আরমান হোসেনঃ
গাজীপুরের মাটি ও মানুষের নেতা সাবেক মন্ত্রী সাবেক মেয়র, আলহাজ্ব অধ্যাপক এম. এ মান্নান স্যারের ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত।
.
বৃহস্পতিবার (৮ মে ২০২৫ ইং) বিকালে উক্ত মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি মোঃ শওকত হোসেন সরকার, সাধারণ সম্পাদক-এম মঞ্জুরুল করিম রনি, কাশিমপুর থানা বিএনপি’র সভাপতি খন্দকার আলী হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম মাদবর সহ বিএমপি’র অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
.
১৯৫০ সালে ৭ই এপ্রিল গাজীপুর জেলা সদরের দক্ষিণ সালনায় জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান। তাঁর পিতার নাম কছিমউদ্দিন আকন্দ ও মায়ের নাম আতরজান বিবি। তিনি সালনা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি, জয়দেবপুর রাণী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি, ময়মনসিংহ মুসলিম হাই স্কুল থেকে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। পরে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে এসএসসি পাস করেন। তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
.
লেখাপড়ার খরচ মেটাতে কৃষক পিতার কাছ থেকে টাকা নিতেন, পাশাপাশি নিজেও ছাত্রাবস্থায় টিউশনি করেছেন। এভাবেই ময়মনসিংহের শিক্ষাজীবন শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়নে এমএসসিতে ভর্তি হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে টঙ্গী কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন থেকেই শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন। টঙ্গী কলেজ ছেড়ে পরে তিনি গাজীপুর কাজী আজিম উদ্দিন কলেজে যোগদান করেন।
.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন জিয়াউর রহমানের একটি বক্ততায় অনুপ্রাণিত হয়ে এম এ মান্নান রাজনৈতিক অঙ্গনে পদার্পণে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা হলে টঙ্গী কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই সূচনা হয় রাজনৈতিক যাত্রা। তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে (জাগদল) যোগদান করেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে মেজর জিয়ার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের মাটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। এরশাদ জোর করে ক্ষমতা দখল করেন, জনগণের উপর চালায় নৃশংস সৈরাচারী শাসন। সে সময় এম এ মান্নান যুক্ত হয় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনে। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকার পতনের আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় সংগঠক।
.
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের উত্থান শুরু হয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে। অবশ্য এর আগে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি দলীয়ভাবে সালনা গ্রাম সরকার প্রধানের দায়িত্ব পান। পরে জাতীয় গ্রাম সরকারের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিবেরও দায়িত্বে ছিলেন। অধ্যাপক এম এ মান্নান প্রথম ১৯৮৪ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কাউলতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরে তিনি আরও দুই মেয়াদে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন করেও বিজয়ী হন। এই রাজনীতি বদলে দেয় তাঁর জীবনের গতিপথ, হয়ে উঠেন গাজীপুরের মাটি ও মানুষের প্রিয় নেতা, প্রাণের স্পন্দন, একজন নিবেদিত প্রাণ।
.
১৯৯১ সালে গাজীপুর-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী হিসেবে মনোনিত হন। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য, সারা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন এম. এ মান্নান। গাজীপুরবাসীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তৎকালীন মন্ত্রীসভায় তাঁকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি নবগঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও তাঁর প্রভাব ছিল শক্তিশালী। তিনি দলের যুগ্ম মহাসচিব, পরে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং শেষপর্যন্ত দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
.
প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে গাজীপুর মহিলা কলেজ, কোনাবাড়ি ডিগ্রি কলেজ, পুবাইল আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে স্কুল, কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, মন্দিরসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ ও গাজীপুরের উন্নয়ন অগ্রগতিতে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
.
অধ্যাপক এম. এ. মান্নান যৌবন থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত বিএনপি’র সাথে রাজনীতি করেছেন। দলীয় রাজনীতি করলেও তার উদার চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীল মনোভাবের কারণে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে তার অসামান্য গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তার জীবন ছিল কর্মময়, ধ্যান ধারণা ছিল অত্যন্ত সুন্দর, ব্যক্তিগত চরিত্র ছিল সচ্ছল ও সততা সৌরভে উজ্জ্বল। একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ‘নগর পিতা’ খ্যাত যিনি গাজীপুরবাসীর প্রত্যক্ষ লক্ষাধিক ভোটে নির্বাচিত প্রথম মেয়র। নিজ বিশ্বাসে অটল থেকে তা অকপটে প্রকাশ করতে পারা একজন ব্যক্তিত্ব।
.
২০১৩ সালে নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে গাজীপুরের এই প্রাণপুরুষ অধ্যাপক এম. এ. মান্নান টেলিভিশন প্রতীকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন এবং মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তাঁর এই বিজয় ছিল গাজীপুরের অপামার জনসাধারনের ভালোবাসার পূর্ণপ্রতিফলন।
প্রিন্ট