কিছুই রেখে যায়নি, সব নিয়ে গেছে, হাড়ি পাতিলও ভেঙে ফেলেছে, রান্না করে যে বাচ্চাদেরকে দুমুঠো খাওয়াবো তারও উপায় নেই”- আক্ষেপ করে সময়ের প্রত্যাশাকে এমনটাই জানাচ্ছিলেন হামলা ও লুটপাটের শিকার মাগুরা সদর উপজেলার গোপালগ্রাম ইউনিয়নের সংকোচখালি গ্রামের আতিয়ার রহমানের স্ত্রী সাথী খাতুন(৩৫)।
বললাম ছেলেরা বাড়িতে নেই তোমরা যাও, তারপরও ঘরের বেড়া ভেঙে ঘরে ঢুকেছে তারা। বেটার বউয়ের ট্রাঙ্ক ভেঙে তিন ভরি সোনা, সাত ভরি রুপা, ৪৫ হাজার টাকা সহ হাড়িতে রাখা চালও নিয়ে গেছে, আক্ষেপ করে বলেন সংকোচখালীর বাকের মিয়ার স্ত্রী মর্জিনা খাতুন(৫০)। তিনি আরো বলেন, ধার দেনা করে ঘরটা দিয়েছে এখনো দেনা শোধ হয়নি। কি যে করবো ভেবে পাচ্ছিনা।
সংকোচখালীর মুজিবর ও আজিবরের নেতৃত্বে কয়েকজন লোক আচমকা আমাকে দাবড় দিলে আমি কোনরকম প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যাই।এ সময় আমার গোয়ালে থাকা প্রায় এক লক্ষ আশি হাজার টাকা মূল্যের একটা গরু তারা নিয়ে যায় এমনটাই বলছিলেন পয়ারি গ্রামের বাসিন্দা ব্যাসদেব কুমার(৪০)। খোকন এবং পান্নার অনৈতিক সালিশে বাধা দিয়েছিলাম, তার জেরে খোকনের নেতৃত্বে মাজু, অহিদুল, ওমর, কালু আমাকে মারধর করে গাছে বেধে রাখে,কান্না জড়িত কন্ঠে এমনটাই বলছিলেন শিয়ালজুড়ি গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ সাহেব বিশ্বাস। ছাত্র জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ সরকার। এ সময় দেশ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদ এবং প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্তরা। স্বভাবতই এ সময় ভেঙে পড়ে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো। দেশের এমন পরিস্থিতে সরকার পতনের দ্বিতীয় দিন (৬ আগস্ট) মঙ্গলবার ভোরে প্রশাসনের অনুপস্থিতির সুযোগে মাগুরা সদর উপজেলার গোপালগ্রাম ইউনিয়নের অন্তত পাঁচটি গ্রামের ১০- ১২ টি বাড়িঘর এবং ৮ -১০ টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর লুটপাট এবং বেশ কয়েকজনকে মারধরের ঘটনা ঘটে।
নিরীহ সাধারণ মানুষের বাড়িঘর ভাঙচুর এবং তাদের করুন আর্তনাদের চিত্র ফুটে উঠেছে গ্রাম গুলোতে। সহায় সম্বল হারিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো আতঙ্কে দিন পার করছে। হামলার শিকার পরিবারগুলোর দাবি তাদের কিছুই রাখা হয়নি, দুর্বৃত্তরা সব নিয়ে গেছে । তারা নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের মালামাল ফেরত সহ এমন নৃশংসতার বিচার চান তারা। ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীদের অভিযোগ স্থানীয় সামাজিক দলের নেতা তৈয়েবুর রহমান খোকন এবং পান্না মোল্লার নেতৃত্বে মাজু, জাহিদুল, ওমর,সাহেব, জুয়েল সহ একদল সন্ত্রাসী ইউনিয়নের সংকোচখালি, গোপালগ্রাম, গোয়ালবাথান, শিয়ালজুরি, এবং পয়ারী সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে নিরীহ গ্রামবাসীদের কে মারধর, তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর এবং লুটপাট চালায়।
এ সময় তারা ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের অন্তত ১০-১২ টি বসত বাড়ি ও ০৮-১০ টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করে টাকা-পয়সা সোনা রুপা মূল্যবান জিনিসপত্র সহ অন্তত ১০ টি গবাদি পশু লুট করে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার নেতৃত্বদানকারী তৈয়বুর রহমান খোকন এবং পান্না মোল্লা ১৯৯৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত এবং বর্তমান তারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ সময় তাদের নেতৃত্বে হত্যা, চাঁদাবাজি, রাহাজানি, অনৈতিক সালিশ বিচারের মাধ্যমে জুলুম নিপীড়ন, অর্থ আত্মসাৎ ডাকাতি ছিনতাই সহ নানা অপকর্ম সংগঠিত হয়েছে বলে জানান এলাকাবাসী। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান ভুক্তভোগী পরিবার গুলো।
গ্রামগুলোর সাধারণ মানুষের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর লুটপাটে নেতৃত্ব দানে অভিযুক্ত তৈয়বুর রহমান খোকন মুঠোফোনে জানান, তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি এবং স্থানীয় একটি সামাজিক দলের নেতৃত্ব দেন। ঘটনার আগের রাতে বিএনপি’র দুই কর্মীকে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা মারধর করলে তারই জেরে ক্ষিপ্ত হয়ে বিএনপি’র সমর্থকেরা বাড়িঘরগুলো ভাঙচুর এবং লুটপাট করেছে। ঘটনার সময় তিনি আক্রান্ত এলাকার বাইরে ছিলেন। তার উপর অহেতুক দোষারোপ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। অপর অভিযুক্ত পান্না মোল্লার মুঠো ফোন বন্ধ থাকায় তার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
গোপালগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ নাসিরুল ইসলাম মিলন জানান, সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি তৈয়েবুর রহমান খোকন এবং পান্নার নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এর সাথে রাজনৈতিক কোন সম্পর্ক নাই। ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিচারও দাবি করেন তিনি।
প্রিন্ট