ঢাকা , রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo বালিয়াকান্দির ‘উকুন খোটা’ স্কুল এখন দেশসেরা হওয়ার অপেক্ষায় Logo তানোরের নারায়নপুর স্কুলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান Logo বাঘায় গলা কেটে হত্যা, নিহতের ভাইরা ভাই রায়হান গ্রেপ্তার Logo দামের উত্তাপে ইলিশ এখন ছুঁয়ে দেখতেও ভয় Logo গোপালগঞ্জে দূর্নীতি ও প্রতারণা করা সেই ত্রাণ কর্মকর্তার তদন্ত শুরু Logo কুষ্টিয়ায় জেল পলাতক আসামি রুবেল গ্রেফতার Logo ফরিদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের স্মরণে স্মরণসভা Logo আলফাডাঙ্গা প্রেসক্লাবসহ সেবাদান প্রতিষ্ঠানের পাশে দাঁড়ালেন আদিত্য ফাউন্ডেশন Logo ফরিদপুর জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক শামীম তালুকদার গ্রেপ্তার Logo এবার ২১ দিনের মধ্যে জবাব দিতে আদানিকে সমন পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

২ লাখ অজ্ঞাতনামা আসামি!

 

বিভিন্ন থানায় করা হত্যা মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে অজ্ঞাতপরিচয় বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করার সত্যতা পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের একটি মামলায় সর্বোচ্চ অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা ৪০ হাজার।

 

যেসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসমির সংখ্যা বেশি সেগুলোর বেশিরভাগেরই বাদী পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মী। অভিযোগ উঠেছে, জমিসহ ব্যক্তিগত বিরোধের ঘটনায়ও প্রতিপক্ষকে মামলায় জড়ানো হচ্ছে।

 

অজ্ঞাতপরিচয় বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করার বিষয়টি উদ্বেগজনক মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ ও ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের নেতাকর্মীরা হয়রানির শিকার হতে পারেন। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন, সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে।

 

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। গঠিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামের প্ল্যাটফর্ম। জুলাইয়ের মাঝামাঝি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে হামলা ও সহিংসতা শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের সমর্থনে রাস্তায় নামে জনতা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এরপরও বেশ কয়েক দিন সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরের দিকে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন রাস্তায় নামে। আনসার সদস্যরা সচিবালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। তখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

 

ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় গত ১৩ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। এরপর একে একে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হতে থাকে। এ পর্যন্ত ২২০টি মামলায় শেখ হাসিনাকে আসামি করার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৮৮টি মামলায় হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বেশ কয়েকটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে।

হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও নেতার বিরুদ্ধেও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন ‘মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন’ তাদের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদনে ওই দুই মাসের মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগস্ট মাসে ২৬৮টি মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৫৫ জনকে। অন্যদিকে নাম উল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ২৬ হাজার ২৬৪। সেপ্টেম্বর মাসে ২৩৮ মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৩০ হাজার ২৩৫ জনকে আর নাম উল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ১৯ হাজার ২৮৩।

 

গতকাল রবিবার পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৯৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায়ও অজ্ঞাতনামা আসামি আছে বলে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে এ হিসাব এখনো নিরূপণ করা হয়নি।

 

পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, তৎকালীন সরকারি দলের নেতৃস্থানীয় ৭৪ জনসহ শুধু চলতি অক্টোবর মাসের এ পর্যন্ত ৩ হাজার ১৯৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

 

মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান লিটন বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে গত দুই মাসে যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোতে নামের যে ফিরিস্তি দেখছি বা যে সংখ্যা দেখছি এটি আগের স্বৈরশাসনের সময়কার মতোই। তখন মানুষকে হয়রানির জন্য যেভাবে মামলা করা হতো সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, এটা পরিষ্কার। আমরা যদি এটা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারি, তাহলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু কিছু ব্যক্তিকে যেসব মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে তাদের ওই মামলায় সংশ্লিষ্ট থাকার কোনো সুযোগই নেই। এগুলো আমরা দেখছি এবং মনে হচ্ছে মহলবিশেষ এ কাজগুলো করছে।’

 

