ঢাকা , রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন করছেন ঢাবির দুই শিক্ষার্থী

উদ্ভাবনকারী তরুণ দুই শিক্ষার্থী এইচএম রঞ্জু ও পীযুষ দত্ত। ছবিঃ সংগৃহীত।

গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে স্বল্প মূল্যে পরিবেশবান্ধব উপায়ে জ্বালানি তেল, বায়োফুয়েল ও জৈব সারসহ সাতটি পণ্য উৎপাদনের প্রযুক্তির নতুন ডিজাইন উদ্ভাবন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দুই শিক্ষার্থী।

উদ্ভাবনকারী তরুণ দুই শিক্ষার্থী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের এইচএম রঞ্জু ও পীযুষ দত্ত।এই উদ্ভাবনী ডিজাইন ব্যবহার করে খরচের প্রায় ২৫ শতাংশ লাভ করা সম্ভব বলেও তাদের দাবি।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি থেকে বের হলেই দেখা যায় রাস্তা-ঘাটে ময়লা আবর্জনা। কলার খোসা, কাগজ, প্লাস্টিকের ব্যাগ অথবা বোতল। দেখা যাবে না ঢাকায় এমন রাস্তা বা পাড়া খুব কমই আছে। চলতে পথে খোলা কন্টেইনারের উপচেপড়া আবর্জনাকে নাকে হাত দিয়ে পাশ কাটানো অথবা ময়লা বহনকারী ট্রাক থেকে কিছু উড়ে এসে গায়ে পড়বে কি না, সেই উদ্বেগ নিয়েই রাস্তায় চলতে হয় পথচারীদের। এক কথায় এসব ময়লা নিয়ে বিপাকে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরের মানুষ।তবে এসব ময়লাকে অভিশাপ থেকে আশীর্বাদে রূপান্তরের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন ঢাবির দুই শিক্ষার্থী। তাদের উদ্ভাবিত নতুন ডিজাইন ব্যবহার করে স্বল্প মূল্যে বর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে  উৎপাদন করা যাবে জ্বালানি তেল, জৈব সার, বায়োফুয়েল, এক্টিভেট কার্বন, পেট্রোলিয়াম গ্যাসের মতো লাভবান পণ্য।

দীর্ঘ তিন বছরের গবেষণার পর গত ২৭ মার্চ তাদের উদ্ভাবিত ডিজাইন থেকে রাজধানীর মাতুয়াইলে তুষারধারা এলাকায় প্রায় সাত কাঠা জমির ওপর বানানো তাদের প্ল্যান্ট থেকে তেল ও গ্যাস উৎপাদন শুরু করেছেন তারা। এছাড়াও এতে আরও সাত প্রকারের দ্রব্য উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানান তারা। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উপকরণ যুক্ত করে তাদের প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎও উৎপাদন করা যাবে। এতে প্রতি ইউনিটে খরচ পড়বে সাড়ে ৫ টাকা থেকে পৌনে ৬ টাকা।

আর্থিক সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান এবিসি কনস্ট্রাকশন কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের সহায়তায় তারা বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের প্ল্যান্টে তৈরি হওয়া প্রতিটি পণ্য মূল্যবান এবং সরকার এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। তাই এই ইউনিক ডিজাইনের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে বলেও আশাবাদী উদ্ভাবকরা। তাদের এ কাজে উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তসলিম-উর-রশিদ, প্রভাষক সাজিদুল ইসলাম ও বাংলাদেশ অ্যাডভান্স রোবটিক্স রিসার্চ সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জিমি মজুমদার।

এ বিষয়ে প্রভাষক সাজিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, তারা যে প্রযুক্তিতে কাজ করছে সেটি এক্সিটিং। তবে তাদের ডিজাইনটা নতুন। ওরা নিজেরাই ডিজাইন করেছে আমরা প্রথম থেকে শুধু উপদেশ দিয়েছি কীভাবে, কী করতে হয়। পাশাপাশি ওদের ওখানে ভিজিট করেছি কয়েকবার। টেকনিক্যাল কিছু সহযোগিতা দিয়েছি।

