কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় আশংকাজনক হারে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। পৌরসভাসহ উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের অনেক শিশু শ্রমিক বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার আলো থেকেও হচ্ছে তারা বঞ্চিত।
শিশুশ্রম বন্ধে নানা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও সামাজিক সংগঠন সভা, সমাবেশ ও মানববন্ধন করলেও আজও শিশুশ্রম বন্ধ হয়নি। শিশুদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী ও কর্তাব্যক্তিরা। তারা অল্প পারিশ্রমিক দিয়ে কোনো শিশু শ্রমিকের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় কাজ করাতে পারেন। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে বেশিরভাগ শিশুই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।
সম্প্রিত,ভেড়ামারা শহরে বোর্ড স্কুলের পাশে মাইক্রোবাস স্ট্যান্ডের সামনে বিসমিল্লাহ দোকানের মালিক মুন্নাসহ তার দুই কর্মচারী সিয়াম ও সিজান ওয়ারিং মেরামত কাজের সময় ওয়ারিং গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সিয়াম (১৪)মারা যায়। সিয়াম পৌর এলাকা কাচারী পাড়া গ্রামের তাহাজ উদ্দীনের ছেলে।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ দারিদ্রতা, দ্রব্য মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, শিক্ষা উপকরণের অধিক মূল্য, অভিভাবকের বেকারত্ব, বিভিন্ন গ্রামের নিম্ন আয়ের পরিবারে শিশুরা দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের জন্য এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। এসব শিশু শ্রমিকের কেউ পিতৃহীন, কেউবা অভাবের কারণে ঘর ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পা বাড়াচ্ছে।
উপজেলার বিভিন্ন যায়গা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে,সরকারিভাবে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়ায় দিন দিন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে চলছে। এই কারণে হাটবাজারের চায়ের দোকানে, নসিমন, করিমন, আলগামন চালানো, হোটেল রেস্তোরা, বেকারী, ওয়েল্ডিং কারখানা, রিকসা ভ্যান চালানো, ওয়ার্কশপ, লেদ মেশিন কারখানার মত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় এরা নিয়োজিত।
ভেড়ামারা শহরের নওদাপাড়া এলাকার মোটর মেকানিকের দোকানের কর্মচারী রিফাত নামে এক শিশু শ্রমিক জানায়, তারা তিন ভাইবোন। বাবা রিকশাচালক। তাই এখানে কাজ করে যা পায় তা দিয়ে সংসারে সাহায্য করে সে।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শিশুশ্রম নিষিদ্ধ থাকলেও আইনকে উপেক্ষা করেই অনায়াসে চলছে শিশু শ্রম। ৭-১৪ বছরের এসব শিশু বিভিন্ন পেশায় কঠিন শ্রম দিলেও তাদের প্রতিদিনের আয় সর্বোচ্ছ ৫০-৬০ টাকা । অথচ একটি প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকের মত শ্রম দিলেও ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।
জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী সবাইকে শিশু বলা হয়েছে। বাংলাদেশের নানা আইনে ১৫ বছরের কম বয়সী সবাইকে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের অধিকার রক্ষা ও বিকাশে রয়েছে নানা আইন। কিন্তু তার পরও বাংলাদেশে লঙ্ঘিত হচ্ছে শিশু অধিকার। সমাজ থেকে শিশু-কিশোরদের যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার কথা, তা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুনীতিকে পাশ কাটিয়েই শিশুদের ভারী গৃহশ্রমসহ বেআইনি কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে হকারি, ডাস্টবিনে ময়লা কুড়ানো, কুলি, রিকশা শ্রমিক, যৌন ব্যবসা, ফুল বিক্রেতা, মাদক বাহক, বিক্রেতা প্রভৃতি। আর এসব শিশু শ্রমিকের প্রায় ৫০ ভাগই তাদের পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস।
বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে, যে কোনো কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের বয়স ১৪ বছরের নিচে হওয়া যাবে না, কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ২০১১ সালে এসব শিশুদের সংখ্যা নিয়ে জরিপ করা এবং তাদের অবস্থা পরিবর্তনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ভেড়ামারার ইন্সপেক্টর রশিদ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বা শিশুশ্রম বন্ধে তারা নানা শ্রমিক সংগঠন ও মালিকদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের না নেয়ার জন্যও চিঠি দিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানকে শিশুশ্রম নিয়োগ দেয়ার কারণে জরিমানাও করা হয়েছে। শিশুশ্রম বন্ধে আমরা যথেষ্ট আন্তরিক। সরকারেরও কঠোর নির্দেশনা রয়েছে, যা আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
দেশে শিশু শ্রমের ব্যপারে সঠিক প্রচলিত আইনের প্রয়োগ না থাকায় দিন দিন শিশু শ্রমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশু শ্রম বন্ধে এবং আইনের সঠিক প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন সচেতন মহল।
প্রিন্ট