কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় চলছে খাবার পানির চরম হাহাকার। হস্ত চালিত নলকূপ ও মোটর পাম্পে পানি উঠছে না। ভেড়ামারা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, পানির স্তর নিচে নামার কারণে হ্যান্ড টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। পানি তুলতে এই উপজেলায় ২৪ থেকে ২৫ ফুট পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই উপজেলায় পানির বর্তমান লেভেল দাঁড়িয়েছে ৩০ থেকে ৪০ফুট নিচে। এই কারণে নলকূপ ও পাম্পে মেশিনে পানি মিলছে না।
পানির প্রয়োজন মিটাতে সাবমারসিবল মেশিনের উপর একমাত্র ভেড়ামারা মানুষের শেষ ভরসা। তা ক্রয় করার জন্য প্রতিদিন দোকান গুলোতে ভীড় করছে ভোক্তভোগিরা।
আয়রন মুক্ত গভীর নলকূপ সাবমারসিবল বোরিং করতে ও পাওয়া যাচ্ছে না পানির মিস্ত্রী। পানির জন্য নাভিশ্বাস উঠেছে এখান কার মানুষের জনজীবন। বাধ্য হয়ে শহরের মানুষ গুলো দোকান থেকে বিভিন্ন কোম্পানীর বোতলের ৫লিটার পানি বেশী দামে ক্রয় করে বাড়ি ফিরছেন অনেকেই।
সাবমারসিবল মোটর মেশিন ব্যবসায়িক লালন মিয়া বলেন,পানির চাহিদা মিটাতে গত ৭দিনে তিনি প্রায় ১২শ’ সাবমারসিবল পাম্প মোটর মেশিন বিত্রিু ও বসানো হয়েছে পৌর এলাকাসহ উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে।
গত মার্চ মাস থেকেই পানি ওঠা কমে যায়। আর এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে এই সমস্যা তীব্র হতে শুরু করেছে। পানির সংকটের কারণে সামর্থ্যবান অনেকেই বাড়িতে ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা খরচ করে সাবমারসিবল মেশিনের মোটর বসিয়ে নিচ্ছেন।
ভেড়ামারা পৌর এলাকাসহ উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের খাবার পানির জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। এ যেন মারার ওপর খাঁড়ার ঘা। গত ১মাস ধরে পানি তীব্র সংকটে কষ্ট করেছেন এ উপজেলার হাজার হাজার মানুষ।
ভেড়ামারায় উপজেলা সহকারী পরিসংখ্যান কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, উপজেলায় প্রায় শতকরা ৯৬ জন লোক টিউবওয়েলের পানি পান করেন। কিন্তু উপজেলার প্রায় ২০ হাজার টিউবওয়েলের বেশির ভাগেই মিলছে না পানি। পানি সংকটে গ্রামে গ্রামে চলছে খাবার পানির চরম হাহাকার।
ভেড়ামারা শহরের পৌর এলাকায় ৩২ ফুট। ইউনিয়র বাহাদুরপুর ৩৪ফুট। মোকারিমপুর ২৮ফুট। চাঁদগ্রাম ও বাহিরচর ইউনিয়নে পানির স্থিতিতল ৩০ থেকে ৩৪ ফুটের নিচে পানির স্তর নেমে গেছে। সেখানে ৬ নম্বর হ্যান্ড পাম্পযুক্ত নলকূপ এবং সেন্ট্রিফিউগাল পাম্পযুক্ত নলকূপের পানি উত্তোলনে অসুবিধা হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমানের তথ্যমতে, ভেড়ামারা উপজেলায় সরকারী ও বে-সরকারী মিলে এই উপজেলায় প্রায় ৪০ হাজাব নলকুপ রয়েছে। তার মধ্যে সরকারী ভাবে পূর্বের ৩১শ’১০টি এবং নতুন ভাবে ১শ’৫৬টি নলকুপ বসানো হয়েছে। তার মধ্যে চালু রয়েছে ২৩শ,১৯টি। অকেজো হয়ে আছে ৪শ’৫০টি। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় ওইসব এলাকায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোও ক্রমেই শূন্য হয়ে পড়ছে।
এলাকার সচেতন মহল বলছেন, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মা নদী শুকিয়ে গেছে। পদ্মায় বড় বড় বালু চর পড়ছে। মানুষ পায়ে হেঁটে এখন নদী পাড় হচ্ছেন। পানির অভাবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ভেড়ামারা জিকে সেচ প্রকল্প গঙ্গাকপোতাক্ষ পাম্প মেশিন বন্ধ হয়ে পরেছে গত ২মাস যাবত। অতিরিক্ত দাবদাহ, দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোও ক্রমেই শূন্য হয়ে পড়ছে। গবাদিপশু পালন ও সংসারের কাজকর্মও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানির অভাবে।
সরেজমিনে উপজেলার জুনিয়াদহ ইউনিয়নের মির্জপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। অনেকে টিউবওয়েলের সঙ্গে মোটর বসিয়েছেন। তবে সেখানেও পানির দেখা মিলছে না। ঐগ্রামের শাবানা খাতুন বলেন, গত দেড় মাস ধরে পানির সমস্যা। একমাস আগে টিউবওয়েলের সঙ্গে মোটর বসিয়েছি, তাতেও পানি আসছে না। খাবার পানির জন্য এখন দূরের একটি মাঠের স্যালো মেশিন থেকে পানি আনতে হচ্ছে।