নিজেদের গবেষণা শুরুর কথা বলতে গিয়ে এইচএম রঞ্জু গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে আমরা দুই বন্ধু গল্প করছিলাম। আমাদের গল্পের এক পর্যায়ে আমরা ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। আর আমি তখন আজিমপুরে থাকতাম আর কার্জনে হেঁটে আসার পথে আমাকে কয়েক জায়গায় ময়লার স্তূপ পার হয়ে আসতে হতো। এছাড়াও আমার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী, সেখান থেকে ঢাকা আসার জন্য আমিনবাজার পার হয়ে আসতে হয়। আমিন বাজারকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বর্জ্যের স্তূপ বললেও ভুল হবে না। আমিনবাজার অতিক্রম করার সময় একজন ঘুমন্ত মানুষও বুঝতে পারে আমি এখন ঢাকায় প্রবেশ করছি৷ এটা আসলেই দুঃখজনক। সবকিছু মিলিয়ে আমার একটু বেশি আগ্রহ ছিল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে।

তিনি আরও বলেন, আর পীযুষ দির্ঘদিন ধরে বায়োফুয়েলের ইফিসিএন্সি কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিল৷ সবকিছু মিলিয়ে আমাদের দুজনের চিন্তা-ভাবনায় প্রায় অধিকাংশই মিল ছিল। এরমধ্যে আমরা কিছু ডকুমেন্ট দেখেছিলাম ইউটিউবের কল্যাণে। সেটা ছিল বর্জ্য এবং এর প্রভাবে প্রাণিকূলের যে ক্ষতি সাধিত হচ্ছে সেগুলো নিয়ে। এসব কিছু বিবেচনা করে আমরা দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলাম একটা সফল গবেষণা করব এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে। শুরু হলো আমাদের পথচলা সম্পূর্ণ স্রোতের বিপরীতে।

এইচএম রঞ্জু তাদের কাজের উদ্দেশের ব্যাপারে বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় মোটিভেশন ছিল স্বাধীনতার ৫০ বছরের এই সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশকে কিছু উপহার দেওয়া এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমিতে একটা আধুনিক মানের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট তৈরি করা, যাতে টুঙ্গিপাড়া হয় জিরো ওয়েস্ট সিটি। আমরা সেই লক্ষ নিয়েই এগিয়েছি এবং  সর্বশেষ গবেষণা প্ল্যান্টের কাজ ১৭ মার্চ ২০২১-এ এসে শেষ হয়। করোনার জন্য উদ্বোধন করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের প্রবল ইচ্ছা আছে লকডাউন শেষ হলে এবং করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা আমাদের এই স্বপ্নের প্ল্যান্টি উদ্বোধন করব। এজন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নুর তাপসের বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছি।

নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গবেষণার অর্থ সংগ্রহ করতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গবেষণার প্রথম দিকে অর্থ আমাদের নিজেদেরকেই বহন করতে হয়েছে। তখন আমাদের আয় বলতে সবেমাত্র দু-একটা টিউশনি শুরু করেছি, এটা আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তারপর আমরা একটা বেসরকারি সাহায্য পেয়েছিলাম যেটা দিয়ে মোটামুটি গবেষণাটা চালিয়ে নিচ্ছিলাম, কিন্তু রেগুলার পড়াশোনাকে চালানোটা কষ্ট হয়ে পড়েছিল। সবকিছুর পরেও আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে মানসিক সাহস, অনুপ্রেরণা। আর এসবের সবকিছুই ছিল আমাদের মাঝে। এর আগেই বলেছি নিজেদেরকে নিজেরাই মোটিভেট করতাম। প্রথম দিকে ভর্ৎসনার স্বীকার হতে হয়েছে অনেকের কাছ থেকে। কিন্তু হাজার ভর্ৎসনার মাঝে আমাদের একজন শ্রদ্ধেয়র কাছ থেকে যে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম সেই এনার্জি আমৃত্যু শেষ হবে না।

এইচএম রঞ্জু বলেন, মাঝে করোনার সময় যখন পুরো বিশ্ব স্থবির তখন আমরাও স্থবির হয়ে পড়েছিলাম। তারপর করোনার ভয়াবহতা কিছুটা কমলে ঢাকায় চলে আসি এবং নতুন করে আবার শুরু করি। টিউশনি বন্ধ থাকায় দুজনেই আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলাম আর এজন্য কিছুদিন ছোলা/মটর বিক্রি করেছি। এরপর আস্তে আস্তে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আমরা নতুন উদ্যোমে প্ল্যান্ট তৈরি শুরু করি।

