শুভাশীষ ভট্টাচার্য্য তুষাঃ
সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ের সাত পাকে বাঁধার সময় থেকে হাতে শাখার ব্যবহার আদিকাল থেকে চলে আসছে। স্বামীর মঙ্গলের জন্য আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত সনাতন ধর্মাবলম্বী বিবাহিত নারীরা হাতে শাঁখা ব্যাবহার করে আসছেন।বিয়ে হয়েছে অথচ তাদের হাতে শাখা নেই এমনটা কল্পনাতীত।
–
তাই এ প্রয়োজন মেটাতে যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় পাবনার চাটমোহরের হান্ডিয়াল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম ডেফলচরায় শাঁখারিরা কাঁটা শঙ্খ থেকে শাঁখা তৈরী ও নকশাঁ তৈরি করে আসছেন।
–
চাটমোহর পৌর সদর নতুন বাজার হতে প্রায় ১২ কিলোমিটার দুরে ডেফলচরা গ্রামের অবস্থান।বহুকাল ধরে এ গ্রামে বসবাস করে আসছেন শঙ্খ শিল্পের সাথে জরিত শাঁখারিরা। বর্তমানে এই গ্রামে ৩৭ টি শাঁখারি পরিবারের বসবাস। তার মধ্যে ৩০ টি পরিবার শাখা শিল্পের সাথে জড়িত। আর বাকি পরিবারগুলো পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
–
গত ১০ থেকে ১৫ বছরের সঙ্খের দাম বেড়েছে ৪ থেক ৫ গুণ। কাঁচামালের দাম বাড়ার ফলে ক্রেতারা শাখা কিনতে চান না । ফলে শাঁখারিদের লোকসান হয়। অভাবের কারণে দরিদ্র শাঁখারিরা মহাজনের কাছে কম দামে শাখা বিক্রি করতে বাধ্য হয়। সরকারি বেসরকারি ব্যাংক থেকে সহজে ঋণও পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি টানতে টানতে দিশেহারা হয়ে পড়েন এবং একসময় ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। অনেকেই অন্য পেশার সাথে জরিত হয়ে পড়ছেন জীবন ও জীবিকার তাগিদে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে দরকার সরকারি সাহায্য সহোযোগিতা।
–
এ গ্রামের শাঁখারী বিকাশ কুমার ধরের স্ত্রী ৩৫ বছর বয়সী সিমা রানী ধর আজকের পত্রিকাকে বলেন, সপ্তম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর বিয়ে হয়। বিয়ের আগে বাবা মায়ের কাছে শাখায় নকশার কাজ করা শিখি। বিয়ের পরে শশুর বাড়িতে এসে এ কাজই করছি। সকাল থেকে রাত প্রায় ১০ টা পর্যন্ত বাড়ির অন্যান্য কাজের পাশাপাশি শাখায় নকশাঁ তৈরি করি। বিভিন্ন আকারের রেত দিয়ে ঘষে প্রতিদিন চিকন প্রায় ৩০ জোড়া আর মোটা শাখা হলে ২৫ জোড়া তৈরি করা যায়।
–
শাখারি বাবলু কুমার ধর আজকের পত্রিকাকে বলেন, আমার পূর্ব পুরুষেরাও এ পেশায় ছিলো। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে শঙ্খ কাটা অবস্থায় আমাদের দেশে আসে। কাটা শঙ্খ ইলেকট্রিক মোটরের সাহায্যে ফিনিশিং করে আনি। এজন্য মটর মালিককে জোড়া প্রতি ২০ টাকা করে দিতে হয়। এরপর বাড়ির মহিলারা হাতে নকশা তৈরির কাজ করে। পরে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে শাঁখা বিক্রি করি। নকশা ও গুণগত মান অনুযায়ী ৫ শত টাকা থেকে ১৫ শত টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। তবে শঙ্খের দাম বেড়ে যাওয়ার কারনে সব শেষে আমাদের বেশি টাকা থাকে না। যে টাকা হয় তা দিয়ে সংসার চালানোই মুশকিল। বাপ দাদার ব্যবসা জন্য এখনো করছি। তা না হলে কবেই এ ব্যবসা ছেড়ে দিতাম।
–
একই গ্রামের মধুসূদন সেন আজকের পত্রিকাকে জানান, একসময় শাখায় নকশাঁ করে বিক্রি করতাম। এক বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলাম। ঋণের টাকা শোধ করতে গিয়ে টাকার অভাবে ব্যবসা বাদ দিয়ে দিয়েছি। আমার পূর্বপুরুষেরা ও শিল্পের সাথে জড়িত ছিলো জন্য ভালোবাসার কারণে এখনো অন্য পেশায় যেতে পারি নাই। এখন মজুরির ভিত্তিতে মহাজনের কাজ করে দেই। আমরা যান্ত্রিক মোটরের সাহায্যে মহাজনের শাখা ফিনিশিং এর কাজ করি। পরে তারা সেই শাখায় নকশা করে বিক্রি করেন।
–
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোসা নাসের চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন,প্রাচীন এই শিল্পটি টিকিয়ে রাখতে সকল ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে ।সরকারিভাবে ক্ষুদ্র ঋণেরও ব্যবস্থা করব।
প্রিন্ট