কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রকিবের নির্দেশে মিলন হোসেন হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন ও নিহত মিলনের ৯ টুকরো লাশ উদ্ধার এবং খুনিদের গ্রেপ্তারে নেতৃত্ব দেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস ও মিডিয়া) পলাশ কান্তি নাথ। তিনি গতকাল দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা কে বলেন, খুনিদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, কুষ্টিয়ার হাউজিং এলাকার চাঁদাগাড়া মাঠের ভেতর ছয়তলা ভবনের ষষ্ঠ তলায় বাসা ভাড়া নিয়ে মিলন হোসেন আউটসোর্সিং এবং বিভিন্ন জনের আইডি হ্যাক করে অনলাইন প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করতেন। বিষয়টি তার পূর্বপরিচিত সজল জানতেন। সজলই বিষয়টি এসকে সজীবসহ অন্যদের জানান। গত ৩১ জানুয়ারি সজল মোবাইল ফোনে মিলন হোসেনকে ডেকে আনেন ওই ভবনের ষষ্ঠ তলায়। পরে তাকে আটকে রাখেন। তারপর খুনিরা জড়ো হন সেখানে। মিলনের কাছে দাবি করা হয় মোটা অংকের চাঁদা। চাঁদা দিতে রাজি না হলে তার ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। একপর্যায়ে মিলন মারা যান। তখন দিশে না পেয়ে সজীবের সিদ্ধান্তে লাশ গুম করতে বাথরুমে নিয়ে ৯ টুকরো করা হয়। এর পর সেসব টুকরো পলিথিন ব্যাগে মুড়িয়ে চটের ব্যাগে ভরে সজীবের নেতৃত্বে ৪টি মোটরসাইকেল যোগে হরিপুর গ্রামের পাশে পদ্মার চরের বালুতে পুঁতে রাখার জন্য রওনা দেন খুনিরা। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, খুনিরা রাত ৯টা ৩৮ মিনিটের সময় হরিপুর ব্রিজ পার হয়ে পদ্মার চরের দিকে যেতে দেখা গেছে। পরদিন মিলন বাসায় ফেরেননি। মোবাইলে না পেয়ে স্ত্রী মিমি খাতুন ওই রাতে মিলনের সন্ধান চেয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পুলিশ জিডির সূত্র ধরে মোবাইলের কললিস্ট ট্রাকিংয়ের মাধ্যমে প্রথমে সজলকে আটক করে। এরপর কুষ্টিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে সজীবসহ অন্য ৫ জনকে আটক করা হয়। তাদের তথ্যে পদ্মা নদীর দুর্গম চরের বিভিন্ন স্থানের বালুর ভেতর পুঁতে রাখা ৯ টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে আরও ৫ জন জড়িত। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সাজু মোহন সাহা জানান, আটককৃতদের তথ্যানুযায়ী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস ও মিডিয়া) পলাশ কান্তি নাথ ও কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল রানার নেতৃত্বে গত শুক্রবার রাত ১২টা থেকে শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত পদ্মার চরে অভিযান চালিয়ে নিহত মিলনের ৯ টুকরো লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য কোনো ঘটনা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নিহত মিলনের মা শেফালী খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার অত্যন্ত ভালো ছেলেকে ওরা অনেক কষ্ট দিয়ে মেরেছে। খুনিদের এমন শাস্তি চাই, যেন আর কোনো মায়ের কোল এভাবে কেউ খালি করতে সাহস না পায়।’
কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি সোহেল রানা বলেন, ৩ জানুয়ারি নিহত মিলনের মা বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর থেকে অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে। মিলন হত্যায় জড়িত কেউ রেহাই পাবে না বলেও জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পূর্ব বাহির মাদি এলাকার মাওলা বক্সের ছেলে মিলন হোসেন লেখাপড়ার পাশাপাশি আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতেন। ১০ মাস আগে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রী মিমি খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং এলাকায় ঈদগাহের পাশে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতেন। পুলিশের দাবি, সেই সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার করে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তিনি অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করতেন।
মিমি খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামীকে ওরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। আমি হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এসকে সজীব কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে ভাঙচুর ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মারধরের অভিযোগে তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেই মামলায় জেলও খাটেন তিনি। এ ছাড়া তার নামে চাঁদাবাজিসহ ১২টি মামলা রয়েছে।
হাউজিং এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এসকে সজীবের নামে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তার নেতৃত্বে একটি কিশোর গ্যাং পরিচালিত হয়। মিলন নামে যাকে হত্যা করা হয়েছে, সেও তাদের মতোই ছিল। তাদের কাজ ছিল ছেলেমেয়েদের ব্লাকমেইল করে চাঁদা দাবি করা।
প্রিন্ট