ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

ছোটগল্পঃ বাবুদের তাল বাগান

শামীম আহমেদঃ

কাঞ্চনপুর গ্রামের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল তালবাগানটা এক সময় ছিল জমিদার হেমেন্দ্রলাল রায়ের গর্ব। লোকে বলত, “এই তালের বাগানই হচ্ছে জমিদারির চিহ্ন, হেমেন্দ্রবাবুর ঐশ্বর্যের ছায়া।” বছরের পর বছর তাল গাছগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক যেন রাজপুরুষেরা প্রহরায় আছে।

হেমেন্দ্রলাল রায় ছিলেন এককালের বিখ্যাত জমিদার। তবে সময় পাল্টেছে। জমিদারি উঠে গেছে। রাজস্ব প্রথা বাতিল হওয়ার পর উত্তরসূরিরা একে একে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু তালবাগানটা থেকে গেছে গ্রামের বুকে, একা একা।

এই বাগানের পাশেই ছোট একটা কুঁড়ে ঘরে থাকে বুড়ো মানুষটি – লোকেরা তাকে ডাকে “তালু চাচা”। তাঁর আসল নাম কেউ জানে না, তবে সে নাকি এক সময় জমিদারের বাগানের পাহারাদার ছিল। জমিদার যখন শহরে চলে যান, তালু চাচা থেকে গিয়েছিলেন এই বাগানের দেখভাল করতে। বিনা পারিশ্রমিকে, নিঃশব্দে।

প্রতি বর্ষায়, তালগুলো যখন পেকে পেকে ঝরে পড়ে, তালু চাচা সেগুলো কুড়িয়ে এনে গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিলিয়ে দেন। সেই তাল দিয়ে কেউ বানাতো পাটালি, কেউ আবার তাল সন্দেশ বানাতেন। চাচার কোনো লোভ নেই— তিনি বলতেন, “এই গাছগুলোও তো একেকটা স্মৃতি। আমার চোখের সামনে বড় হয়েছে ওরা।”

একদিন গ্রামের স্কুলের মাস্টার মশাই সুশান্ত বাবু বাচ্চাদের নিয়ে এলেন তালবাগানে। বললেন, “এই বাগানটা সংরক্ষণ করা উচিত। সরকারকে একটা প্রস্তাবনা পাঠানো যাক, যাতে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ কিংবা প্রকৃতি পাঠশালা করা যায়।” তালু চাচার চোখে জল এসে গেল।

“জমিদারবাবুর অনেক দোষ ছিল,” তিনি বললেন, “তবে এই তালবাগানটা উনি সবাইকে দিয়ে গিয়েছিলেন। এখন যদি তোমরা ওর যত্ন নাও, ওটাই হবে তার প্রকৃত সম্মান।”

সেই বিকেলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা মিলে বাগানের মরা গাছ ছেঁটে ফেলল, মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো ডাল পুঁতে নতুন চারা লাগাল। তালু চাচা দূরে বসে সব দেখলেন, আর একটানা হাসলেন। সূর্য ডুবছিল পশ্চিমে, তালগাছের ছায়াগুলো লম্বা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল।

বাগানে একটা নতুন জীবন শুরু হচ্ছিল, আর তার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তালু চাচা…।

 

-শামীম আহমেদ

কবি, লেখক ও সাহিত্যিক

 


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ
error: Content is protected !!

ছোটগল্পঃ বাবুদের তাল বাগান

আপডেট টাইম : ১৭ ঘন্টা আগে
শামীম আহমেদ, কবি, লেখক ও সাহিত্যিক :

শামীম আহমেদঃ

কাঞ্চনপুর গ্রামের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল তালবাগানটা এক সময় ছিল জমিদার হেমেন্দ্রলাল রায়ের গর্ব। লোকে বলত, “এই তালের বাগানই হচ্ছে জমিদারির চিহ্ন, হেমেন্দ্রবাবুর ঐশ্বর্যের ছায়া।” বছরের পর বছর তাল গাছগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক যেন রাজপুরুষেরা প্রহরায় আছে।

হেমেন্দ্রলাল রায় ছিলেন এককালের বিখ্যাত জমিদার। তবে সময় পাল্টেছে। জমিদারি উঠে গেছে। রাজস্ব প্রথা বাতিল হওয়ার পর উত্তরসূরিরা একে একে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু তালবাগানটা থেকে গেছে গ্রামের বুকে, একা একা।

এই বাগানের পাশেই ছোট একটা কুঁড়ে ঘরে থাকে বুড়ো মানুষটি – লোকেরা তাকে ডাকে “তালু চাচা”। তাঁর আসল নাম কেউ জানে না, তবে সে নাকি এক সময় জমিদারের বাগানের পাহারাদার ছিল। জমিদার যখন শহরে চলে যান, তালু চাচা থেকে গিয়েছিলেন এই বাগানের দেখভাল করতে। বিনা পারিশ্রমিকে, নিঃশব্দে।

প্রতি বর্ষায়, তালগুলো যখন পেকে পেকে ঝরে পড়ে, তালু চাচা সেগুলো কুড়িয়ে এনে গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিলিয়ে দেন। সেই তাল দিয়ে কেউ বানাতো পাটালি, কেউ আবার তাল সন্দেশ বানাতেন। চাচার কোনো লোভ নেই— তিনি বলতেন, “এই গাছগুলোও তো একেকটা স্মৃতি। আমার চোখের সামনে বড় হয়েছে ওরা।”

একদিন গ্রামের স্কুলের মাস্টার মশাই সুশান্ত বাবু বাচ্চাদের নিয়ে এলেন তালবাগানে। বললেন, “এই বাগানটা সংরক্ষণ করা উচিত। সরকারকে একটা প্রস্তাবনা পাঠানো যাক, যাতে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ কিংবা প্রকৃতি পাঠশালা করা যায়।” তালু চাচার চোখে জল এসে গেল।

“জমিদারবাবুর অনেক দোষ ছিল,” তিনি বললেন, “তবে এই তালবাগানটা উনি সবাইকে দিয়ে গিয়েছিলেন। এখন যদি তোমরা ওর যত্ন নাও, ওটাই হবে তার প্রকৃত সম্মান।”

সেই বিকেলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা মিলে বাগানের মরা গাছ ছেঁটে ফেলল, মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো ডাল পুঁতে নতুন চারা লাগাল। তালু চাচা দূরে বসে সব দেখলেন, আর একটানা হাসলেন। সূর্য ডুবছিল পশ্চিমে, তালগাছের ছায়াগুলো লম্বা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল।

বাগানে একটা নতুন জীবন শুরু হচ্ছিল, আর তার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তালু চাচা…।

 

-শামীম আহমেদ

কবি, লেখক ও সাহিত্যিক

 


প্রিন্ট