রূপপুর বালিশকান্ড ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন ভবন ধসের ঘটনায় বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স অ্যান্ড কন্সট্রাকশন রাজশাহী মহানগরীতে প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার কাজ করছে। এর নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রভাবশালী মহল। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের দীর্ঘতম একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ। যে প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ কাজেই নিম্নমাণের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারসহ দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঢিলেমির অভিযোগ রয়েছে, তাকে দিয়ে ১ দশমিক ২ কিলোমিটারের ফ্লাইওভার নির্মাণ কতোটা নিরাপদ হবে, সচেতন মহলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে গত রোববার দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনের নির্মাণাধীন ভবনে ধসের ঘটনায় ঠিকাদারি কাজের নথিপত্র অনুসন্ধানে ক্যাম্পাসে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সময় তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারসহ ভবন নির্মাণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখতে চান। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকেও করা হয় জিজ্ঞাসাবাদ।
দুদকের রাজশাহী জেলার উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ভবন ধসের ঘটনায় দুদকের জেলার একটি টিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করছে। ওই টিমের সঙ্গে ভবন নির্মাণের প্রকৌশলীও রয়েছে।
দুদকের উপ-পরিচালক আরো জানান, ভবনটির কারিগরি ত্রুটি চিহ্নিত করতে সিভিল বিভাগের প্রকৌশলীদের সঙ্গে রাখা হয়েছে। তদন্ত শেষে কাউকে অভিযুক্ত পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশনের ‘মজিদপ্রীতি’ ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। এ প্রকল্পে ১০৭ ধরনের কাজ করা হবে। এর মধ্যে ছিলো নগরীতে পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ। সে বছরই ফ্লাইওভারগুলোর নকশা প্রণয়ন ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। ২০২২ সালে এর নকশা চূড়ান্ত করা হলে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে গত বছর রাজশাহী মহানগরীর বর্নালী মোড়, বন্ধগেট ও বিলিসিমলা রেলক্রসিং এলাকার প্রায় ১ কিলোমিটার ২৫৫ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ পায় মজিদ সন্স কন্সট্রাকশন। সম্প্রতি ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্র জানায়, ৫টি ফ্লাইওভারের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ এই ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজ মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনকে দেয়ার ব্যাপারে শুরু থেকেই দরপত্র প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের ওপর চাপ ছিলো। প্রভাবশালী একটি মহলের বিশেষ আগ্রহেই এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট ও ওয়াসায় বিভিন্ন কাজ পায় এই মজিদ সন্স কন্সট্রাকশন। এর ধারাবাহিকতায় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একটি ফ্লাইওভার ছাড়াও ৪১ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শালবাগান কাঁচা বাজার ও ৩৬ দশমিক ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভদ্রা মার্কেট নির্মাণের কাজও দেয়া হয় মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনকে।
এদিকে ২০১৯ সালে বালিশকাণ্ড দিয়ে প্রথম আলোচনায় আসে মজিদ সন্স। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবাসিক ভবনে আসবাবপত্র সরবরাহে অস্বাভাবিক দাম ধরে দুর্নীতি ও কেনাকাটায় অনিয়ম করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। সেখানে একটি বালিশের পেছনে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা ব্যয় দেখানোর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া এ ঘটনা ‘বালিশ দুর্নীতি’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
২০১৯ সালের মে মাসে এই আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের নথি প্রকাশ করা হয়। তখন গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনস্থ পাবনা পূর্ত শাখার কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত পণ্য ক্রয়মূল্যের নথিতে উল্লিখিত ব্যয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেই কেনাকাটার তালিকায় থাকা পণ্যগুলোর দাম বেশি পাওয়া যায়। ওই বছরের ডিসেম্বরে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৩ জনকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।
