেশ করানো হতো। এই চক্র বিশেষ সফটওয়্যার ও স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে অনৈতিকভাবে ‘শতভাগ জয়’ নিশ্চিত করে জুয়ার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করত। এরপর ওই প্ল্যাটফর্ম থেকে সংগৃহীত অর্থের একটি বড় অংশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসী বাংলাদেশিদের দ্বারা তৈরি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে পাচার করা হতো। অবশিষ্ট অর্থ চক্রের সদস্যরা স্থানীয়ভাবে ভাগ করে নিত।
গত ১৪ জুলাই ভোররাতে যৌথবাহিনী একটি সুপরিকল্পিত অভিযান শুরু করে। প্রায় সাত ঘণ্টাব্যাপী পরিচালিত এই অভিযান সকাল ০৮টা ৩০ মিনিটে মধুখালীর ডোমাইন বাজার এলাকায় সফলভাবে সমাপ্ত হয়। যৌথ বাহিনী পূর্বনির্ধারিত সন্দেহভাজনদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে প্রতারণা চক্রের মূলহোতা ও উক্ত এলাকার কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী মো. কামরুল মিয়া (৪০) সহ তার চার সহযোগী – অমরেশ বিশ্বাস (৩০), সোহান মালিক (২৪), হাফিজুর রহমান (৪২) এবং শেখ শাকিল আহমেদ (২৬) কে আটক করা হয়।
আটককৃতদের কাছ থেকে ১০৬ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৪২টি গ্রামীণফোন সিমকার্ড এবং ১০টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা স্বীকার করে যে, তারা দেশব্যাপী বিকাশের ভুয়া কল সেন্টার সেজে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে প্রতারণা করত এবং পরবর্তীতে সেই প্রতারণা হতে প্রাপ্ত অর্থের শতভাগ তারা অনলাইন জুয়ার পিছনে খরচ করত। পরবর্তীতে সেই অবৈধ অর্থের ৫০ শতাংশ বিদেশে পাচার করত ও বাকি ৫০ শতাংশ নিজেরা ভাগাভাগি করে নিত। নতুন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট চালু রাখার জন্য তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় অবৈধ সিম সরবরাহকারী গ্রুপ থেকে বিকাশ ও নগদ পূর্ব-নিবন্ধিত মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করত বলে জানা যায়।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এই প্রতারণা চক্রের বিস্তৃতি কেবল ফরিদপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহসহ দেশের প্রায় প্রতিটি বিভাগেই তাদের অপতৎপরতা বিদ্যমান ছিল। এটি দেশের মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ডিজিটাল প্রতারণার ভয়ংকর দৃষ্টান্ত।
আটককৃতদের মধুখালী থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, সাইবার অপরাধ দমন আইন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একাধিক মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মনে করছে, এই অভিযানের মাধ্যমে একটি সক্রিয় ও সুসংগঠিত ডিজিটাল প্রতারণা ও অর্থ পাচার চক্রের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
সেনা সূত্র জানায়, দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, জনগণের ডিজিটাল লেনদেন এবং সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সেনাবাহিনী অবৈধ অর্থপাচার, মাদক, প্রতারণা ও সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে। এ ধরনের অপরাধ দমনে নাগরিকদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রিন্ট