ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এক নারীকে চেয়ার থেকে তুলে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন যুবক। এসময় ওই নারীকে কিল-ঘুসিও মারতে দেখা যায়। ঘটনাটি ঘটে গত ১৪ আগস্ট দুপুরে কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে। ভিডিওটি তাৎক্ষণিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এক নারীকে এভাবে লাঞ্ছিত করায় জেলাজুড়ে শুরু হয় হইচই। ওই নারীর নাম সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলে দাবি করেন। তবে পুলিশের প্রতিবেদনে পালটে গেছে ঘটনা।
পুলিশ উলটো বলছে, ওই নারীই ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে দলগতভাবে প্রবেশ করে দেশীয় অস্ত্রে মহড়া দিয়েছেন। এ সময় অধ্যক্ষকে শারীরিক লাঞ্ছিত করে আলমারি ভেঙে কলেজের জরুরি কাগজপত্র ও রেজুলেশন বই নিয়ে গেছেন। সেই সঙ্গে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে ক্ষতিসাধন করেন। এভাবেই একটি প্রতিবেদন তৈরি করে আদালতে দাখিল করেছে কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশ। ভিডিও ফুটেজের সঙ্গে এক লাইনও মিল নেই পুলিশের দেওয়া ওই প্রতিবেদনের। পুলিশের এমন তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে জেলাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। মোটা অঙ্কের ঘুস নিয়ে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন বলে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন ওই নারী।
মামলায় আসামি পক্ষের আইনজীবী আব্দুর রউফ বলেন, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ঘটনার উলটো প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। সমস্ত ঘটনার ভিডিও ফুটেজ থাকার পরও পুলিশের এই প্রতিবেদন ইঙ্গিত করে অনেক কিছুই। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফজলুর রহমান বলেন, আমি যেটা সত্য পেয়েছি, সেভাবেই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছি। কোনো ভিডিও ফুটেজের বিষয়ে আমার জানা নেই।
সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষের পদ নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ। ২০১৪ সালে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা নেই মর্মে সাবিনা ইয়াসমিনকে সাময়িক বহিষ্কার করে কলেজ পরিচালনা পর্ষদ। তবে ওই অভিযোগের বিষয়ে ১১ বার তদন্ত করে কোনো সত্যতা পায়নি মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালে কলেজের উপাধ্যক্ষ সাবিনা ইয়াসমিনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু দায়িত্ব না দিয়ে তাকে আবারও সাময়িক বহিষ্কার করে জোরপূর্বক অধ্যক্ষের চেয়ার দখল করে রাখেন তৎকালীন অধ্যক্ষ নওয়াব আলী। সর্বশেষ গত ১৪ আগস্ট সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের আদেশ বাস্তবায়নে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিনকে যোগদানের বিষয়ে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাবিবুল ইসলাম বরাবর একটি চিঠি দেন। ওই চিঠি নিয়ে যোগদান করতে গেলে হামলার মুখে পড়েন ওই নারী। এসময় বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ভিডিও ধারণ করেন।
মামলার এজাহারে ইসলামিয়া কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও মামলার বাদী হাবিবুল ইসলাম দাবি করেন, সাবিনা ইয়াসমিনসহ আসামিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে গত ১৪ আগস্ট কলেজ চলাকালীন দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করে। আসামিরা অধ্যক্ষকে শারীরিক লাঞ্ছিত করে এবং আসবাবপত্র ভাঙচুর করে লক্ষাধিক টাকার ক্ষতিসাধন করে। মামলার সেই এজাহারের সঙ্গে হুবহু মিল রেখে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ। যার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার মিল নেই। ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাবিনা ইয়াসমিনের ওপর হামলাকারী ওই কলেজেরই দর্শন বিভাগের শিক্ষক টিপু সুলতান। তার সহযোগী হিসাবে ছিলেন একই কলেজের চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক লস্কর, মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক আতিয়ার রহমান এবং সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সিরাজুল হক।
কুষ্টিয়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু রাসেল বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছেন। তারপরও কোনো অভিযোগ থাকলে আসামিপক্ষ আদালতকে বলতে পারেন। আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখব।
কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান লাকী বলেন, পুলিশ যদি দৃশ্যমান ঘটে যাওয়া ঘটনাকে সঠিক তদন্ত না করে, তাহলে বিচার প্রার্থীরা সঠিক বিচার পাবে না।
প্রিন্ট