চাহিদা বেশি ও বিক্রি বেশি হয় এমন ৩০টিরও বেশি ওষুধের দাম বেড়েছে। গত এক মাসেরও কম সময়ে এগুলোর দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গত ১৫ দিনে। এসবের মধ্যে ঠান্ডা, কাশি, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট, স্নায়বিক সমস্যা, ব্যথানাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপ, চর্ম ও প্রদাহজনিত, আগুনে পোড়া ও ঘুমের ওষুধসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ রয়েছে।
কিছু কোম্পানির বেশ কিছু ওষুধের তীব্র সংকট চলছে দীর্ঘদিন ধরে। কিছু ফার্মেসি আগে স্টক করা ওষুধও বিক্রি করছে চড়া দামে। কিছু বিদেশি ওষুধের বৈধ সরবরাহ নেই। অবৈধপথে দেশে আসছে, বিক্রিও হচ্ছে বেশি দামে।
ফলে ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। দোকানিদের সঙ্গে বিতর্ক লেগেই থাকছে, দোকানিরা এ কথা জানিয়েছেন। মানুষের খরচ বেড়ে গেছে অথচ আয় বাড়েনি। ক্রেতারা বলছেন, এভাবে ওষুধের দাম বাড়লে কীভাবে চলবে? ক্রেতাদের মধ্যে পেনশনধারী ব্যক্তিও আছেন।
গত কয়েক দিন রাজধানীর মিটফোর্ড, শাহবাগ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসংলগ্ন ওষুধের বাজার ঘুরে, ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ কথা জানা গেছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আশরাফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যে ওষুধগুলোর দাম বেড়েছে, সেগুলোর অনুমতি নেওয়া ছিল ২০১৪-১৫ সালে। অনেক কোম্পানি দাম বাড়িয়েছে। যারা এতদিন দাম বাড়ায়নি তারা এখন মূল্য সমন্বয় করছে।’
সম্প্রতি দুই-তিনটি কোম্পানিকে মূল্য সমন্বয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘১০-১২ বছর আগে দাম বাড়ানোর অনুমতি নেওয়া ছিল। আমরা দাম বাড়াতে কিংবা সমন্বয় করতে চাই না। কিন্তু দাম না বাড়ালে কোম্পানিগুলো উৎপাদন বন্ধ করে দেবে। তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এ কারণে কিছু ওষুধের মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে সমন্বয় করা হয়েছে। সাধারণত ৫-৭ শতাংশ বাড়ানোর অনুমতি দিই। তবে দুয়েকটি পণ্যে তারা কিছুটা বেশি বাড়াতে পারে।’
এখনো ১০-১২টি কোম্পানির মূল্যবৃদ্ধির আবেদন জমা পড়ে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আবেদন আমরা স্থগিত রাখি। দেশের এ অবস্থায় দাম বাড়ানো ঠিক হবে না।’
সর্বোচ্চ দাম বেড়েছে স্কয়ারের : বাজারে যে ৩০টির বেশি ওষুধের দাম বেড়েছে, তার মধ্যে স্কয়ারের প্রায় ১৭টি। এ কোম্পানি সর্বোচ্চ ৬৭ শতাংশ দাম বাড়িয়েছে। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী ব্যথানাশক টোরাক্স-১০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট আগে ছিল ১২, এখন ২০ টাকা। অথচ বাজারে অন্য কোম্পানিগুলোর একই ওষুধের দাম ১২ টাকা। এ ধরনের ওষুধ বেশি চলে রেনেটার রোলাক-১০ ট্যাবলেট। ওটার দাম ১২ টাকাই আছে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের কমেট-মেটফরমিন হাইড্রোক্লোরাইড ৫০০ এমজি ট্যাবলেট আগে ছিল ৪, এখন ৫ টাকা। দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। ডায়াবেটিসের এমজার্ড এম ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ১৫ থেকে ১৮ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। উচ্চ রক্তচাপের রসুভা ৫ এমজি ট্যাবলেট ৪ থেকে ৫ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। ঠান্ডার ফেক্সো ১৮০ এমজি ট্যাবলেট ১০ থেকে ১২ টাকা হয়েছে, বেড়েছে ২০ শতাংশ। ঠান্ডার অ্যালাট্রোল সিরাপ ৩০ থেকে ৩৫ টাকা হয়েছে। দাউদের কমবিসিড ক্রিম ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। একই ধরনের রোগের ডারমাসল-এন অয়েন্টমেন্ট ৯০ থেকে ১০০ টাকা হয়েছে।
কাশির সিরাপ এড্রিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা হয়েছে। ঘুমের ওষুধ এপিট্রা ৭ থেকে ৮ টাকা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক সেফ-৩ ডিএস ৪০০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুলের দাম প্রতিটি ৫০ থেকে বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। ২০ শতাংশ দাম বেড়েছে।
স্কয়ারের বিক্রয় প্রতিনিধিরা ফার্মেসিগুলোতে জানিয়ে দিয়েছেন, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও প্রদাহজনিত চর্মরোগের আরও তিন-চারটি ক্রিমের দামও বাড়বে। তবে কারণ বলেননি।
দাম বেড়েছে আরও ৭ কোম্পানির ওষুধের : একটি ওষুধের সর্বোচ্চ দাম বাড়িয়েছে এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি। তাদের ওষুধ টেট্রাসল ২৫ শতাংশ সলিউশনের (৩০ এমএল) বোতলের দাম ৬৮ থেকে বেড়ে ১২৫ টাকা হয়েছে; ৮৪ শতাংশ বেড়েছে। ইউরিক অ্যাসিডজনিত সমস্যায় ফেবুক্সোস্ট্যাট ৪০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট প্রতি পিস ১২ থেকে বেড়ে ১৫ টাকা হয়েছে; বেড়েছে ২৫ শতাংশ। অ্যান্টিবায়োটিক ফ্লুক্লক্স ৫০০ মিলিগ্রাম ভায়ালের দাম ৫০ থেকে বেড়ে ৬০ টাকা করা হয়েছে; বেড়েছে ২০ শতাংশ।
হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের অ্যান্টিবায়োটিকের ট্যাবলেট রোজিথ ৫০০ মিলিগ্রামের প্রতি পিসের দাম ৩৫ থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে; বেড়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের ওষুধ উইন্ডেল গ্লাস রেসপিরেটর সলিউশনের ৩ এমএল বোতলের দাম ২০ থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে; বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সিস (বিডি) লিমিটেডের ডায়াবেটিসের হিউমুলিন এন ইনজেকশন ৩ মিলি কুইকপেন পাঁচটির এক প্যাকের দাম ৩ হাজার ৫০০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা।
বীকন ফার্মাসিউটিক্যালসের দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনক ফুসফুসের রোগ বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের (সিওপিডি) ডক্সোভেন ট্যাবলেট ২০০ মিলিগ্রামের এক প্যাকেটের দাম আগে ছিল ৬৫০, এখন ৮০০ টাকা; বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
অপসোনিন ফার্মার অ্যাসিডিটির ওষুধ ফিনিক্সের (২০ এমজি) দাম ১৪ শতাংশ বেড়েছে।
পাওয়া যাচ্ছে না অনেক ওষুধ : ওষুধ বিক্রেতারা জানিয়েছেন, বাজারে অনেক দিন ধরেই কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধের তীব্র সংকট চলছে। এ সুযোগে কিছু ফার্মেসি মজুদ করে রাখা ওইসব ওষুধ চড়া দামে বিক্রি করছে। এর মধ্যে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের পোড়া ঘা শুকানোর বার্না ক্রিম, ঘা শুকানোর ব্যাকটোসিন জাতীয় প্রদাহজনিত ও চর্মরোগের ক্রিমগুলো বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। এসিআই কোম্পানির টেট্রাসল সলিউশন ক্রিমও নেই প্রায়। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তার দাম অনেক। জেসন কোম্পানির চেতনানাশক জেসোকুইন ইনজেকশনেরও সংকট। এর মূল্য ৩০ কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। তাদের বাচ্চাদের পটাশিয়াম ক্লোরাইড কেটি সিরাপের দাম ৩০ টাকা, বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়।
ঢাকার বাজারে বিশেষ করে হিউম্যান অ্যালবোমিন ইনজেকশনের সংকট দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে বলে জানান ওষুধ বিক্রেতারা। তারা বলেন, হিমোগ্লোবিন কমে গেলে রোগীকে তাৎক্ষণিকভাবে এ ইনজেকশন দেওয়া হয়। একেকটা ইনজেকশনের দাম ৮-৯ হাজার টাকা। দুটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এটা আমদানি করত। এখন এটা কিনতে হচ্ছে চোরাইপথে আনা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। বৈধ সরবরাহ থাকলে ঝুঁকি থাকত না। এটা ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতে উৎপাদিত হয়। চোরাই মালে গুণগত মানের ঝুঁকি থাকে।
মূল্যনিয়ন্ত্রণে আলাদা অথরিটির পরামর্শ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘কমার্শিয়াল প্রোডাক্টের দাম বাড়া স্বাভাবিক। কারণ অন্যান্য জিনিসপত্রের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। ডলারের দামের তারতম্য হয়। সেজন্য বছরে বছরে দাম বাড়ে। তবে দাম বাড়ায় নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার, যাতে বিক্রেতারাও লাভবান হয়, ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সেজন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) নিয়ন্ত্রণ দরকার। কিন্তু তাদের কন্ট্রোলিং ম্যাকানিজম যথেষ্ট নয়। চাইলেও ডিজিডিএ কিছু করতে পারে না। কারণ এতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রভাব বিস্তার থাকে।’
তিনি বলেন, ‘ওষুধের মতো পণ্যের মূল্যনিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ থাকা উচিত। ভারতে ‘ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথোরিটি’ আছে। আমাদের এখানেও সেকরম একটা আলাদা শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ লাগবে। নেই বলেই এভাবে দাম বাড়ছে।’
ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এম শফিউজ্জামান বলেন, ‘ওষুধের উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে হলে দাম কিছুটা বাড়াতে হয়। যেসব ওষুধের দাম ৬৭-৮৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, সেগুলোর দাম ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে বাড়েনি। এখন সমন্বয় করতে হচ্ছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর যৌক্তিক কারণ ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির অনুমতি দেয় না।’
প্রিন্ট