ঢাকা , শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

মাথিন ট্রাজেডিঃ ভালোবাসার এক করুণ পরিণতি

দীপঙ্কর পোদ্দার
ভালোবাসার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন এমন প্রেমিক-যুগলের সংখ্যা এ পৃথিবীতে একেবারে নগন্য নয়। এদের মধ্যে কারো কারো নাম আমাদের কাছে জ্ঞাত আর অধিকাংশেরই নাম অজ্ঞাত। মাথিন ট্র‍্যাজেডি তেমনই অনেকের কাছে অজ্ঞাত।
এটা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের কথা। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার এক জমিদারের কন্যা ছিলেন মাথিন। সেই সময় কলকাতা থেকে বদলি হয়ে ধীরাজ ভট্টাচার্য নামে এক তরুণ পুলিশ অফিসার টেকনাফ থানায় যোগদান করেন। ধীরাজ প্রতিদিন থানা ভবনের সামনে বসে অবসর সময় কাটাতেন। থানা ভবনের সামনেই অবস্থিত একটি কূয়ো। মগ জমিদার ওয়াংথিনের কন্যা মাথিন তার বান্ধবীদের নিয়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় কূয়ো থেকে পানি তুলতে যেতেন। ধীরাজ সুদর্শণা মাথিনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে এক সময় প্রেমে পড়ে যান। পরে তা গভীর প্রেমে রূপান্তরিত হয়। মাথিনের কাছেও ধীরাজ ছাড়া পৃথিবী অসাড় মনে হয়। কিন্তু প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তৈরি করে উভয়ের পরিবার, উভয়ের ধর্ম।
সুদর্শনা মাথিন ছিলেন একজন ‘মগ’। মগ বাংলাদেশের একটি উপ-জাতি। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ জলদস্যু বা আরাকান রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং তার আশেপাশের উপকূলবর্তী কিছু অংশ এরা আক্রমণ করে দখল করে নেয়। রাখাইন উপ-জাতি স্থানীয়ভাবে মগ নামে পরিচিত। এদের আদি নিবাস রাখাইন প্রদেশে। এরা মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী।

আর ধীরাজ ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ধর্মের বিভেদই তাদের মিলনের প্রধান অন্তরায় ছিলো। উভয়ের পরিবারই বিষয়টি মেনে না নেয়ার অনড় অবস্থান গ্রহণ করেন। মাথিনের চাপে এবং ভালোবাসার শক্তির কাছে মগ জমিদার ওয়াংথিন এক পর্যায়ে মেনে নিলেও ধীরাজের পরিবার বিষয়টি মেনে না নিয়ে অনমনীয় থাকে। কিছুদিন পর পুলিশ অফিসার ধীরাজ তার বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটি নিয়ে কলকাতায় যান এবং পিতার আরোগ্য লাভে বিলম্ব হওয়ায় বেশ কিছুদিন তাকে কলকাতায় থেকে যেতে হয়।

অন্যদিকে মাথিন ব্যাপক অনুসন্ধান না করেই ধীরাজের এই কলকাতায় চলে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি মনে করেন ধীরাজ তাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁকি দিয়েছেন। ধীরাজের জন্য দুশ্চিন্তা এবং অন্ন-জল ত্যাগ অব্যাহত রাখায় মাথিন ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে অকাল প্রয়াত হন অপরূপ সুদর্শণা ভালোবাসার কাঙ্গাল মাথিন। পিতার আরোগ্য লাভের পর ধীরাজ যখন টেকনাফ ফিরে আসেন তখন ভালোবাসার একটা অধ্যায়ের শেষ। মাথিনের স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া ধীরাজের আর কিছুই করার ছিলো না। তাইতো ধীরাজ ভট্টাচার্য একজন পুলিশ অফিসার হয়েও কলম হাতে তুলে নিয়ে রচনা করলেন প্রেমের অনবদ্য কাহিনী ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ নামক গ্রন্থ। যাতে তার প্রেমের কাহিনী পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন।

মাথিন যেই কূয়ো থেকে পানি তুলতো বর্তমানে সেটির উপরিভাগে লোহার গ্রিল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কূয়োটির নাম দেয়া হয়েছে ‘মাথিন কূপ’। শতবর্ষ কেটে গেলেও অনেক পর্যটক আজো টেকনাফ গেলে ঐতিহাসিক মাথিন কূপ দর্শন করতে ভোলেন না। ধীরাজ ভট্টাচার্য পরবর্তীতে ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতনামা অভিনেতার মর্যাদা পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। মাথিন নিজের জীবন উৎসর্গ করে প্রমাণ করে গেছেন প্রেম অক্ষয়। তা না হলে আজ শত বছর পরেও মাথিনের নাম উচ্চারিত হতো না। মাথিন ঠাঁই পেতো না ইতিহাসের পাতায়।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক

প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

লালপুরে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সরল আটক

error: Content is protected !!

