কুষ্টিয়ার শহরতলীর লাহিনী জিকে ক্যানাল পাড়ে প্রতিদিন বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জাফরের দোকানে বিশেষ ধরণের চা ও পাউরুটি বিক্রি করা হয়। আশেপাশের এলাকাজুড়ে এ দোকানের খ্যাতি রয়েছে। পোড়ানো পাউরুটি ও চায়ের স্বাদ নিতে প্রতিদিনই ভিড় করেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
জাফরের দোকানের প্রতি কাপ চায়ের দাম ২৫ টাকা। তবে নারকেলের মালায় পরিমাণ ভেদে ৩০ টাকা ও ৫০ টাকায় বিক্রি করেন তিনি। বিকাল থেকে দোকানে চা-প্রেমীদের ভিড় জমে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে নিতে হয় চায়ের স্বাদ। এভাবে বেচাকেনা চলে গভীর রাত পর্যন্ত।
জাফর ইসলাম চা ও পাউরুটি বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এই চায়ের দোকান খোলা থাকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে চা পান করতে আসেন অসংখ্য মানুষ। তবে বিকাল থেকে সন্ধ্যার দিকে দোকানে ভিড় অনেক বেশি থাকে।
জাফর ইসলাম (৩০) কুষ্টিয়া পৌরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের এলাহী পশ্চিমাপাড়ার মৃত খবির উদ্দিনের ছেলে। অভাবের সংসার ছিলো তাদের। অর্থকষ্টে চতুর্থ শ্রেণির গণ্ডি পার হতে পারেননি। সংসারে সচ্ছলতা আনতে ছোট্ট বয়সেই ট্রাকের হেলপারের কাজ শুরু করতে হয়। কিন্তু সংসারে অভাব কোনোভাবেই দূর হচ্ছিল না। একপর্যায়ে চা বিক্রি শুরু করেন জাফর। এই চা তার ভাগ্য বদল করে দিয়েছে। তার দোকানে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার টাকার চা বিক্রি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী অভি তার বন্ধু গৌরব, জিদান ও সূচনাকে সাথে নিয়ে পোড়ানো পাউরুটি ও দুধ চা খেতে এসেছিলেন। অভি বলেন, নদীর পাশে সুন্দর পরিবেশে দুধ চা ও পোড়া পাউরুটি খেতে খুবই ভালো লাগে। আমরা মাঝেমধ্যেই এখানে আসি। আমাদের মতো অসংখ্য মানুষ বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত জাফর মামার দোকানে আসেন।
ব্যস্ততম এই চায়ের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, জাফর চা তৈরি ও পাউরুটি পোড়ানোর কাজে ব্যস্ত। চুলার পাশে জাফরকে ঘিরে রেখেছেন ক্রেতারা। তারা কেউ পাউরুটি, কেউ চা, কেউ কাচের কাপ, কেউ নারকেলের মালায় চায়ের অর্ডার দিচ্ছেন। দোকানে একজন কর্মচারী ও জাফর। চা প্রেমীদের ভিড়ে তাদের ফুরসত নেই। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পরে চা-পাউরুটি হাতে পেয়ে কেউ চুমুক দিচ্ছেন, কেউ সেলফি তুলছেন।
চা বিক্রেতা জাফর ইসলাম বলেন, আমার জন্মেরও আগে থেকেই বাবা লাল চা বিক্রি করতেন। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা চা দোকান ছিল। বাবার উপার্জনের অর্থে আমাদের সংসার ভালো চলতো না। অভাব অনটনের কারণে চতুর্থ শ্রেণির পরে আর পড়ালেখা করা হয়নি। ১২ বছর বয়সে ট্রাকের চালক আপন মেজভাইয়ের সঙ্গে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করি। ২০০৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ট্রাকের হেলপারির কাজ করেছি। এরপর ২০১০ সালে আব্বা স্ট্রোক করে মারা যান। এর ২ মাস পরে পরিবারের সিদ্ধান্তে বাবার ছোট্ট দোকানে চা বিক্রি শুরু করি। ২০১৩ সালে অল্প-অল্প করে দুধ চা বিক্রি শুরু করি। সেই সময় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দুই হাজার টাকার মতো বিক্রি হতো। প্রতিদিন ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা লাভ হতো। ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়ির সামনেই চা বিক্রি করতাম। এরপর লাহিনী জিকে ক্যানাল পাড়ে এই চায়ের দোকান দিয়েছি। আল্লাহর রহমতে ভালোই চলছে ব্যবসা।
তিনি আরও বলেন, ক্যানাল পাড়ে গত তিন বছর আগে চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছি। নিজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চিনি দিয়ে পাউরুটি পোড়ানো ও চা তৈরি করি। প্রতিদিন প্রায় ৩০ কেজি দুধ দিয়ে চা তৈরি করি। আশেপাশের ও দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আমার দোকানে চা খেতে আসেন। বিকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চা-প্রেমীদের ভিড় বেশি থাকে। তবে ছুটির দিনে চায়ের চাহিদা বেড়ে যায়। পরিমাণ ভেদে প্রতি কাপ চা ২৫ টাকা থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার টাকার বিক্রি হয়। স্ত্রী আর এক ছেলে সন্তানকে নিয়ে আমাদের সংসার সুখে-শান্তিতে চলছে।
আরিফুল হক বলেন, বন্ধুরা দলবেঁধে চা খেতে এসেছি। খুব ভিড়। প্রায় এক ঘণ্টা আগে সিরিয়াল দিয়েও চা হাতে পাচ্ছিনা। মানুষের মুখে শুনে এখানে এসেছি। আজকে ভালো লাগলে আগামীতে পরিবারেরর সদস্যদেরকে সাথে নিয়ে আসবো।
স্থানীয়রা বলেন, জাফরের চায়ের স্বাদ স্বাভাবিক চায়ের চেয়ে অনেক বেশি ভালো। প্রতিদিন বিকাল থেকে আশেপাশের এলাকার মানুষ এখানে চা খেতে আসেন। বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাস্টমার আসে। চায়ের ব্যবসা করে সফল ও সচ্ছল হয়েছেন জাফর।
প্রিন্ট