উত্তাল জুলাইয়ের ১৮ তারিখ, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীসংলগ্ন কাজলা বিশ্বরোড। কোটা সংস্কার ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সেদিন বিকেলে আন্দোলনে থাকা মো. সাকিব হাসান (২২) নিহত হন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আর পুলিশের মারধর ও গুলিতে। পরদিন ডেমরা সড়কের কাজলা চৌরাস্তা মোড়ে একইভাবে নিহত হন আরেক আন্দোলনকারী মো. জাহাঙ্গীর আলম (৫০)। এ দুটি ঘটনায় ৪৫ ও ৪৬ দিন পর ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন মো. আবু বক্কর নামের এক ব্যক্তি। একই দিনে করা আলাদা দুটি মামলার আসামি একই নাম ও ঠিকানার ব্যক্তিরা। ৪৪২ জন করে দুই মামলায় আসামি সংখ্যা ৮৮৪। দুই মামলার প্রতিটিতে অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা তিন-চার হাজার। অর্থাৎ দুই মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি সর্বোচ্চ আট হাজার। একই ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলা দুটি করেছেন। এজাহারে বাদীর পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের শ্রমিক দলের আহ্বায়ক। যদিও মামলার ব্যাপারে নিহতদের পরিবারের কেউ কিছু জানেন না।

 

নাম উল্লেখ করে ও নাম ছাড়া এত আসামি এবং নিহতদের পরিবারকে না জানিয়ে মামলা করার বিষয়ে জানতে চাইলে আবু বক্কর বলেন, ‘আমি মোবাইল ফোনে কোনো স্টেটমেন্ট দিতে পারব না। আপনাকে আমার সামনে আসতে হবে।’

 

৫ আগস্ট ফেনীর ছাগলনাইয়া থানায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার ৪৩ দিন পর ১৭ সেপ্টেম্বর পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ৮-১০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ফেনী পৌর ভবন ও ঢাকা জেলার ধামরাই থানায় হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় করা মামলায় পাঁচ হাজার করে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে সচিবালয়ে ভাঙচুর, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও সেনাসদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় সাধারণ আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে রাজধানীর তিনটি থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ১০ হাজার আনসার সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। এ আটটি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুটি মামলার বাদী একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং চারটি মামলার বাদী পুলিশ। বাকি মামলাগুলোর বাদী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।

 

পুলিশ সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানায় হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ২৩ আগস্ট মামলা করে। এ মামলায় অজ্ঞাতনামা ৩০ থেকে ৪০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা পূর্ব থানায় একই অভিযোগে ৫০ হাজারের বেশি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে দুটি মামলা হয়েছে।

 

নূর খান লিটন বলেন, ‘যখন বেশিসংখ্যক অজ্ঞাতনামা আসামি রেখে মামলা করা হয়, তখন হয় এগুলোর বাদী থাকে পুলিশ অথবা রাজনৈতিক কর্মী, যা আমরা আগেও দেখেছি। আসলে আগের অবস্থা আর এখনকার অবস্থার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, এ মামলাগুলো যেন সুষ্ঠুভাবে দায়ের ও তদন্ত করা হয়।’

 

সুষ্ঠুভাবে মামলার করার ব্যাপারে জোর দেওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তা না হলে এ ধরনের মামলা হাস্যরসের জন্ম দেবে এবং মানুষের আস্থা থাকবে না। এত বড় অপরাধ স্বৈরশাসকরা করেছে যে, তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। এজন্য মামলাগুলো হওয়া উচিত সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে।’

 

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল এ ধরনের মামলার জন্য ফ্যাসিস্ট শাসনামলের পুলিশকে দুষছেন। সেই সঙ্গে এটা ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারের কোনো ষড়যন্ত্র হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তা না হলে পুলিশ কেন একটা ঘটনায় ৭০০ জনকে আসামি করবে। এতজনের নামও তো জানার কথা নয়। বিএনপিসংশ্লিষ্ট কেউ মামলা করেছে এটার সংখ্যা খুবই কম।’

 

কায়সার কামাল বলেন, ‘অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে আমি একমত নই। যেমন, প্রথমত মামলাগুলো বিএনপি নেতাকর্মীরা করছে না। মামলাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ করছে। এগুলো নিয়ে পত্রপত্রিকায়ও লেখা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যেভাবে ফ্যাসিস্ট শাসনামলে পুলিশ মামলা করেছে, এখনো একইভাবে চলছে। আর কিছু মামলা করেছেন নিহত ও আহতের স্বজনরা। অবশ্যই গত ১৫ বছরের যে সংস্কৃতি, সেটি রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিংবা প্রতিষ্ঠান, সবকিছুই ফ্যাসিস্ট শাসক পলাতক শেখ হাসিনা ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন। এ ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে এখন নতুনভাবে সবকিছু করতে হচ্ছে। এজন্য একটু সময় দিতে হয়। আমি ঢালাওভাবে আসামি করা সমর্থন করছি না।’

