সম্প্রতি কুড়িগ্রাম ধরলা সেতু থেকে ভূরুঙ্গামারী সড়ক প্রশস্থ করা হয়েছে। বর্তমানে কুড়িগ্রামের সবচেয়ে আধুনিক রাস্তা এটি। সোনাহাট স্থলবন্দর চালু হওয়ার পর বেড়েছে আমদানি রপ্তানি। প্রতিদিন শতশত পাথর বোঝাই ভারি ট্রাক চলছে এই রাস্তা দিয়ে। এ অবস্থায় কুড়িগ্রাম-ভূরুঙ্গামারী সড়কে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। বিগত কয়েক মাসে যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা এই রাস্তায় ঘটেছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় অধিকাংশই ট্রাকের সাথে মোটরসাইকেল কিংবা অটোরিকশার সংঘর্ষ।
সর্বশেষ গত ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, শুক্রবার ট্রাকের সাথে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় সাদিক ও হিমু নামের দশম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থীর। শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা। এরই প্রেক্ষিতে কুড়িগ্রাম ট্রিবিউন এর পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালানো হয় এই সড়কে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে। গত তিন দিনে কুড়িগ্রাম ট্রিবিউন এর কয়েকজন প্রতিনিধি দূর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলো সহ পুরো সড়ক পরিদর্শন করে এই সড়কে নিয়মিত চলাচলকারী বিভিন্ন যানবাহনের চালক, স্থানীয় বাসিন্দা এবং বিভিন্ন দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা নিচে তুলে ধরা হলো:
১। তারামন বিবির মোড় থেকে ধরলা সেতু পর্যন্ত উঁচুনিচু রাস্তা। এই রাস্তার অর্ধেক অংশ পিচ ফেলে উঁচু করে রাখা হলেও অর্ধেক রাস্তা নিচু অবস্থায় রয়ে গেছে। ছোট চাকার যানবাহন যেমন রিকশা, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল এমন রাস্তায় সহজে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। ঠিক এমন রাস্তায় গত শুক্রবার দুর্ঘটনার শিকার হয় সাদিক ও হিমু।
২। সুপ্রশস্থ এই রাস্তায় নেই কোন রোড ডিভাইডার। দেশের অন্যান্য স্থানে এর থেকে কম প্রশস্ত রাস্তায় রোড ডিভাইডার দেখা যায়। সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি রপ্তানি সহজ করতে আধুনিক এই রাস্তা তৈরী করা হলেও রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে রোড ডিভাইডারের ব্যবস্থা নকশায় রাখা হয়নি।
৩। দেশের সকল রাস্তার দুইদিকে এবং মাঝে সাদা, হলুদ রংকরণের মাধ্যমে লেন আলাদা করে দেওয়া হয়। কিন্তু কুড়িগ্রাম- ভুরুঙ্গামারী রাস্তায় এখন পর্যন্ত রং দিয়ে লেন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। ফলে যানবাহনের চালকরা পুরো রাস্তাই নিজের মনে করেন। এছাড়া তিব্র কুয়াশায় বাস ট্রাকের চালকরা হেডলাইটের আলোয় সামনে কিছু দেখতে না পেলে লেন বিভাজকের দাগ দেখে গাড়ী চালিয়ে নিয়ে যান। যা এই রাস্তায় নেই ।
৪। সোনাহাট স্থলবন্দরে চলাচলকারী প্রায় সকল ট্রাক কুড়িগ্রামের বাইরের, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত। অধিকাংশ ট্রাক চালক প্রথমবার পণ্য পরিবহনের জন্য এই রাস্তায় চলাচল করেন। সড়ক বিভাজক কিংবা রং করে লেন আলাদা না করায় অধিকাংশ চালকই বিভ্রান্ত হন।
৫। রাস্তার দুইধারে অবস্থিত স্কুল, কলেজ, বাজার, মসজিদ, মন্দির সহ বিভিন্ন স্থাপনা চিহ্নিতকরণের জন্য আগে থেকে সতর্কতামূলক কোন ব্যবস্থা নেই। দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় বিভিন্ন স্থাপনার কমপক্ষে আধা কিলোমিটার আগেই সতর্কতামূলক বিভিন্ন চিহ্ন থাকে যা দেখে চালকরা বুঝতে পারে যে সামনে স্কুল, কলেজ, বাজার ইত্যাদি রয়েছে যা দেখে চালকরা আগেই সতর্ক হন এবং সে অনুযায়ী গতি কমিয়ে দেন।
৬। কুড়িগ্রাম- ভুরুঙ্গামারী সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু বাঁক রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো পাটেশ্বরী বাজার ও কুমড়পুর বাজারের মধ্যবর্তী কালী মন্দির ও পেট্রোল পাম্প সংলগ্ন বাকটি। এই বাকে অন্য দিক থেকে আসা যানবাহন দেখা সম্ভব হয়না। এখানে প্রতিনিয়ত ছোটবড় দুর্ঘটনা ঘটে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক এবং বাজারগুলোতে রোড ডিভাইডার দেয়া বাধ্যতামূলক।
৭। দুর্ঘটনার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো। এই রাস্তায় উঠতি বয়সী কিশোর যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালাতে দেখা গেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায় দুপুরের পর থেকে ধরলা সেতু হয়ে নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারীর দিকে তরুণ যুবকরা বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলে। বেশিরভাগ ভাগ মোটরসাইকেলে ৩ জন করে থাকে।
৮। ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চার্জার রিকশা, অটোরিকশা, মিশুক ইত্যাদি যানবাহন এই রাস্তায় দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। মোটরসাইকেলের প্রায় সমান গতিতে ছুটে চলা এসব যানবাহনের চালকদের নেই কোন প্রশিক্ষণ কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স। একজন মোটরসাইকেল চালক যেখানে ৩-৪ ধাপে পরীক্ষা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পান সেখানে একই গতিতে চলা অটোরিকশার চালকদের তা প্রয়োজন হয় না। যারা আগে প্যাডেলচালিত রিকশা চালাতো তারাই এখন চার্জার রিকশা কিংবা অটোরিকশা কিনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত প্যাডেল চালিত ভ্যানগাড়ী এবং ঠেলাগাড়ীকে মডিফাই করে বৈত্যুতিক মটর লাগিয়ে চালানো হচ্ছে। যারা চালাচ্ছেন তাঁরা হয়তো আগে প্যাডেল চালিত ভ্যান কিংবা ঠেলাগাড়ী চালাতেন।
উল্লিখিত কারণগুলো ছাড়াও এই রাস্তায় মাদকসেবীদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, ড্রাইভিং লাইসেন্স বিহীন চালক, রাস্তার কিছু স্থানে খানাখন্দ, দীর্ঘদিনেও কাজ সমাপ্ত না করা সহ চালকদের অসচেতনতাকে দায়ী করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
প্রিন্ট