হঠাৎ পান বরজে আগুন। দিনের আলোয় কৃষকদের চোখের সামনে মুহূর্তের মধ্যে শতাধিক পানবরজ পুড়ে ছাই। পান বেচার টাকায় রুটি রুজী। আগুন লাগাই সর্বনাশ হয়ে গেছে। কাঁচের পাত্রের মত পান কৃষকদের স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। সাজেদা খাতুন বুক চাপড়িয়ে বললেন কি সর্বনাশ হয়ে গেল আমার। কি খামু। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া খরচ কিভাবে আসবে। এমন করে প্রলাপ করছিলেন তিনি।
১০ মার্চ, রবিবার সকাল সাড়ে ১১ টার সময় ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়টা পাথরঘাট এলাকায় আকস্মিক ভাবে পান বরজ থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে।
স্থানীয় লোকজন আগুন দেখে ভেড়ামারা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে সংবাদ দিলে দ্রুত ঘটনাস্থলে ভেড়ামারা ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট স্থানীয় জনগণের সাথে করে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন।
কিন্তু ফাঁকা মাঠ আর বাতাসের তীব্রতার কারণে দ্রুত আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে মাঠে থাকা কৃষকদের পানের বরজ একের পর এক প্রায় ছয় ঘন্টা ধরে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
- আরও পড়ুনঃ জিকে খালে পানি নেই, বিপাকে বোরো চাষিরা
আগুনের লেলিহান সামাল দিতে ভেড়ামারা মিরপুর দৌলতপুর ও পার্শ্ববর্তী উপজেলা ঈশ্বরদী থেকে ওই এলাকায় প্রায় চারটি ফায়ার সার্ভিস ইউনিট কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিকেল সাড়ে চারটার সময় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এরই মাঝে আনুমানিক প্রায় ৫ কিলোমিটার বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে একশ’ একর জমির পান বরজের পান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পাশাপাশি গমের ফসল, কলা বাগান, ফলজ ও বনজ বাগান স্থানীয়দের কয়েকটি বসত বাড়ি পুড়েছে। যার আনুমানিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪ কোটি টাকা।
স্থানীয় বেশ কয়েকজন কৃষক জানান দেড় কোটি পিলি বরজের পান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, আমার প্রায় ৪০০ পিলি পান পুড়ে গেছ। আমার মতো শতাধিক কৃষকের পানের বরজ আছে যার প্রতিটি বরজে পাঁচশ থেকে পনের শত পিলি ছিল। জমির হিসেবে কারো দুই বিঘা কারো পাঁচ বিঘা। আবার দশ বিঘা জমিতে পান বরজ ছিলো।
স্থানীয় কৃষক বকুল আলী বলেন, তার পান বরজের পানের দাম প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকার মতো স্বপ্ন দেখেছিলাম এবার চৈত্র মাসে পান বিক্রি করে ১ টি পাকা বাড়ি তৈরি করবো বলেও আশা ছিলো। আমার সে স্বপ্ন আজ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এমনি ভাবে আহাজারি করছিলেন সুমন, রহিমদ্দিন, স্বপন, তৌহিদ, নাজমুল এর মতো শত শত মানুষ।
কৃষকের পাশাপাশি স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ, কেউ খোঁজে তার সন্তান কে, কেউ স্বামী কে। আবার স্বামী-স্ত্রী অনেকেই বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে আমার সব শেষ হয়ে গেল, এখন কি করে খাবো। আর কি দিয়ে সমিতির কিস্তি দিবো। আল্লাহ! চলার মতো আমাদের আর কিছুই থাকলো না।
ভেড়ামারা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম জানান, আমরা সকাল সাড়ে ১১ টার সময় সংবাদ পেয়ে ঘটনা স্থলে এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করি। কিন্তু ফাঁকা মাঠের কারণে বাতাসের গতি ছিলো অনেক বেশি। পানি মারলে সঙ্গে সঙ্গে একটা বরজে আগুন ধরে যাচ্ছে। তাই অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা কুষ্টিয়া সদর, মিরপুর ফায়ার সার্ভিস অফিসে সংবাদ দিলে পরপর চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে একসঙ্গে আগুন নেভানোর কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি।
তিনি বলেন, কিভাবে আগুন ধরেছে এখনো বলতে পারবো না। তবে পূর্বশত্রুতা জের ধরে আগুন ধরছে কিনা এটা আমরা খতিয়ে দেখবো।
ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকাশ কুমার কুন্ডু বলেন, আগুনে পুড়ে যেসব পরিবার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনকরেছেন কুষ্টিয়া- ২ (ভেড়ামারা -মিরপুর) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কামারুল আরিফিন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আক্তারুজ্জামান মিঠু, ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আকাশ কুমার কুন্ডু, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান বুলবুল হাসান পিপুল, ভেড়ামারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জহুরুল ইসলাম, বাহাদুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল রানা পবন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ।
ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট এবং স্থানীয় জনগণের প্রচেষ্টায় দীর্ঘ প্রায় ৬ ঘন্টা শেষে কাজ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে, তবুও বেশ কছু সময় ধরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে দেখা যায়। যা প্রমাণ দিয়ে যায় এ যেন ধোঁয়া নয় এটা হাজারো কৃষকের স্বপ্ন পোড়ার চিহ্ন।
প্রিন্ট