 

মামলায় বিপুলসংখ্যক আসামি করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে বাদী যখন মামলাটা করেন তখন কিছু অভিযুক্ত যাদের তিনি চেনেন বা তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, তাদের নামীয় আসামি করেন। এ ছাড়া কখনো কখনো বাদী যদি আসামিকে না চেনেন অথবা সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়ে থাকে। তবে যখন অভিযোগপত্র দেওয়া হয় তখন শুধুই অভিযুক্তদের নাম দেওয়া হয়। যখন পুলিশ মামলা তদন্ত করতে থাকে তখন দুটি দিক নিয়েই কাজ করে থাকে।’

 

মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি বেশি থাকলে পুলিশের হয়রানির শঙ্কা থাকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হয়রানির ক্ষেত্রে সদর দপ্তর থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। থানা হবে হয়রানিমুক্ত। নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা আছে। যাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ আছে তাদেরই যেন আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয় সেটা মিটিংগুলোতে বলে দেওয়া হয়।’

 

পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামির করার বিষয়টি সত্য। তবে ওইসব আসামিকে পুঁজি করে যেন বাণিজ্য না হয়, সে বিষয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে। কোনো মামলায় নতুন আসামি করা হলে থানা থেকে ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারকে বিষয়টি অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে পুরনো মামলায় নতুন করে আসামি করেন, তাহলে থানার ওসিদের জবাবদিহি করতে হবে। প্রতিটি মামলাই নিরপেক্ষভাবে তদন্ত হচ্ছে বলে ওই কর্মকর্তা দাবি করেন।

 

মূলত কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় ওই সময় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের দমাতে দেশের বিভিন্ন থানায় করা কয়েকশ মামলা করা হয়। এসব মামলার একেকটি এজাহারে নাম উল্লেখ করা হয়েছে গুটি কয়েকজনের। অথচ একই এজাহারে অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছিল। যদিও এসব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

 

একই ধারা চলছে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরও। যেমন সরকার পতনের আগে গত ২৩ জুলাই সাভার মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা প্রায় পাঁচ হাজারজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। সরকারের পতনের পর ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যাও চার থেকে পাঁচ হাজার।

 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা করা হয় ১৩ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায়। ১৯ জুলাই মিছিলে পুলিশ গুলি করেছিল। ওই সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মুদি দোকানদার আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনায় এ মামলাটি করা হয়। একইদিন মিরপুরে ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী ফয়জুল ইসলাম রাজন নিহতের ঘটনায় ১৪ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন নিহতের ভাই মোহাম্মদ রাজীব। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ৫০০-৬০০ জনকে আসামি করা হয়। ৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় আবুল হাসান সুজন নামে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতের ঘটনায় তার বড় ভাই আবুল বাশার অনিক মামলা করেন। মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৪৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০০-১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। রংপুরে গত ১৬ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ, আবদুল্লাহ আল তাহির ও ফল বিক্রেতা মেরাজুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। তিন মামলাতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আসামি করা হয়েছে। আর অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে কয়েকশজনকে। একইভাবে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় বহু হত্যা মামলায় শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। যেগুলোতে অজ্ঞাতপরিচয় আসামির সংখ্যা অনেক। এসব মামলার উদাহরণ টেনে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা হচ্ছে। এভাবে ঢালাও মামলার করার কারণে তদন্ত প্রক্রিয়ায় জটিলতা বাড়বে এবং অভিযোগ প্রমাণ করতে সমস্যা হবে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

 

নাম প্রকাশ না করে বাড্ডা ও মতিঝিল এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, বিগত সরকারের পতনের আগে ও পরে কয়েকশ মামলা হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যারা যখন ক্ষমতা পেয়েছেন তারা তাদের মতো করে এসব মামলা করেছেন। হাতেগোনা কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেও হাজার হাজার অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এতে করে ধরপাকড়ের নামে পুলিশকে নতুন করে ‘ঘুষবাণিজ্য’ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলে তারা মনে করেন।

 

তারা বলছেন, পুলিশ ৫৪ ধারার ক্ষমতাবলে গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে অজ্ঞাতনামা আসামিদের তালিকায়। ফলে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কাকে কখন ধরে নিয়ে যায় এ নিয়ে তারা চিন্তিত।

-দেশ রূপান্তর থেকে নেওয়া।


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

বালিয়াকান্দির ‘উকুন খোটা’ স্কুল এখন দেশসেরা হওয়ার অপেক্ষায়

error: Content is protected !!

