কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সাহেবনগর এলাকায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পদ্মা নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের ৭২৮ মিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়ক।
পদ্মার পানির উচ্চতা গড়ে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৩ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে স্রোত আরও তীব্রভাবে কূলে আঘাত হানছে। ফলে নদী–তীরবর্তী বাসিন্দাদের মধ্যে ছড়িয়েছে ভাঙনের আতঙ্ক।
কুষ্টিয়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, যেভাবে নদীভাঙন হচ্ছে, তাতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আরও ৩০ থেকে ৩৫ মিটার ভেঙে গ্রামের দিকে চলে আসার শঙ্কা আছে। তখন কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়ক থেকে নদীর দূরত্ব হবে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ মিটার। যে কােন সময় এই মহাসড়ক নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
কুষ্টিয়ার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান বলেন, পদ্মায় পানি কমার সঙ্গে ভাঙন তীব্র হচ্ছে। পানির স্রোতও বেশি। যেভাবে ভাঙছে তাতে মহাসড়ক খুবই ঝুঁকির মধ্যে আছে। ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাতে স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। এতেই সমস্যা বেশি দেখা দিয়েছে।
পাউবোর ভাষ্য, মিরপুর উপজেলার কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়কের পাশ দিয়ে পদ্মা নদী বয়ে গেছে। মহাসড়ক ও নদীর মাঝখানে উপজেলার মুন্সিপাড়া, সাহেবনগর, মির্জানগর ও রানাখড়িয়া এলাকা। এসব এলাকার বসতবাড়িসহ আবাদি জমি আছে। গত ৫ বছরে এসব এলাকায় অন্তত ১ হাজার ১৮৮ একর ফসলি জমি পদ্মায় বিলীন হয়েছে।
চলতি মৌসুমে ইতিমধ্যে পানি বাড়ার সময় প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ১৮৬ মিটার গ্রামের জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সবই ফসলি জমি। ১২ অক্টোবর থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ মাটির বেড়িবাঁধের প্রায় ৭২৮ মিটার পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের ছয়টি টাওয়ারের মধ্যে তিনটি টাওয়ার ভেঙে পড়ে গেছে। গত দুই দিনে মির্জানগর এলাকার একটি কবরস্থানের বেশির ভাগ অংশ বিলীন হয়েছে।
মির্জানগর কবরস্থান কমিটির কোষাধ্যক্ষ আশরাফুল ইসলাম বলেন, কবরস্থান আর টেকানো গেল না। এখন বসতবাড়ি কীভাবে রক্ষা হবে, সেটাই চিন্তা করছেন।
মঙ্গলবার সকালে সাহেবনগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা নদীতে ব্যাপক স্রোত বইছে। স্রোতের তোড়ে ভাঙা বেড়িবাঁধের পাশে গ্রামের দিকের জায়গাজমি ভেঙে যাচ্ছে। ভাঙন প্রতিরোধে ফেলা হচ্ছে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ও টিউব। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দাকে বসতবাড়ির পাশে থাকা গাছপালা কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বসতবাড়ির আসবাব সরিয়ে নিচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, রাতে তাঁদের ঘুম হয় না। পানির শোঁ শোঁ শব্দ। কখন যেন সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সাহেবনগর, মির্জানগর ও রানাখড়িয়া এলাকা চরম ঝুঁকির মধ্যে আছে। বেশ কিছু বসতবাড়ি, কৃষিজমি, কয়েকটি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ভাঙনের মুখে।
পাউবো জানায়, ভাঙন ঠেকাতে ইতিমধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার জিও ব্যাগ ও ৩ হাজার ২০০ টিউব ফেলা হয়েছে। নদীর গভীরতা বেশি ও তীব্র থাকায় জিও ব্যাগ ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এতেই মহাসড়কের দিকে প্রতিনিয়ত পদ্মার ভাঙন এগিয়ে আসছে।
একই গ্রামের স্থানীয় আমিনুল ইসলাম বলেন, এই এলাকার একটি মাত্র গোরস্থান। সেটি নদীতে চলে যাচ্ছে। এই এলাকার মানুষকে মাটি দেওয়ার জায়গাটুকু আর থাকছে না। সরকার যদি দ্রুত ভাঙন রোধে পদক্ষেপ নিতো তাহলে এলাকার গোরস্থানটি ভাঙন থেকে রক্ষা পেতো।
উপজেলার বহলবাড়ীয়া গ্রামের কৃষক ইসাহক জানান, ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বেশ কয়েক বিঘা জমি। বসতবাড়িই এখন সম্বল। যেভাবে ভাঙছে নদী তাতে শেষ সম্বলও বিলীন হয়ে যাবে।
বহলবাড়ীয়া জামিউল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক ফিরোজ আহমেদ জুয়েল বলেন, ‘পদ্মা নদীর ভাঙন মাদ্রাসার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। যেভাবে ভাঙছে তাতে যেকোনো মুহূর্তে মাদ্রাসাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। আমরা চরম আতঙ্কের মধ্যে আছি।’
পদ্মা নদী রক্ষা কমিটির নেতা মুফতি ইয়াকুব বিন আজমল বলেন, পদ্মায় পানি কমার কারণে সম্প্রতি ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে স্থানীয় সাহেবনগর জামিউল মাদ্রাসা ভবন।
কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শারমিন আখতার বলেন, জাতীয় মহাসড়ক রক্ষার জন্য পাউবো কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে উচ্চপর্যায়েও কথা হচ্ছে।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান বলেন, পদ্মায় পানি কমার সঙ্গে ভাঙন তীব্র হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব এলাকায় ভাঙন তীব্র হচ্ছে, সেসব এলাকায় ভাঙনরোধে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। তবে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে ইতিমধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পদ্মার আগ্রাসী ভাঙ্গনের বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান ঝুঁকিপূর্ণ কৃষি জমি, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ,কবরস্থান, স্কুল-কলেজ,মাদ্রাসা ও জাতীয় মহাসড়কসহ সরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায় জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন।
পরিদর্শনকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ, কুষ্টিয়ার তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আব্দুল হামিদ, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুর রহমান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী (এসডিই) অপূর্ব কুমার দাস, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ স্থানীয় জনগণ ও মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রিন্ট