মিশিকুল মন্ডল, জয়পুরহাট জেলা প্রতিনিধি
অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিকে গ্রামবাংলায় ফসল তোলার ধুম পড়ে, আর নতুন ধান ঘরে তোলার সঙ্গে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। কৃষি-নির্ভর মানুষের মধ্যে উৎসবের ঝংকার বয়ে যায়। যদিও আধুনিক যুগে এসব দৃশ্য প্রায় অদৃশ্য, তবুও বহু গ্রামে এখনও নবান্নের ঐতিহ্য রক্ষা পাচ্ছে। এমন এক উৎসব জয়পুরহাটের কালাই পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের পাঁচশিরা বাজারে মাছের মেলায় রূপ নিয়েছে।
এখানে সাজানো রয়েছে নানা ধরনের মাছ— কাতলা, রুই, মৃগেল, চিতল, ব্ল্যাককার্প, গ্রাসকার্প, কার্ফু, কালবাউশ, ব্রিগেড, সিলভার কার্পসহ আরও অনেক। বাজারে মাছের দোকান সাজানো রয়েছে ভোর থেকে, আর হাঁকডাক ও দরদাম চলছেই। ৫ কেজি থেকে ১৮ কেজি পর্যন্ত বড় মাছ এখানে বিক্রি হচ্ছে, এবং দাম নির্ভর করছে মাছের আকার অনুযায়ী— প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ১২০০ টাকা।
সরেজমিনে জানা গেছে, প্রতি বছর এই সময়, রবিবারে কালাই পৌরসভার পাঁচশিরা বাজারে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে মাছের মেলা বসে। অগ্রহায়ণ মাসের ২ তারিখে এই মেলা আয়োজন করা হয়। মেলায় অংশগ্রহণ করেন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ— মাত্রাই, বিয়ালা, সোমশিরা, শালগুন, গাড়ইল, দুধাইল, কাশিপুর, হাতিয়র, মাদারপুর, জিন্দারপুর, হারুঞ্জা, পুনট, বেগুনগ্রাম, পাঁচগ্রামসহ আশপাশের ৭০-৮০টি গ্রামের মানুষ। প্রতি বাড়িতে মেয়ে জামাইসহ স্বজনদের আগে থেকেই নিমন্ত্রণ করা হয়, এবং অনেক দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন মেলায় মাছ কিনতে আসেন।
এ মেলায় মাছ কেনার পাশাপাশি এক ধরনের প্রতিযোগিতাও চলে— কোন জামাই কত বড় মাছ কিনেছেন, সেটাই আসল কথা। শ্বশুরেরা এতে নীরব অংশগ্রহণ করেন। নবান্ন উৎসব উপলক্ষে প্রায় অর্ধবর্ষ ধরে এই মাছের মেলা চলে, আর এ উপলক্ষে প্রতিটি বাড়িতে মেয়ে-জামাইসহ সকল স্বজনদের দাওয়াত করা হয়। দিনভর মাছ কেনা-বেচার উৎসব চলে, আর মেলা এলাকার এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করে। মেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক দোকানে সাজানো মাছ বিক্রি হচ্ছে, আর ক্রেতারা মাছ কেনার পাশাপাশি সেলফি তুলতেও ব্যস্ত। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছবি পোস্ট করছেন।
এই মাছের মেলায় অন্যান্য পণ্যেরও পসরা সাজানো থাকে, এবং কেউ খালি হাতে ফিরছে না— সবাই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী মাছ কিনে খুশি মনে বাড়ি ফিরছেন। মেলার প্রভাবে পুরো গ্রামে এক ধরনের উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। মেয়ে জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনেরা মেলায় আসেন এবং পুরো এলাকা ঈদের মতো আনন্দিত থাকে। কালাই উপজেলার মানুষ এই দিনটির জন্য পুরো বছর অপেক্ষা করেন।
মেলায় আসা মোছা. রোমানা আক্তার বলেন, “বিয়ের পর থেকেই প্রতিবছর এই মেলা দেখতে আসি। এবারের জন্য আমরা ১২ কেজি ওজনের কাতলা মাছ কিনেছি।”
আর মাত্রাই গ্রামের বাসিন্দা মো. আতিকুর রহমান বলেন, “এই মেলা আমাদের কাছে ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দের। বাড়িতে মেয়ে জামাই, ভাগ্নি জামাইদের দাওয়াত করেছি।”
মাছ কিনতে আসা চঞ্চল বাবু নামে এক ক্রেতা জানান, “এই বছর মাছের দাম একটু বেশি হলেও, আমি ১৮ কেজি ওজনের একটি ব্যাককার্প মাছ কিনে শশুর বাড়ি যাচ্ছি।”
পাশের টাকাহুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আব্দুল মতিন সরকার বলেন, “এ মেলা মাছের জন্য শুধু নয়, এখানে ধান-আলু পণ্যও পাওয়া যায়। এজন্য আশপাশের অনেক লোক এখানে আসে।”
মাছ বিক্রেতা আব্দুল লতিফ জানান, “বড় পুকুর, দিঘি ও নদী থেকে নানা ধরনের মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। কাতলা, রুই, ব্ল্যাককার্প, মৃগেল, ব্রিগেড, সিলভার ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।”
মাছ ব্যবসায়ী মো. রনি বলেন, “সবকিছুর দাম বাড়লেও মাছের বাজারে তুলনামূলকভাবে দাম একটু বেশি, তবে ক্রেতারা আনন্দের সঙ্গে মাছ কিনছেন। বিক্রেতারা প্রতি দোকান থেকে ১০-১৫ মণ মাছ বিক্রি করেন।”
মাছ বিক্রেতা জহুরুল, এনামুল হক ও আলমগীর হোসেন জানান, “এ বছর বিক্রি আগের তুলনায় বেশি, দামও স্বাভাবিক ছিল। মেলায় লোক সমাগম বেশি হলেও বিক্রি মোটামুটি ভালো হয়েছে।”
আরও পড়ুনঃ কুষ্টিয়ায় টাপেন্টাডল ও ফেনসিডিলসহ ২জন আটক
কালাই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তৌহিদা মোহতামিম বলেন, “প্রতি বছর এই মেলা এলাকার মানুষের জন্য একটি বিশেষ উৎসব হয়ে ওঠে। এবারের মেলা ৪০-৫০টি স্টলে অন্তত কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হবে। আমরা মেলা চলাকালীন বিষাক্ত মাছ বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি রাখি।”
প্রিন্ট