আলিফ হোসেন, তানোর (রাজশাহী) প্রতিনিধি
রাজশাহীর তানোরে আবাদের ভরা মৌসুমে আলু বীজ সংকটের পর এবার সার নিয়ে হাহাকার পড়েছে। এক দুই বস্তা সার সংগ্রহ করতে গিয়ে চাষিদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। দিতে হচ্ছে বেশি টাকা। এদিকে সার বিতরণে রাজনৈতিক নেতাদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপের কারণে ডিলারদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, এবারই প্রথম একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা ডিলারদের বরাদ্দ থেকে অধিকাংশ সার নিয়ে নিচ্ছে। আবার সেই সার তারা বেশি দামে বিক্রি করছে কৃষকের কাছে। ডিলাররা বলছেন, তারা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ঠিকমতো সার দিতে পারছেন না চাষিদের। এক্ষেত্রে তারা অসহায়।
উপজেলার তালন্দ, কামারগাঁ, সরনজাই ও পাঁচন্দর ইউনিয়নের (ইউপি) একাধিক আলু চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে আলুর চড়া দামের কারণে এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে। এ কারণে আমন ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে জমি তৈরি করছেন চাষিরা।
আলু বীজ সংকটের পর এবার চাষিদের সার কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোথাও চাহিদা মতো সার পাচ্ছেন না তারা।অধিকাংশক্ষেত্রে বস্তা প্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে বেশি দিয়ে সার সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। ফলে আলু আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আলু চাষিদের অভিযোগ, বিসিআইসির ডিলারগণ বরাদ্দের সার না থাকার অজুহাত দেখিয়ে বেশী দামে সার বিক্রি করছে,তবে কোনো রশিদ দিচ্ছে না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে আর সার দেয়া হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, উপজেলায় চলতি মৌসুমে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ হাজার ১১৫ হেক্টর। এসব জমি রোপণের জন্য বীজের প্রয়োজন ২৯ হাজার ৫১০ মেট্রিক টন এবং ফলন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন। তবে চারদিকে আলু চাষের হিড়িক পড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত আরো জমি আলু চাষের আওতায় আসবে।
উপজেলার কামারগাঁও এলাকার আলু চাষি নজরুল ইসলাম বলেন, এক বিঘা আলু আবাদে দুই বস্তা পটাশ, এক বস্তা টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) ও এক বস্তা ডিএপি দানাদার সারের প্রয়োজন। এতে আলুর ভালো ফলনের আশা থাকে। গত ২২ নভেম্বর সকালে কামারগাঁও বাজারের বিসিআইসি সার ডিলার মৌসুমী ট্রেডার্সের দোকানে চাষিরা সার কিনতে গিয়ে দেখতে পান স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা প্রভাব খাটিয়ে ট্রলিতে করে ভরে সার নিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু চাষিদের কাছে সার বিক্রি করা হচ্ছে না। এ সময় শতাধিক আলু চাষি সারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
সার না পেয়ে বিক্ষুব্ধ চাষিরা ডিলারের কর্মচারী বিধান চন্দ্র দাসকে প্রথমে অবরুদ্ধ ও পরে মারপিট করে। পরে ডিলার বিকাশ কুমার দাস নিজে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। শেষে চাষিদের এক বস্তা করে সার দিয়ে শান্ত করা হয়। ডিলার বিকাশ কুমার দাস বলছেন, এবার চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কিছুটা কম। তার ওপর প্রভাবশালী কেউ কেউ বেশি পরিমাণে সার নিতে চাপ দিচ্ছেন। আমরা বাধ্য হয়ে দিচ্ছি। আলু চাষিদের অভিযোগ, কতিপয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কৃষি অফিসের কথা বলে ডিলারদের কাছ থেকে একসঙ্গে ২০-৩০ বস্তা করে সার নিয়ে যাচ্ছেন। ওই সার তারা বেশি দামে চাষিদের কাছেই বিক্রি করছেন।
চৌবাড়িয়া গ্রামের আলু চাষি সাহারুল হক অভিযোগে বলেন, আগে কোনো দিন এমনটা দেখা যায়নি; কিন্তু এবার দেখছি নেতারা প্রভাব খাটিয়ে বরাদ্দ সারের বেশিরভাগ নিয়ে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাষি পর্যায়ে ৫০ কেজির এক বস্তা পটাশের সরকারি দাম এক হাজার টাকা; কিন্তু বর্তমানে এক বস্তা চাষিদের কিনতে হচ্ছে এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা করে। অন্যদিকে চাষি পর্যায়ে এক বস্তা টিএসপির সরকারি দাম এক হাজার ২৫০ টাকা; কিন্তু বর্তমানে একবস্তা টিএসপি সার চাষিদের কিনতে হচ্ছে এক হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি বস্তায় চাষিদের অতিরিক্ত ৩৫০ টাকা গুণতে হচ্ছে। এদিকে ৫০ কেজির এক বস্তা ডিএপি সারের চাষি পর্যায়ে সরকারি দাম এক হাজার ৫০ টাকা। তবে সর্বত্রই এই সার বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৪৫০ টাকা থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা করে। এক বস্তা ডিএপি কিনতে চাষিদের ৪৫০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে।
উপজেলার দুটি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নে (ইউপি) বিসিআইসির অনুমোদিত ৯ জন ও বিএডিসির ২২ জন ডিলার রয়েছেন। বিসিআইসির এসব ডিলারের মাধ্যমে পটাশ টিএসপি ডিএপি ও ইউরিয়া সার বিতরণ করা হয়। তবে বিএডিসির ডিলাররা ইউরিয়া সার বরাদ্দ পায় না। বাকি তিনটি সার তারা বরাদ্দ পায় ও বিক্রি করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, চলতি আলু আবাদে চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী সার বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে কোথাও বিতরণে কোনো সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। সেটি আমরা নিবিড় তদারকির মাধ্যমে মনিটরিং করছি। বেশি দামে সার বিক্রি করলে এবং সেটা প্রমাণিত হলে ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রিন্ট