বর্জ্য থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপাদনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথমে গৃহস্থালির যে বর্জ্য রয়েছে সেটা সংগ্রহ  করে সরাসরি আমাদের প্ল্যান্টের যে সেপারেটিং সিস্টেম আছে সেখানে সেপারেট করা হবে। আর এই অংশে বর্জ্যকে দুইটা ভাগে পৃথক করা হয়। এক, অপচনশীল অংশে প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তেল এক্টিভেট কার্বন ও পেট্রোলিয়াম গ্যাসটা আসে; মেটাল টাইপের যেগুলো আছে সেগুলো ম্যাগনেটিক বেল্টের সাহায্যে আলাদা করা হবে; আর এখানে যদি কাঠ বা মাটি জাতীয় কিছু থেকে থাকে সেগুলো কেমিক্যাল প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে ভাঙা সম্ভব। দুই, যে পচনশীল বর্জ্য রয়েছে সেগুলো থেকে জৈব সার, বায়োফুয়েল এবং ড্রাই আইস পাওয়া যাবে।

এইচএম রঞ্জু আরও বলেন, এখন পর্যন্ত ছোট বড় সব মিলিয়ে আমরা ৩টি প্রোটো টাইপ এবং দুটো পাইলট প্ল্যান্ট তৈরি করেছি। সবশেষ তৈরি করা পাইলট প্ল্যান্ট আমাদের সফলতা এনে দিয়েছে। আমাদের এই প্রযুক্তি ব্যবহারে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে সেই সঙ্গে বেকার সমস্যার সমাধান হবে। আর যেখানে-সেখানে ময়লা আবর্জনার স্তূপ দেখতে হবে না।ভবিষ্যতে এই গবেষণা থেকে আমরা দুজন কতটা লাভবান হব- এই আশা কখনো করিনি। তবে এর সঠিক মূল্যায়ন করা হলে আমরা সবাই অনেক উপকৃত হব।


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ
error: Content is protected !!

গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন করছেন ঢাবির দুই শিক্ষার্থী

আপডেট টাইম : ১০:২০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ মে ২০২১
ডেস্ক রিপোর্টঃ :

গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে স্বল্প মূল্যে পরিবেশবান্ধব উপায়ে জ্বালানি তেল, বায়োফুয়েল ও জৈব সারসহ সাতটি পণ্য উৎপাদনের প্রযুক্তির নতুন ডিজাইন উদ্ভাবন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দুই শিক্ষার্থী।

উদ্ভাবনকারী তরুণ দুই শিক্ষার্থী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের এইচএম রঞ্জু ও পীযুষ দত্ত।এই উদ্ভাবনী ডিজাইন ব্যবহার করে খরচের প্রায় ২৫ শতাংশ লাভ করা সম্ভব বলেও তাদের দাবি।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি থেকে বের হলেই দেখা যায় রাস্তা-ঘাটে ময়লা আবর্জনা। কলার খোসা, কাগজ, প্লাস্টিকের ব্যাগ অথবা বোতল। দেখা যাবে না ঢাকায় এমন রাস্তা বা পাড়া খুব কমই আছে। চলতে পথে খোলা কন্টেইনারের উপচেপড়া আবর্জনাকে নাকে হাত দিয়ে পাশ কাটানো অথবা ময়লা বহনকারী ট্রাক থেকে কিছু উড়ে এসে গায়ে পড়বে কি না, সেই উদ্বেগ নিয়েই রাস্তায় চলতে হয় পথচারীদের। এক কথায় এসব ময়লা নিয়ে বিপাকে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরের মানুষ।তবে এসব ময়লাকে অভিশাপ থেকে আশীর্বাদে রূপান্তরের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন ঢাবির দুই শিক্ষার্থী। তাদের উদ্ভাবিত নতুন ডিজাইন ব্যবহার করে স্বল্প মূল্যে বর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে  উৎপাদন করা যাবে জ্বালানি তেল, জৈব সার, বায়োফুয়েল, এক্টিভেট কার্বন, পেট্রোলিয়াম গ্যাসের মতো লাভবান পণ্য।