উপজেলার মোকারিমপুর, বাহিরচর, বাহাদুরপুর ও চাঁদগ্রাম ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের পরিস্থিতি একই। টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। পানির সংকটের কারণে সংসারের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে।
চরদামুকদিয়া রশিদা বেগম বলেন, এক জগ পানি তুলতে কমপক্ষে ১০ মিনিট সময় লাগছে। পানির সমস্যার কারণে সাবমারসিবল বসাতে ৪৫ হাজার টাকা জোগার করতে ১টি গরু আর ২টি ছাগল বিক্রি করে দিয়েছি। আশপাশের পুকুর ও খালেও পানি নেই। খুব কষ্টে আছি।
পৌর এলাকা ফারাকপুর গ্রামের গৃহবধূ শামিমা আক্তার বলেন, আগে ২০-৩০ মিনিট মোটর চালালেই বাড়ির ছাদের ট্যাংক পূর্ণ হয়ে যেত। ১৫-২০ দিন ধরে দুই-তিন ঘণ্টা মোটর চালালেও প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। এভাবে নষ্ট হচ্ছে অনেকের বৈদ্যুতিক মোটর।
কাঠেরপুল গ্রামের আলীমদ্দীন বলেন, আমার বাড়ির টিউবওয়েলে প্রায় ১৫/২০ দিন পানি নেই। শুধু আমার বাড়ি নয়, পৌর এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই একই অবস্থা। খাবার পানির জন্য এখানে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, গ্রীষ্মকাল শুরু না হতেই এবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। অথচ, গ্রামে এখন সাবমার্সিবল পাম্পের উপর শেষ ভরসা।
ষোলদাগ গ্রামের কৃষক মাসুদ পারভেজ জানান, বৃষ্টিবাদল নেই। খুব তাপ। কলে (টিউবওয়েলে) ও বোরিংয়ে পানি উঠছে না। মাঠের খেতখোলা নষ্ট হচ্ছে। তাই বৃষ্টি চেয়ে নামাজের মধ্যে আল্লাহকে রাজি খুশি করানোর জন্য কান্নাকাটি করেছি তবু বৃষ্টি মিলছে না।
চক ভেড়ামারা হাফেজিয়া মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক হাফেজ হারুণ আর রশীদ জানান, দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টির কারণে মানুষ, পশুপাখি ও গাছপালাসহ সবাই খুব কষ্টে আছে।
আড়কান্দি গ্রামের বিলকিছ জানান, আমাদের টিউওবয়েলে পানি উঠছে না, তাই দূরদূরান্ত থেকে কারো বাড়ির সাবমার্সিবল অথবা ডিপ টিউবওয়েল থেকে খাবার পানি আনা লাগছে।
ভেড়ামারা উপজেলার পৌর মেয়র আনোয়ারুল কবির টুটুল, ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল রানা পবন,আব্দুস সামাদ,রওশনায়ারা বেগম ও আব্দুল হাফিজ তপন বলেন, উল্লেখ্য ইউনিয়ন গুলোতে অধিকাংশ গ্রামেই টিউবওয়েলে পানি ওঠছে না। অপরিকল্পিতভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা এবং যত্রতত্র পুকুর-খাল-বিল ভরাট করে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ভেড়ামারা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাধারণত পানির স্তর ২২ থেকে ২৫ ফুটের নিচে নেমে গেলে নলকূপে পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এ বছর এই মুহূর্তে এ উপজেলাতেই পানির স্তর নেমে গেছে ২৪ থেকে ২৫ ফুট। যে কারণে অধিকাংশ টিউবওয়েলেই পানি উঠছে না। গ্রীষ্ম মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে ডিপ টিউবওয়েলে ও সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ১কোটি ৪৫লাখ ২ হাজার ৫শ’৯৯টাকা ব্যায় তারা টিউবওয়েলে ও সাবমার্সিবল পাম্প মোট ১শ’৫৬টি চলতি মাসে বসানো হয়েছে, সে গুলোতে পানি উঠিকমতো পাচ্ছে মানুষ।
এদিকে, কালবৈশাখীর মৌসুমেও প্রায় এক মাস বৃষ্টির দেখা নেই। পানির হাহাকার চলছে। বৃষ্টির প্রত্যাশা করে মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) সকালে উপজেলার বাহিরচর ইউনিয়নের বার মাইল নামক গ্রামের বলুর চরে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টির প্রত্যাশা করে এলাকাবাসী ও মুসল্লিরা ‘ইসতিসকার’ নামাজ আদায় শেষে বৃষ্টির প্রার্থনায় চোখের পানি ঝরালো মুসল্লিরা। বিশেষ এই মোনাজাত প্রায় দুই শতাধিক নানা বয়সী মানুষ অংশ নেন।
প্রিন্ট