২ লাখ অজ্ঞাতনামা আসামি!

আপডেট টাইম : ০৭:৩৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪
সময়ের প্রত্যাশা অনলাইন ডেস্ক :

 

বিভিন্ন থানায় করা হত্যা মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে অজ্ঞাতপরিচয় বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করার সত্যতা পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের একটি মামলায় সর্বোচ্চ অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা ৪০ হাজার।

 

যেসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসমির সংখ্যা বেশি সেগুলোর বেশিরভাগেরই বাদী পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মী। অভিযোগ উঠেছে, জমিসহ ব্যক্তিগত বিরোধের ঘটনায়ও প্রতিপক্ষকে মামলায় জড়ানো হচ্ছে।

 

অজ্ঞাতপরিচয় বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করার বিষয়টি উদ্বেগজনক মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ ও ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের নেতাকর্মীরা হয়রানির শিকার হতে পারেন। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন, সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে।

 

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। গঠিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামের প্ল্যাটফর্ম। জুলাইয়ের মাঝামাঝি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে হামলা ও সহিংসতা শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের সমর্থনে রাস্তায় নামে জনতা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এরপরও বেশ কয়েক দিন সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরের দিকে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন রাস্তায় নামে। আনসার সদস্যরা সচিবালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। তখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

 

ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় গত ১৩ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। এরপর একে একে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হতে থাকে। এ পর্যন্ত ২২০টি মামলায় শেখ হাসিনাকে আসামি করার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৮৮টি মামলায় হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বেশ কয়েকটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে।

হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও নেতার বিরুদ্ধেও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন ‘মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন’ তাদের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদনে ওই দুই মাসের মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগস্ট মাসে ২৬৮টি মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৫৫ জনকে। অন্যদিকে নাম উল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ২৬ হাজার ২৬৪। সেপ্টেম্বর মাসে ২৩৮ মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৩০ হাজার ২৩৫ জনকে আর নাম উল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ১৯ হাজার ২৮৩।

 

গতকাল রবিবার পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৯৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায়ও অজ্ঞাতনামা আসামি আছে বলে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে এ হিসাব এখনো নিরূপণ করা হয়নি।

 

পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, তৎকালীন সরকারি দলের নেতৃস্থানীয় ৭৪ জনসহ শুধু চলতি অক্টোবর মাসের এ পর্যন্ত ৩ হাজার ১৯৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

 

মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান লিটন বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে গত দুই মাসে যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোতে নামের যে ফিরিস্তি দেখছি বা যে সংখ্যা দেখছি এটি আগের স্বৈরশাসনের সময়কার মতোই। তখন মানুষকে হয়রানির জন্য যেভাবে মামলা করা হতো সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, এটা পরিষ্কার। আমরা যদি এটা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারি, তাহলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু কিছু ব্যক্তিকে যেসব মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে তাদের ওই মামলায় সংশ্লিষ্ট থাকার কোনো সুযোগই নেই। এগুলো আমরা দেখছি এবং মনে হচ্ছে মহলবিশেষ এ কাজগুলো করছে।’

 