দীর্ঘ তিন বছরের গবেষণার পর গত ২৭ মার্চ তাদের উদ্ভাবিত ডিজাইন থেকে রাজধানীর মাতুয়াইলে তুষারধারা এলাকায় প্রায় সাত কাঠা জমির ওপর বানানো তাদের প্ল্যান্ট থেকে তেল ও গ্যাস উৎপাদন শুরু করেছেন তারা। এছাড়াও এতে আরও সাত প্রকারের দ্রব্য উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানান তারা। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উপকরণ যুক্ত করে তাদের প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎও উৎপাদন করা যাবে। এতে প্রতি ইউনিটে খরচ পড়বে সাড়ে ৫ টাকা থেকে পৌনে ৬ টাকা।

আর্থিক সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান এবিসি কনস্ট্রাকশন কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের সহায়তায় তারা বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের প্ল্যান্টে তৈরি হওয়া প্রতিটি পণ্য মূল্যবান এবং সরকার এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। তাই এই ইউনিক ডিজাইনের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে বলেও আশাবাদী উদ্ভাবকরা। তাদের এ কাজে উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তসলিম-উর-রশিদ, প্রভাষক সাজিদুল ইসলাম ও বাংলাদেশ অ্যাডভান্স রোবটিক্স রিসার্চ সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জিমি মজুমদার।

এ বিষয়ে প্রভাষক সাজিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, তারা যে প্রযুক্তিতে কাজ করছে সেটি এক্সিটিং। তবে তাদের ডিজাইনটা নতুন। ওরা নিজেরাই ডিজাইন করেছে আমরা প্রথম থেকে শুধু উপদেশ দিয়েছি কীভাবে, কী করতে হয়। পাশাপাশি ওদের ওখানে ভিজিট করেছি কয়েকবার। টেকনিক্যাল কিছু সহযোগিতা দিয়েছি।

নিজেদের গবেষণা শুরুর কথা বলতে গিয়ে এইচএম রঞ্জু গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে আমরা দুই বন্ধু গল্প করছিলাম। আমাদের গল্পের এক পর্যায়ে আমরা ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। আর আমি তখন আজিমপুরে থাকতাম আর কার্জনে হেঁটে আসার পথে আমাকে কয়েক জায়গায় ময়লার স্তূপ পার হয়ে আসতে হতো। এছাড়াও আমার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী, সেখান থেকে ঢাকা আসার জন্য আমিনবাজার পার হয়ে আসতে হয়। আমিন বাজারকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বর্জ্যের স্তূপ বললেও ভুল হবে না। আমিনবাজার অতিক্রম করার সময় একজন ঘুমন্ত মানুষও বুঝতে পারে আমি এখন ঢাকায় প্রবেশ করছি৷ এটা আসলেই দুঃখজনক। সবকিছু মিলিয়ে আমার একটু বেশি আগ্রহ ছিল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে।

তিনি আরও বলেন, আর পীযুষ দির্ঘদিন ধরে বায়োফুয়েলের ইফিসিএন্সি কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিল৷ সবকিছু মিলিয়ে আমাদের দুজনের চিন্তা-ভাবনায় প্রায় অধিকাংশই মিল ছিল। এরমধ্যে আমরা কিছু ডকুমেন্ট দেখেছিলাম ইউটিউবের কল্যাণে। সেটা ছিল বর্জ্য এবং এর প্রভাবে প্রাণিকূলের যে ক্ষতি সাধিত হচ্ছে সেগুলো নিয়ে। এসব কিছু বিবেচনা করে আমরা দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলাম একটা সফল গবেষণা করব এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে। শুরু হলো আমাদের পথচলা সম্পূর্ণ স্রোতের বিপরীতে।