মাথিন ট্রাজেডিঃ ভালোবাসার এক করুণ পরিণতি

আপডেট টাইম : ৫ ঘন্টা আগে
সময়ের প্রত্যাশা ডেস্ক রিপোর্ট :
দীপঙ্কর পোদ্দার
ভালোবাসার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন এমন প্রেমিক-যুগলের সংখ্যা এ পৃথিবীতে একেবারে নগন্য নয়। এদের মধ্যে কারো কারো নাম আমাদের কাছে জ্ঞাত আর অধিকাংশেরই নাম অজ্ঞাত। মাথিন ট্র‍্যাজেডি তেমনই অনেকের কাছে অজ্ঞাত।
এটা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের কথা। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার এক জমিদারের কন্যা ছিলেন মাথিন। সেই সময় কলকাতা থেকে বদলি হয়ে ধীরাজ ভট্টাচার্য নামে এক তরুণ পুলিশ অফিসার টেকনাফ থানায় যোগদান করেন। ধীরাজ প্রতিদিন থানা ভবনের সামনে বসে অবসর সময় কাটাতেন। থানা ভবনের সামনেই অবস্থিত একটি কূয়ো। মগ জমিদার ওয়াংথিনের কন্যা মাথিন তার বান্ধবীদের নিয়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় কূয়ো থেকে পানি তুলতে যেতেন। ধীরাজ সুদর্শণা মাথিনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে এক সময় প্রেমে পড়ে যান। পরে তা গভীর প্রেমে রূপান্তরিত হয়। মাথিনের কাছেও ধীরাজ ছাড়া পৃথিবী অসাড় মনে হয়। কিন্তু প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তৈরি করে উভয়ের পরিবার, উভয়ের ধর্ম।
সুদর্শনা মাথিন ছিলেন একজন ‘মগ’। মগ বাংলাদেশের একটি উপ-জাতি। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ জলদস্যু বা আরাকান রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং তার আশেপাশের উপকূলবর্তী কিছু অংশ এরা আক্রমণ করে দখল করে নেয়। রাখাইন উপ-জাতি স্থানীয়ভাবে মগ নামে পরিচিত। এদের আদি নিবাস রাখাইন প্রদেশে। এরা মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী।

আর ধীরাজ ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ধর্মের বিভেদই তাদের মিলনের প্রধান অন্তরায় ছিলো। উভয়ের পরিবারই বিষয়টি মেনে না নেয়ার অনড় অবস্থান গ্রহণ করেন। মাথিনের চাপে এবং ভালোবাসার শক্তির কাছে মগ জমিদার ওয়াংথিন এক পর্যায়ে মেনে নিলেও ধীরাজের পরিবার বিষয়টি মেনে না নিয়ে অনমনীয় থাকে। কিছুদিন পর পুলিশ অফিসার ধীরাজ তার বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটি নিয়ে কলকাতায় যান এবং পিতার আরোগ্য লাভে বিলম্ব হওয়ায় বেশ কিছুদিন তাকে কলকাতায় থেকে যেতে হয়।

অন্যদিকে মাথিন ব্যাপক অনুসন্ধান না করেই ধীরাজের এই কলকাতায় চলে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি মনে করেন ধীরাজ তাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁকি দিয়েছেন। ধীরাজের জন্য দুশ্চিন্তা এবং অন্ন-জল ত্যাগ অব্যাহত রাখায় মাথিন ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে অকাল প্রয়াত হন অপরূপ সুদর্শণা ভালোবাসার কাঙ্গাল মাথিন। পিতার আরোগ্য লাভের পর ধীরাজ যখন টেকনাফ ফিরে আসেন তখন ভালোবাসার একটা অধ্যায়ের শেষ। মাথিনের স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া ধীরাজের আর কিছুই করার ছিলো না। তাইতো ধীরাজ ভট্টাচার্য একজন পুলিশ অফিসার হয়েও কলম হাতে তুলে নিয়ে রচনা করলেন প্রেমের অনবদ্য কাহিনী ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ নামক গ্রন্থ। যাতে তার প্রেমের কাহিনী পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন।

মাথিন যেই কূয়ো থেকে পানি তুলতো বর্তমানে সেটির উপরিভাগে লোহার গ্রিল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কূয়োটির নাম দেয়া হয়েছে ‘মাথিন কূপ’। শতবর্ষ কেটে গেলেও অনেক পর্যটক আজো টেকনাফ গেলে ঐতিহাসিক মাথিন কূপ দর্শন করতে ভোলেন না। ধীরাজ ভট্টাচার্য পরবর্তীতে ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতনামা অভিনেতার মর্যাদা পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। মাথিন নিজের জীবন উৎসর্গ করে প্রমাণ করে গেছেন প্রেম অক্ষয়। তা না হলে আজ শত বছর পরেও মাথিনের নাম উচ্চারিত হতো না। মাথিন ঠাঁই পেতো না ইতিহাসের পাতায়।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক

প্রিন্ট