কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় খেজুর রস সংগ্রহ করে রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। শীতের শুরু থেকেই বাড়ছে রসের চাহিদা। পাশাপাশি রস জ্বালিয়ে তৈরি করা গুড়ের চাহিদাও অনেক।
শীত মৌসুমে আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য গ্রামাঞ্চলের ঘরে ঘরে খেজুর রস দিয়ে তৈরি হয় হরেক রকমের পিঠা ও পায়েস। পাশাপাশি খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি হয় নানান পিঠাপুলি। তাই বাণিজ্যিকভাবেও খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে গাছিরা।
কুষ্টিয়া জেলার বাইরের গাছিরা এসে দৌলতপুর রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করছে। সুস্বাদু এই খেজুরের রস আগুনে জ্বালিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন রকমের পাটালি ও লালি গুড়। ফলে এসব গাছিদের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। খেজুরের রস বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন এখানকার গাছিরা।
আবহমান গ্রাম বাংলায় শীতের সকালে সূর্য মিটমিট করে আলো ছড়ানোর আগেই আমরা বেরিয়ে পড়ি রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরির দৃশ্য দেখতে। খেজুরের রস আহরণ শেষে হাঁড়িতে সংগৃহীত রস নিয়ে বড় চুলার কাছে ছুটে আসেন গাছীরা। এরপর টিনের বড় পাত্রে রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে শুরু হয় গুড় তৈরির প্রক্রিয়া। আস্তে আস্তে এসব রস শুকিয়ে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার ব্যাবধানে জ্বালানোর ফলে তৈরি হয় লাল গুড়।
গাছিরা জানায়, প্রতিদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যেই খেজুর গাছের সাদা অংশ পরিষ্কার করে ছোট-বড় মাটির কলস বেঁধে রাখা হয় রসের জন্য। এরপর ভোর থেকেই ওইসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। সকালের দিকে কেউবা রস কিনে নিয়ে যায়। আবার এই রস দিয়ে পাটালি ও লালি গুড় তৈরি করে ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা দরে বিক্রি করে থাকেন তারা।
তবে ভেজালের ভিড়ে আসল খেজুরের গুড় পাওয়ায় যেন দায় হয়ে পড়েছে। এতো কিছুর ভিড়ের খাঁটি গুড়ের সন্ধান মেলে কেবল সেসব গাছীদের কাছ থেকে খেজুর গুড় সংগ্রহ করার ফলে।
জানা গেছে, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর এবং মিরপুর উপজেলার গ্রামগুলোতে খেজুর গাছের সংখ্য বেশি। এসব খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ ও গুড় তৈরি করে লাভবান হচ্ছেন গাছিরা। আবার বাড়তি লাভের আশায় এসব এলাকায় আসছেন অন্য জেলার গাছিরাও। খেজুর গুড় তৈরির পেশায় এখন বাড়তি আয়ে খুশি তারা।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় পনের বছর ধরে এভাবে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করি। এরপর এসব রস দিয়ে পাটালি ও লালি গুড় তৈরি করি।’
রাজশাহীর বাঘা থেকে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, এ বছর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ও মিরপুর দুই উপজেলার পোড়াদহ এবং দৌলতখালী এলাকায় দুই শতাধিক গাছ লিজ নিয়ে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করি। এবং উৎপাদিত এই গুড় বিক্রিতে কোন ঝামেলা নেই। সকালের দিকে ক্রেতারা এসে নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যায়। তবে তিনি অভিযোগ করে বলেন, এলাকার কিছু খারাপ মানুষ থাকে তারা রাতের আধারে রস খেয়ে আবার হাড়ি ভেঙে ফেলে রাখে। এতে করে আমাদের বছরে এক থেকে দেড়শ হাড়ি আবার নতুন করে কিনতে হয়।
নাটোর থেকে আসা নাজমুল নামে আরেক গাছি জানান, শীত মৌসুমের শুরু থেকেই খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করা হয়। শীতের প্রায় চার মাস রস সংগ্রহ করা যায়। এই রস থেকে বিভিন্ন রকমের পাটালি ও লালি গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে আমরা সংসার চালাই। তিনি আরও বলেন, শীতের পিঠা ও পায়েসের জন্য খেজুরের রস ও গুড়ের বাড়তি চাহিদা রয়েছে।
স্থানীয় খেজুর রস ক্রেতা অন্ময় রহমান জানান, ‘শীতের সকালে গাছ থেকে নামানো কাঁচা রসের স্বাদ বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এছাড়াও জ্বাল দেওয়া রসের তৈরি বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার অতুলনীয়। এখান থেকে রস কিনে বোতলে করে বাড়ির জন্য নিয়ে যাচ্ছি বলেও জানান তিনি।
রুলি নামে এক গুড় ক্রেতা জানান, খাঁটি গুড় পাওয়ার আশায় এখানে আসলাম। রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করে প্রতি কেজি গুড় ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা করে কিনলাম। আসলে বর্তমানে ভেজালের কারনে খাঁটি জিনিসের প্রাপ্যতা একটু মুশকিল হয়ে গেছে। তাই এখানে এসে গুড় কিনতে পেরে ভালো লাগছে।
স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষক গোলাম মোস্তফা জানান, খেজুরের বহুল ব্যবহার নিয়ে বর্ণনার শেষ নেই। রস দিয়ে নানা রকম পিঠা, পায়েস, গুড়, কুটির শিল্প, আয় ও কর্মসংস্থান হয়। সার্বিক বিবেচনায় খেজুর সমধিক গুরুত্ববহ একটি প্রজাতি।
কুষ্টিয়ার পরিবেশবিদ গৌতম কুমার দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা কে বলেন, খেজুর পরিবেশবান্ধব, স্থানসাশ্রয়ী একটি বৃক্ষ প্রজাতি। এ প্রজাতি দুর্যোগ প্রতিরোধী বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে খামারির আর্থিক লাভ ও স্বাবলম্বী হওয়ার দৃষ্টান্ত বেশ সুপ্রাচীন। গ্রামীণ অর্থনীতি এবং মৌসুমি কর্মসংস্থানে খেজুর গাছের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে।
- আরও পড়ুনঃ মাগুরা হাজীপুরে দুই ও তিন ফসলী জমির মাটি কেটে ঘের খননের কারণে ফসলের ক্ষেত নষ্ট হওয়ার অভিযোগ কৃষকদের
বিশেষ করে শীতকালে বাংলাদেশের সর্বত্রই খেজুর রস, খেজুর গুড় দারিদ্র্য বিমোচনসহ বাঙালি সংস্কৃতিতে রসঘন আমেজ লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের মাটি ও কোমল প্রকৃতি খেজুর গাছ বেড়ে ওঠার জন্য বেশ উপযোগী। রাস্তা, বাঁধ, পুকুর পাড়, খেতের আইল এবং আবাদি জমিতে এ বৃক্ষ বেশ ভালো জন্মে।
প্রিন্ট