এইচএম রঞ্জু তাদের কাজের উদ্দেশের ব্যাপারে বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় মোটিভেশন ছিল স্বাধীনতার ৫০ বছরের এই সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশকে কিছু উপহার দেওয়া এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমিতে একটা আধুনিক মানের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট তৈরি করা, যাতে টুঙ্গিপাড়া হয় জিরো ওয়েস্ট সিটি। আমরা সেই লক্ষ নিয়েই এগিয়েছি এবং  সর্বশেষ গবেষণা প্ল্যান্টের কাজ ১৭ মার্চ ২০২১-এ এসে শেষ হয়। করোনার জন্য উদ্বোধন করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের প্রবল ইচ্ছা আছে লকডাউন শেষ হলে এবং করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা আমাদের এই স্বপ্নের প্ল্যান্টি উদ্বোধন করব। এজন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নুর তাপসের বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছি।

নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গবেষণার অর্থ সংগ্রহ করতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গবেষণার প্রথম দিকে অর্থ আমাদের নিজেদেরকেই বহন করতে হয়েছে। তখন আমাদের আয় বলতে সবেমাত্র দু-একটা টিউশনি শুরু করেছি, এটা আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তারপর আমরা একটা বেসরকারি সাহায্য পেয়েছিলাম যেটা দিয়ে মোটামুটি গবেষণাটা চালিয়ে নিচ্ছিলাম, কিন্তু রেগুলার পড়াশোনাকে চালানোটা কষ্ট হয়ে পড়েছিল। সবকিছুর পরেও আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে মানসিক সাহস, অনুপ্রেরণা। আর এসবের সবকিছুই ছিল আমাদের মাঝে। এর আগেই বলেছি নিজেদেরকে নিজেরাই মোটিভেট করতাম। প্রথম দিকে ভর্ৎসনার স্বীকার হতে হয়েছে অনেকের কাছ থেকে। কিন্তু হাজার ভর্ৎসনার মাঝে আমাদের একজন শ্রদ্ধেয়র কাছ থেকে যে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম সেই এনার্জি আমৃত্যু শেষ হবে না।

এইচএম রঞ্জু বলেন, মাঝে করোনার সময় যখন পুরো বিশ্ব স্থবির তখন আমরাও স্থবির হয়ে পড়েছিলাম। তারপর করোনার ভয়াবহতা কিছুটা কমলে ঢাকায় চলে আসি এবং নতুন করে আবার শুরু করি। টিউশনি বন্ধ থাকায় দুজনেই আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলাম আর এজন্য কিছুদিন ছোলা/মটর বিক্রি করেছি। এরপর আস্তে আস্তে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আমরা নতুন উদ্যোমে প্ল্যান্ট তৈরি শুরু করি।

বর্জ্য থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপাদনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথমে গৃহস্থালির যে বর্জ্য রয়েছে সেটা সংগ্রহ  করে সরাসরি আমাদের প্ল্যান্টের যে সেপারেটিং সিস্টেম আছে সেখানে সেপারেট করা হবে। আর এই অংশে বর্জ্যকে দুইটা ভাগে পৃথক করা হয়। এক, অপচনশীল অংশে প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তেল এক্টিভেট কার্বন ও পেট্রোলিয়াম গ্যাসটা আসে; মেটাল টাইপের যেগুলো আছে সেগুলো ম্যাগনেটিক বেল্টের সাহায্যে আলাদা করা হবে; আর এখানে যদি কাঠ বা মাটি জাতীয় কিছু থেকে থাকে সেগুলো কেমিক্যাল প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে ভাঙা সম্ভব। দুই, যে পচনশীল বর্জ্য রয়েছে সেগুলো থেকে জৈব সার, বায়োফুয়েল এবং ড্রাই আইস পাওয়া যাবে।

এইচএম রঞ্জু আরও বলেন, এখন পর্যন্ত ছোট বড় সব মিলিয়ে আমরা ৩টি প্রোটো টাইপ এবং দুটো পাইলট প্ল্যান্ট তৈরি করেছি। সবশেষ তৈরি করা পাইলট প্ল্যান্ট আমাদের সফলতা এনে দিয়েছে। আমাদের এই প্রযুক্তি ব্যবহারে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে সেই সঙ্গে বেকার সমস্যার সমাধান হবে। আর যেখানে-সেখানে ময়লা আবর্জনার স্তূপ দেখতে হবে না।ভবিষ্যতে এই গবেষণা থেকে আমরা দুজন কতটা লাভবান হব- এই আশা কখনো করিনি। তবে এর সঠিক মূল্যায়ন করা হলে আমরা সবাই অনেক উপকৃত হব।


প্রিন্ট