বাংলাদেশে একটি বালিশের বাজার মূল্য ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি বালিশের মূল্য দেখানো হয় বাজার মূল্যের প্রায় ২০ গুণ। আবাসন প্রকল্পের অধীনে নির্মিত ফ্ল্যাটে বালিশ তোলার খরচ হিসেবে দেখানো হয় ৯৩১ টাকা। খাট কেনার মূল্য ৪৩ হাজার ৩৫৭ দেখানো হয়েছে। প্রতিটি ডাইনিং টেবিল সেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৪ টাকা। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনের নির্মাণাধীন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান হলের ছাদের অংশ ধসে পড়ে। এই অংশটি ছিল ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এবং ৬৯ ফুট প্রশস্ত। জটিল এই কাজে স্পেশাল কোয়ালিটির শাটারিং দরকার হলেও তা দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কনক্রিটের জমাট বাঁধতে সময় লাগে। কলাম ও বিম ঢালাইয়ের পর সেই সময়টাও দেওয়া হয়নি। ঢালাই শক্ত হওয়ার আগেই নতুন করে ঢালাই দেওয়া শুরু হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এই গাফিলতি তখন দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
এদিকে এতোকিছুর পরেও রাজশাহী সিটি করপোরেশন কীভাবে সেই প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখছে, জানতে চাইলে রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর ইসলাম বলেন, সরকার তো তাদের কালো তালিকাভুক্ত করেনি। তাই তাদের কিছুই করার নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন হলের ছাদ ধসের ঘটনার পর আমরা তাদের ব্যাপারে বেশ সতর্ক। কাজের ক্ষেত্রে তাদের সিমেন্ট ও রডের মান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রকৌশলী সার্বক্ষণিক তাদের কাজ তদারকি করছে।
অসমর্থিত একটি সুত্র জানায়, নেপথ্যে প্রভাবশালী এক নেতা ঢাকার মহাখালী এলাকার নিউ ডিওএইচএসে অবস্থিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড রাজশাহীর গুরুত্বপূর্ণ চারটি প্রতিষ্ঠানে ৫৪৭ কোটি টাকার কাজ করছে।
প্রজেক্টগুলোর মধ্যে রয়েছে- ৪৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী ওয়াসায় ১০ তলা ভবন নির্মাণ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন, ৬৪ দশমিক ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ইনস্টিটিউট ভবন নির্মাণ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ে ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ তলা কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ভবন, ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলা এএইচএম কামারুজ্জামান হল নির্মাণ, রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ফ্লাইওভার, ৪১ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শালবাগান কাঁচা বাজার ও ৩৬ দশমিক ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভদ্রা মার্কেট নির্মাণ।
নির্মাণাধীন ওয়াসা ভবনের প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. মাহাবুবুর রহমান জানান, মজিদ সন্সকে ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয় ২০২২ সালের জুন মাসে। ২০২৩ সালে ম্যাট ঢালাইয়ের জন্য তারা যে রড ব্যবহার করে চেয়েছিলো, তা পিডব্লিউডি অনুমোদিত রড নয়। ফলে পরীক্ষা করে ধরা পরে যে, পিডব্লিউডির নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে ওই রডের মান অনেক কম। এরপর থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঢিলেমির কারণে দু’দফা কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
ওয়াসার অসমর্থিত একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই কাজটি মজিদ সন্সকে দেয়ার জন্য দরপত্র প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই তাদের ওপর চাপ ছিলো। সরকারি দলের একজন প্রভাবশালী নেতা ও তার স্ত্রীর বিশেষ আগ্রহ ছিলো এই প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ পাইয়ে দিতে।
ওয়াসার সূত্র জানিয়েছে, এ কারণেই মজিদ সন্সের গাফিলতির বিষয়টি তাদের বিড়ম্বনায় ফেললেও সরাসরি ব্যবস্থা নিতে বেগ পেতে হয়।
রুয়েটের একটি সূত্রে জানা যায়, এখানেও দুটি নির্মাণকাজ মজিদ সন্স অ্যান্ড কন্সট্রাকশন পেয়েছে সরকারি দলের প্রভাবশালী এক কেন্দ্রীয় নেতার চাপে। তৎকালীন উপাচার্যর বিরুদ্ধে এই ক্যাম্পাসে নিয়োগ ও ঠিকাদারি কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে ওই নেতা ও তার পরিবারের নির্দেশ পালন করার অভিযোগ আছে। পরবর্তীতে সাবেক সেই উপাচার্যর বিরুদ্ধে দুদকও তদন্ত শুরু করে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, সাবেক বিতর্কিত উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহানের আমলে শহিদ কামারুজ্জামান আবাসিক হলের নির্মাণকাজটিও মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনকে দেয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ওই কেন্দ্রীয় নেতার নির্দেশে। কাজটি শুরুর পর থেকেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করে। সবশেষ নির্মাণকালে ছাদের ঢালাই ধসে পড়লে বিষয়টি দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
দুদক কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিদ সন্স কন্সট্রাকশন নির্মাণ কাজ কীভাবে পেল এবং কীভাবে তারা কাজগুলো করছে এগুলো সব খতিয়ে দেখার জন্য অনুসন্ধান শুরু করেছেন তারা। রোববার তার অংশ হিসেবে দুদক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অভিযান চালায়। এদিকে রাজশাহীর মানুষ এসব বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য গণমাধ্যম কর্মীদের দৃস্টি আকর্ষণ করেছেন।
প্রিন্ট