উত্তাল জুলাইয়ের ১৮ তারিখ, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীসংলগ্ন কাজলা বিশ্বরোড। কোটা সংস্কার ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সেদিন বিকেলে আন্দোলনে থাকা মো. সাকিব হাসান (২২) নিহত হন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আর পুলিশের মারধর ও গুলিতে। পরদিন ডেমরা সড়কের কাজলা চৌরাস্তা মোড়ে একইভাবে নিহত হন আরেক আন্দোলনকারী মো. জাহাঙ্গীর আলম (৫০)। এ দুটি ঘটনায় ৪৫ ও ৪৬ দিন পর ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন মো. আবু বক্কর নামের এক ব্যক্তি। একই দিনে করা আলাদা দুটি মামলার আসামি একই নাম ও ঠিকানার ব্যক্তিরা। ৪৪২ জন করে দুই মামলায় আসামি সংখ্যা ৮৮৪। দুই মামলার প্রতিটিতে অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা তিন-চার হাজার। অর্থাৎ দুই মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি সর্বোচ্চ আট হাজার। একই ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলা দুটি করেছেন। এজাহারে বাদীর পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের শ্রমিক দলের আহ্বায়ক। যদিও মামলার ব্যাপারে নিহতদের পরিবারের কেউ কিছু জানেন না।

 

নাম উল্লেখ করে ও নাম ছাড়া এত আসামি এবং নিহতদের পরিবারকে না জানিয়ে মামলা করার বিষয়ে জানতে চাইলে আবু বক্কর বলেন, ‘আমি মোবাইল ফোনে কোনো স্টেটমেন্ট দিতে পারব না। আপনাকে আমার সামনে আসতে হবে।’

 

৫ আগস্ট ফেনীর ছাগলনাইয়া থানায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার ৪৩ দিন পর ১৭ সেপ্টেম্বর পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ৮-১০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ফেনী পৌর ভবন ও ঢাকা জেলার ধামরাই থানায় হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় করা মামলায় পাঁচ হাজার করে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে সচিবালয়ে ভাঙচুর, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও সেনাসদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় সাধারণ আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে রাজধানীর তিনটি থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ১০ হাজার আনসার সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। এ আটটি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুটি মামলার বাদী একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং চারটি মামলার বাদী পুলিশ। বাকি মামলাগুলোর বাদী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।

 

পুলিশ সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানায় হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ২৩ আগস্ট মামলা করে। এ মামলায় অজ্ঞাতনামা ৩০ থেকে ৪০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা পূর্ব থানায় একই অভিযোগে ৫০ হাজারের বেশি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে দুটি মামলা হয়েছে।

 

নূর খান লিটন বলেন, ‘যখন বেশিসংখ্যক অজ্ঞাতনামা আসামি রেখে মামলা করা হয়, তখন হয় এগুলোর বাদী থাকে পুলিশ অথবা রাজনৈতিক কর্মী, যা আমরা আগেও দেখেছি। আসলে আগের অবস্থা আর এখনকার অবস্থার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, এ মামলাগুলো যেন সুষ্ঠুভাবে দায়ের ও তদন্ত করা হয়।’

 

সুষ্ঠুভাবে মামলার করার ব্যাপারে জোর দেওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তা না হলে এ ধরনের মামলা হাস্যরসের জন্ম দেবে এবং মানুষের আস্থা থাকবে না। এত বড় অপরাধ স্বৈরশাসকরা করেছে যে, তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। এজন্য মামলাগুলো হওয়া উচিত সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে।’

 

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল এ ধরনের মামলার জন্য ফ্যাসিস্ট শাসনামলের পুলিশকে দুষছেন। সেই সঙ্গে এটা ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারের কোনো ষড়যন্ত্র হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তা না হলে পুলিশ কেন একটা ঘটনায় ৭০০ জনকে আসামি করবে। এতজনের নামও তো জানার কথা নয়। বিএনপিসংশ্লিষ্ট কেউ মামলা করেছে এটার সংখ্যা খুবই কম।’

 

কায়সার কামাল বলেন, ‘অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে আমি একমত নই। যেমন, প্রথমত মামলাগুলো বিএনপি নেতাকর্মীরা করছে না। মামলাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ করছে। এগুলো নিয়ে পত্রপত্রিকায়ও লেখা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যেভাবে ফ্যাসিস্ট শাসনামলে পুলিশ মামলা করেছে, এখনো একইভাবে চলছে। আর কিছু মামলা করেছেন নিহত ও আহতের স্বজনরা। অবশ্যই গত ১৫ বছরের যে সংস্কৃতি, সেটি রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিংবা প্রতিষ্ঠান, সবকিছুই ফ্যাসিস্ট শাসক পলাতক শেখ হাসিনা ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন। এ ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে এখন নতুনভাবে সবকিছু করতে হচ্ছে। এজন্য একটু সময় দিতে হয়। আমি ঢালাওভাবে আসামি করা সমর্থন করছি না।’

 

