বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে ঢাকার বনশ্রীতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে পড়ে যান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রনি আহমেদ (৩০)। পেছন থেকে পুলিশ, উপরে চক্কর দেওয়া হেলিকেপ্টার থেকে আশপাশে নির্বিচারে গুলি ছুড়ছে। ৪জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হন রনি আহমেদ। বিজিবির ছোড়া গুলি তার বাম পায়ের উরুর (হাটুর উপরে ও মাজার নীচে) এপার থেকে ওপারে বের হয়ে যায়। ভাবছিলেন আর বাঁচবেননা। সাথে কালেমা পড়া শুরু করেন। এখন গ্রামের বাড়িতে বিছানায় শুয়ে দিন কাটছে মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে আসা রনি আহমেদের। রামপুরা থানার বনশ্রী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি।
রনি আহমেদ বলেন, ১৯শে জুলাই দুপুরে বাসায় ফেরার সময় দেখি পুলিশ আসছে গুলি করতে করতে চলে যাচ্ছে। নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে লোকজনকে বলেন, যখন ঘরে ঢুকায়ে মারবে সেইদিন বুঝবেন। তার কথায় এ ব্লক,জি ব্লকসহ আশে পাশের লোকজন একত্রিত হয়ে রাস্তায় বেরিকেড দিই। মাগরিবের আযান হবে এরকম মূহুর্তে ড্রোন এসে দেখে যায় কোন কোন ব্লকে লোকজন আছে। আমরা রাস্তা ব্লক করে মেইন রোড থেকে পাশে দাড়িয়ে আছি।
তখন আওয়াজ পেলাম এধারছে ফায়ার করো ওধারছে ফায়ার করো। উপরে হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে গুলি ছুড়ছে। পুলিশ-বিজিবি সোসাইটির মধ্যে ঢুকে এভিনিউ রোডে গুলি করা শুরু করলো। সেফ জোনে যাওয়ার জন্য দুরে গেলাম। সামনে ৪/৫জন ছিল, গুলি লেগে তারা পড়ে গেল। তাদের লাশ নেওয়ার জন্য গুলি করতে করতে ভেতরে ধাওয়া করে চলে আসলো পুলিশ।
সেই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে রনি বলেন,বিজিবির ছোড়া গুলি বাম পায়ের উরুর এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ জায়গা থেকে অনেক রক্তপাত হচ্ছিলো। আশপাশে তেমন কেউ ছিল না, তখনো মনে হয়েছিল আর মনে হয় বাঁচবো না। তখন কালেমা পড়া শুরু করি। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রামপুরার বনশ্রী এলাকার এফ ব্লকের ৩ নম্বর রোডে আশ্রয় নেন।
সেখান থেকে জি ব্লকের ৩ নম্বর রোডের এক মহিলার বাসায় নিয়ে গজ ব্যান্ডেজ দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। তাৎক্ষনিক একজন চিকিৎসক চিকিৎসা দিয়ে চলে যান । পরে এ্যাডভান্স হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি বিপুল সংখ্যক গুলি বিদ্ধ মানুষ। সিট নাই, ফ্লোরে তাদের চিকিৎসা চলছে। আমি ৩ নম্বর রোডের এফ ব্লকের ২৮ নম্বর বাসায় চলে আসি। সেখান থেকে চুপি চুপি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। ২৬ জুলাই ডাক্তার বললো এখানে আইসেননা না,তুলে নিয়ে যাবে।
পরে ঢাকা থেকে এলাকায় ফিরলেও ভয়ে নিজ বাসায় ছিলেননা। পাশের উপজেলায় বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে চিকিৎসা নেন। সেখান থেকে জানতে পারেন পুলিশ খোজ খবর নিচ্ছে ঢাকায় থেকে কারা এলাকায় ফিরেছে। ৫আগষ্ট সেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লে পর নিজ বাড়িতে ফেরেন। আগষ্ট মাসের ১০ তারিখ থেকে বাঘা উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রনি আহমেদ রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের এলাহি বক্স ওরফে আফাং মিয়ার দ্বিতীয় সন্তান। ১বোন ২ভাইয়ের মধ্যে সে ছোট। বাবা পেশায় কৃষক। ২০১৬ সালে ঢাকার ইউনিভারসিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি এ্যান্ড সাইন্স থেকে ইলেট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। পরে ঢাকায় জেড থ্রি করপোরেশনে চাকরিজীবন শুরু করেন। বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানী এনারজিসিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড-এ কর্মরত। এখন গ্রামের বাড়িতে শুয়ে দিন কাটছে তার।
বুধবার (২৮ আগষ্ট’২৪)রনি আহমেদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তাঁর বাঁ ঊরুতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখে-মুখে এখনো ভয়-আতঙ্ক ভর করছে তার। গুলিবিদ্ধ বাম পায়ে শক্তি নেই। আগের মতো আর শক্তি ফিরে পাবেন কি-না,তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। তিনি বলেন, ঘুমের মধ্যে এখনো লাফিয়ে উঠি। গুলির শব্দ আমার কানে বাজে।
শুরুতে তথ্য জানাতে ভয় পাচ্ছিলেন রনি আহমেদ। পরে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে উপর থেকে গুলি করছিল। নিচে পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছিল। নির্বিচারে গুলি করা দেখে মনের টানেই আন্দোলনে যোগ দেন। তারভাষ্য মতে, নিজে অন্তত ৩হাজার মানুষকে গুলবিদ্ধ অবস্থায় দেখেছেন। নিজ হাতে ৭ জনের লাশ বের করেছেন।
পাশে বসে থাকা মা নিলুফা বেগম বলেন, ওর এখন যে অবস্থা তাতে দ্রুত কোনো কাজ করতে পারবে না। গুলিবিদ্ধ পায়ে কোনো শক্তি পাচ্ছে না। ওকে যেভাবে গুলি করেছে তাতে ওর ফিরে আসার কথা ছিল না, আল¬াহ ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাবা এলাহি বক্স ওরফে আফাং মিঞা বলেন, দেশে যেন এমন পরিস্থিতি আর দেখতে না হয়।
বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডাঃ আশাদুজ্জামান বলেন, সেরে উঠতে সময় লাগবে। উপজেলা নির্বাহি অফিসার তরিকুল ইসলাম বলেন,খোঁজ খবর নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রিন্ট