ইসমাইল হোসেন বাবু, স্টাফ রিপোর্টার
আজ ৮ই ডিসেম্বর শুক্রবার। ভেড়ামারা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের ৮ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মিত্র বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারাকে শত্রুমুক্ত করে।
মুক্তিযোদ্ধর সময় ৮নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর আবুল মুনছুরের নেতৃত্বে জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদুল আলমের নেতৃত্বে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ভোর ৭টার সময় ভেড়ামারা ফারাকপুর রেলওয়ে উত্তর গেটের কাছে পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
কুষ্টিয়া-২ আসনের বিএনপি দলীয় সাবেক সাংসদ বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম বলেন,এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদার বাহিনীর মধ্যে অন্ততঃ ১৫ টি খন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরা হলেন- মোকারিমপুর ইউনিয়নের গোলাপনগর গ্রামের রফিকুল ইসলাম (বীর প্রতীক), চাঁদ আলী, লুৎফর রহমান, দক্ষিণ ভবানীপুর গ্রমের গিয়াস উদ্দীন, সাতবাড়ীয়া গ্রামের সোহরাব হোসেন, চাঁদগ্রাম‘র উজির আলী, এবং সাতবাড়ীয়া গ্রামের নজরুল ইসলাম। এছাড়াও এসব যুদ্ধে পাক হানাদারদের নির্মমতার শিকার হয়ে অন্ততঃ শতাধিক মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হয়েছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার আবু দাউদ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষনের পর ভেড়ামারার যুব সমাজ স্বর্তঃফুর্ত ভাবে মুক্তির সংগ্রামে অবর্তীন হওয়ার প্রস্তুতী গ্রহন করে। তখন ফ্রিডম ফাইটার নামে ৫ টি, অ্যাকশন কমিটি নামে ১ টি এবং পলিটিক্যাল নামে ১ টি কমিটি তৈরী করা হয়। ফ্রিডম ফাইটার কমিটির নেতৃত্ব দেন কমান্ডার মহিউদ্দীন বানাত, কমান্ডার আব্দুর রহমান, কমান্ডার মোকাদ্দেস হোসেন, কমান্ডার তোবারক হোসেন। পলিটিক্যাল কমিটিতে নেতৃত্ব দেন কুষ্টিয়া ২ আসনের বিএনপি দলীয় সাবেক সাংসদ বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম এবং এ্যাড. আলম জাকারিয়া টিপু। এ্যাকশন কমিটিতে নেতৃত্ব দেন ভেড়ামারা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল হক দুদুু, বিএম সেকেন্দার, মজিবুর রহমান মাঙ্গন, জহুরুল হক রাজা ও শহীদুল্লাহ।
সাবেক কমান্ডার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড. আলম জাকারিয়া টিপু বলেন, স্বল্প সময়ে প্রশিক্ষন নিয়ে ১৭৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একযোগে চর্তুদিক থেকে একটার পর একটা পাক ঘাঁটি আক্রমন করে ধ্বংস করে রাজাকার আলবদরদের আস্তানা। সর্বশেষ ৭ই ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধা ও মিএবাহিনীর দুর্বার প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে পাক হানাদার বাহিনীরা কামান ফেলে পালিয়ে যায়। সেই সময় পাক সেনারা মাইনস চার্জ ( বোমা) নিক্ষেপ করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজে‘র ১২ নং স্প্যানটির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
ঐ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রায় ৫০/৬০ জন বিহারীও নিহত হন। ওই দিন রাতে মুক্তিপাগল মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে ভেড়ামারায় প্রবেশ করতে থাকেন। বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠেন।
ভেড়ামারা মুক্ত দিবস পালন উপলক্ষ্যে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ভেড়ামারা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন গুলো ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।
আজ ৮ ডিসেম্বর মিরপুর থানা পাকহানাদার মুক্ত দিবস। বাঙ্গালী ও বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এ দিনে বহু ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে জেলার মিরপুর থানা পাকহানাদার মুক্ত হয়েছিল।
সে থেকে এ দিনটি মিরপুর থানা পাকহানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিটের সহকারী কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খানের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিকামী ছাত্রজনতা বর্তমান মাহমুদা চৌধুরী কলেজ রোডস্থ পোষ্ট অফিস সংলগ্ন মসজিদে শপথ গ্রহণ করেন। ৩০ মার্চ শেষ রাতে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে প্রতিরোধ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর জিলা স্কুলে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শুরু হলে পাকবাহিনী নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে যশোর সেনানিবাসের সাহায্য চায়। কিন্তু সেখান থেকে কোন সাহায্য না পাঠানোর সংকেত দিলে হানাদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে তিনটি ডজ গাড়িতে করে গুলি বর্ষণ করতে করতে যশোর সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে।
এ সময় পাক সৈন্যরা ২টি গাড়ী ঝিনাইদহ জেলার গাড়াগঞ্জের কাছে রাসত্মায় কেটে তৈরী মুক্তিবাহিনীর ফাঁদে পড়ে যায় এবং ওই এলাকার বিক্ষুদ্ধ জনতা ও মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়। পাকসেনাবাহিনীর অপর ৬ জন সদস্য ভোরে জিলা স্কুল থেকে মিরপুরের দিকে পালিয়ে আসতে থাকে। প্রথম তারা মশান বাজার সংলগ্ন মাঠের মধ্যে তীব্র প্রতিরোধের মধ্যে পড়ে কিন্তু পাক সৈন্যদের গুলিতে মশানের ডাঃ আব্দুর রশিদ হিলম্যান, গোলাপ শেখ, আশরাফ আলী ও সোনাউল্লাহ শহীদ হন। মিরপুর থানার কামারপাড়ায় বিছিন্ন ৩ পাকহানাদারের সাথে স্থানীয় মুক্তিকামীদের আবারও যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মিরপুর থানার সিপাহী মহিউদ্দিন শহীদ হন। অপর পক্ষে পাকবাহিনীর ওই ৩ সদস্যও নিহত হয়। ৮ ডিসেম্বর ভোরে ই-৯ এর গ্রুপ কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খান ১শ’ ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মিরপুর থানায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা গান স্যালুটের মাধ্যমে উত্তোলন করেন। এর পর ৬৫ জন পাকহানাদার বাহিনীর দোসর ও রাজাকার পাহাড়পুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আত্মসমর্পন করে। মিরপুর হানাদার মুক্ত হওয়ার সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ১৯৭১ সালের এই দিনে বিভিন্ন বয়সের হাজারও নারী-পুরুষ রাসত্মায় নেমে আনন্দ উল্লাস করতে থাকে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর হানাদার মুক্ত দিবস আজ (৮ ডিসেম্বর)। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর আজকের দিনে দৌলতপুর হানাদার মুক্ত হয়।
১৯৭১ সালের এই দিনে দৌলতপুরকে শক্র মুক্ত করে থানা চত্বরে বিজয় পতাকা উড়ানোর মধ্যদিয়ে মুক্তিকামী বীর সূর্য সমত্মানেরা দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করেন। দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকসেনাদের সন্মুখ যুদ্ধসহ ছোট-বড় ১৬ টি যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। এসকল যুদ্ধে ৩৫জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েক’শ নারী-পুরুষ শহীদ হন।
৮ ডিসেম্বর সকালে উপজেলার আল্লারদর্গা এলকায় পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শহীদ হোন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাক সেনারা। এরপর দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত ঘোষনা করেন তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা ৮নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর নুরুন্নবী। দিবসটি পালনের লক্ষে দৌলতপুর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড র্যালি, মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
প্রিন্ট