গতকাল রবিবার পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৯৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায়ও অজ্ঞাতনামা আসামি আছে বলে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে এ হিসাব এখনো নিরূপণ করা হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, তৎকালীন সরকারি দলের নেতৃস্থানীয় ৭৪ জনসহ শুধু চলতি অক্টোবর মাসের এ পর্যন্ত ৩ হাজার ১৯৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান লিটন বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে গত দুই মাসে যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোতে নামের যে ফিরিস্তি দেখছি বা যে সংখ্যা দেখছি এটি আগের স্বৈরশাসনের সময়কার মতোই। তখন মানুষকে হয়রানির জন্য যেভাবে মামলা করা হতো সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, এটা পরিষ্কার। আমরা যদি এটা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারি, তাহলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছু কিছু ব্যক্তিকে যেসব মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে তাদের ওই মামলায় সংশ্লিষ্ট থাকার কোনো সুযোগই নেই। এগুলো আমরা দেখছি এবং মনে হচ্ছে মহলবিশেষ এ কাজগুলো করছে।’
উত্তাল জুলাইয়ের ১৮ তারিখ, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীসংলগ্ন কাজলা বিশ্বরোড। কোটা সংস্কার ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সেদিন বিকেলে আন্দোলনে থাকা মো. সাকিব হাসান (২২) নিহত হন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আর পুলিশের মারধর ও গুলিতে। পরদিন ডেমরা সড়কের কাজলা চৌরাস্তা মোড়ে একইভাবে নিহত হন আরেক আন্দোলনকারী মো. জাহাঙ্গীর আলম (৫০)। এ দুটি ঘটনায় ৪৫ ও ৪৬ দিন পর ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন মো. আবু বক্কর নামের এক ব্যক্তি। একই দিনে করা আলাদা দুটি মামলার আসামি একই নাম ও ঠিকানার ব্যক্তিরা। ৪৪২ জন করে দুই মামলায় আসামি সংখ্যা ৮৮৪। দুই মামলার প্রতিটিতে অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা তিন-চার হাজার। অর্থাৎ দুই মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি সর্বোচ্চ আট হাজার। একই ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলা দুটি করেছেন। এজাহারে বাদীর পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের শ্রমিক দলের আহ্বায়ক। যদিও মামলার ব্যাপারে নিহতদের পরিবারের কেউ কিছু জানেন না।
নাম উল্লেখ করে ও নাম ছাড়া এত আসামি এবং নিহতদের পরিবারকে না জানিয়ে মামলা করার বিষয়ে জানতে চাইলে আবু বক্কর বলেন, ‘আমি মোবাইল ফোনে কোনো স্টেটমেন্ট দিতে পারব না। আপনাকে আমার সামনে আসতে হবে।’
৫ আগস্ট ফেনীর ছাগলনাইয়া থানায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার ৪৩ দিন পর ১৭ সেপ্টেম্বর পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ৮-১০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ফেনী পৌর ভবন ও ঢাকা জেলার ধামরাই থানায় হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় করা মামলায় পাঁচ হাজার করে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে সচিবালয়ে ভাঙচুর, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও সেনাসদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় সাধারণ আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে রাজধানীর তিনটি থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ১০ হাজার আনসার সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। এ আটটি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুটি মামলার বাদী একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং চারটি মামলার বাদী পুলিশ। বাকি মামলাগুলোর বাদী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।
পুলিশ সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানায় হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ২৩ আগস্ট মামলা করে। এ মামলায় অজ্ঞাতনামা ৩০ থেকে ৪০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা পূর্ব থানায় একই অভিযোগে ৫০ হাজারের বেশি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে দুটি মামলা হয়েছে।
নূর খান লিটন বলেন, ‘যখন বেশিসংখ্যক অজ্ঞাতনামা আসামি রেখে মামলা করা হয়, তখন হয় এগুলোর বাদী থাকে পুলিশ অথবা রাজনৈতিক কর্মী, যা আমরা আগেও দেখেছি। আসলে আগের অবস্থা আর এখনকার অবস্থার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, এ মামলাগুলো যেন সুষ্ঠুভাবে দায়ের ও তদন্ত করা হয়।’
সুষ্ঠুভাবে মামলার করার ব্যাপারে জোর দেওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তা না হলে এ ধরনের মামলা হাস্যরসের জন্ম দেবে এবং মানুষের আস্থা থাকবে না। এত বড় অপরাধ স্বৈরশাসকরা করেছে যে, তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। এজন্য মামলাগুলো হওয়া উচিত সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে।’
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল এ ধরনের মামলার জন্য ফ্যাসিস্ট শাসনামলের পুলিশকে দুষছেন। সেই সঙ্গে এটা ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারের কোনো ষড়যন্ত্র হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তা না হলে পুলিশ কেন একটা ঘটনায় ৭০০ জনকে আসামি করবে। এতজনের নামও তো জানার কথা নয়। বিএনপিসংশ্লিষ্ট কেউ মামলা করেছে এটার সংখ্যা খুবই কম।’
কায়সার কামাল বলেন, ‘অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে আমি একমত নই। যেমন, প্রথমত মামলাগুলো বিএনপি নেতাকর্মীরা করছে না। মামলাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ করছে। এগুলো নিয়ে পত্রপত্রিকায়ও লেখা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যেভাবে ফ্যাসিস্ট শাসনামলে পুলিশ মামলা করেছে, এখনো একইভাবে চলছে। আর কিছু মামলা করেছেন নিহত ও আহতের স্বজনরা। অবশ্যই গত ১৫ বছরের যে সংস্কৃতি, সেটি রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিংবা প্রতিষ্ঠান, সবকিছুই ফ্যাসিস্ট শাসক পলাতক শেখ হাসিনা ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন। এ ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে এখন নতুনভাবে সবকিছু করতে হচ্ছে। এজন্য একটু সময় দিতে হয়। আমি ঢালাওভাবে আসামি করা সমর্থন করছি না।’
মামলায় বিপুলসংখ্যক আসামি করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে বাদী যখন মামলাটা করেন তখন কিছু অভিযুক্ত যাদের তিনি চেনেন বা তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, তাদের নামীয় আসামি করেন। এ ছাড়া কখনো কখনো বাদী যদি আসামিকে না চেনেন অথবা সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়ে থাকে। তবে যখন অভিযোগপত্র দেওয়া হয় তখন শুধুই অভিযুক্তদের নাম দেওয়া হয়। যখন পুলিশ মামলা তদন্ত করতে থাকে তখন দুটি দিক নিয়েই কাজ করে থাকে।’