মামলায় বিপুলসংখ্যক আসামি করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে বাদী যখন মামলাটা করেন তখন কিছু অভিযুক্ত যাদের তিনি চেনেন বা তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, তাদের নামীয় আসামি করেন। এ ছাড়া কখনো কখনো বাদী যদি আসামিকে না চেনেন অথবা সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়ে থাকে। তবে যখন অভিযোগপত্র দেওয়া হয় তখন শুধুই অভিযুক্তদের নাম দেওয়া হয়। যখন পুলিশ মামলা তদন্ত করতে থাকে তখন দুটি দিক নিয়েই কাজ করে থাকে।’

 

মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি বেশি থাকলে পুলিশের হয়রানির শঙ্কা থাকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হয়রানির ক্ষেত্রে সদর দপ্তর থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। থানা হবে হয়রানিমুক্ত। নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা আছে। যাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ আছে তাদেরই যেন আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয় সেটা মিটিংগুলোতে বলে দেওয়া হয়।’

 

পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামির করার বিষয়টি সত্য। তবে ওইসব আসামিকে পুঁজি করে যেন বাণিজ্য না হয়, সে বিষয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে। কোনো মামলায় নতুন আসামি করা হলে থানা থেকে ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারকে বিষয়টি অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে পুরনো মামলায় নতুন করে আসামি করেন, তাহলে থানার ওসিদের জবাবদিহি করতে হবে। প্রতিটি মামলাই নিরপেক্ষভাবে তদন্ত হচ্ছে বলে ওই কর্মকর্তা দাবি করেন।

 

মূলত কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় ওই সময় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের দমাতে দেশের বিভিন্ন থানায় করা কয়েকশ মামলা করা হয়। এসব মামলার একেকটি এজাহারে নাম উল্লেখ করা হয়েছে গুটি কয়েকজনের। অথচ একই এজাহারে অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছিল। যদিও এসব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

 

একই ধারা চলছে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরও। যেমন সরকার পতনের আগে গত ২৩ জুলাই সাভার মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা প্রায় পাঁচ হাজারজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। সরকারের পতনের পর ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যাও চার থেকে পাঁচ হাজার।

 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা করা হয় ১৩ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায়। ১৯ জুলাই মিছিলে পুলিশ গুলি করেছিল। ওই সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মুদি দোকানদার আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনায় এ মামলাটি করা হয়। একইদিন মিরপুরে ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী ফয়জুল ইসলাম রাজন নিহতের ঘটনায় ১৪ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন নিহতের ভাই মোহাম্মদ রাজীব। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ৫০০-৬০০ জনকে আসামি করা হয়। ৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় আবুল হাসান সুজন নামে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতের ঘটনায় তার বড় ভাই আবুল বাশার অনিক মামলা করেন। মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৪৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০০-১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। রংপুরে গত ১৬ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ, আবদুল্লাহ আল তাহির ও ফল বিক্রেতা মেরাজুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। তিন মামলাতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আসামি করা হয়েছে। আর অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে কয়েকশজনকে। একইভাবে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় বহু হত্যা মামলায় শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। যেগুলোতে অজ্ঞাতপরিচয় আসামির সংখ্যা অনেক। এসব মামলার উদাহরণ টেনে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা হচ্ছে। এভাবে ঢালাও মামলার করার কারণে তদন্ত প্রক্রিয়ায় জটিলতা বাড়বে এবং অভিযোগ প্রমাণ করতে সমস্যা হবে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

 

নাম প্রকাশ না করে বাড্ডা ও মতিঝিল এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, বিগত সরকারের পতনের আগে ও পরে কয়েকশ মামলা হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যারা যখন ক্ষমতা পেয়েছেন তারা তাদের মতো করে এসব মামলা করেছেন। হাতেগোনা কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেও হাজার হাজার অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এতে করে ধরপাকড়ের নামে পুলিশকে নতুন করে ‘ঘুষবাণিজ্য’ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলে তারা মনে করেন।

 

তারা বলছেন, পুলিশ ৫৪ ধারার ক্ষমতাবলে গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে অজ্ঞাতনামা আসামিদের তালিকায়। ফলে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কাকে কখন ধরে নিয়ে যায় এ নিয়ে তারা চিন্তিত।

-দেশ রূপান্তর থেকে নেওয়া।


প্রিন্ট