চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে চাষের সময় আর খরচ দুটোই কম হওয়ায় কৃষকের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সরিষা চাষ। গত কয়েক বছরে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ফলে শস্যটির ফলনও আগের চেয়ে বেড়েছে। এ কারণে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে দিন দিন বাড়ছে সরিষার চাষ। কৃষি প্রণোদনার আওয়াত ও বাজারে দাম ভালো থাকায় সরিষায় আশার আলো দেখছেন কৃষকরা।
কৃষি বিভাগ বলছে, প্রচলিত দেশি সরিষার চেয়ে বারি ও বিনার উদ্ভাবিত সরিষার জাতগুলোর ফলন বেশি। এ কারণে এতে চাষিরাও আগ্রহী হচ্ছেন। অনেকেই আমন ধান সংগ্রহের পর জমি ফেলে না রেখে সরিষা চাষ করছেন। এরপর আবার বোরো ধান রোপণ করতে পারছেন। এতে একই জমিতে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদন হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কয়েক বছরে বেশকিছু নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, বিনার সরিষা হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১ দশমিক ৮ টন। জীবনকাল মাত্র ৮০-৮৫ দিন। বাড়তি ফলন ও কম সময়ের কারণে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
এছাড়া কৃষি বিভাগ থেকেও সরিষা চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে চাষিদের। ফলে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সবুজের মাঠজুড়ে হাতছানি দিচ্ছে মনোমুগ্ধকর হলুদ রঙের সরিষা ফুলের।
এই বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতে দেখা মিলছে সারি সারি মৌ বাক্স । জমির পাশেই বাক্স বসিয়ে মৌচাষ করছে কয়েকটি এলাকায়। মৌমাছির মাধ্যমে সরিষা ফুলের পরাগায়নে সহায়তা হচ্ছে। এতে মধু চাষের পাশাপাশি সরিষার উৎপাদনও বাড়ছে। সরিষা ও মৌচাষি উভয়েই লাভবান হচ্ছেন।
এদিকে ফুলে ফুলে শোভা পাচ্ছে সরিষার মাঠ। সরিষা চাষি এবং লোকজনের কাছে আর্কষণীয় হয়ে উঠেছে উপজেলার বিস্তীর্ণ সরিষার মাঠ গুলো ।
উপজেলার পার্বতীপুর ইউনিয়নের আড্ডা কলেজ পাড়া ও দায়েমপুর গ্রামের কৃষক কামরুজ্জামান , মোঃ আব্দুল হামিদ, আহসান হাবিব ও আনারুলসহ কয়েকজন কৃষক জানান, সরিষা লাভজনক ফসল। দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে ক্ষেত থেকে ফলন উঠে। আমন ধান কাটার পর বোরো আবাদ পর্যন্ত আমরা জমি গুলো পতিত ফেলে রাখতাম এবার আমন ধান কাটার সাথে সাথেই জমি চাষ দিয়ে সরিষা বীজ বপন করেছি। সরিষা উঠে গেলে ওই জমিতে আবার বোরো ধান আবাদ করতে পারবো। তাই এ সময়টাতে জমি পতিত না রেখে সরিষা চাষাবাদকে তারা উত্তম মনে করছেন। অন্যদিকে চাষিরা বলছেন, সরিষা চাষে তারা কৃষি বিভাগ থেকে বীজ এবং সার পেয়েছেন।
ওই এলাকার আরেক কৃষক হাকিম জানান, গত বছর তিনি চার বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছিলেন। ১৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে পেয়েছিলেন ২৪ মণ সরিষা। খরচ বাদ দিয়ে মুনাফা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এবার সরিষা চাষে তারা কৃষি বিভাগ থেকে সঠিক সময়ে বীজ এবং সার প্রণোদনা পেয়েছেন। বর্তমানে গাছে গাছে ফুলে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এ অঞ্চলে এবার সরিষার ফলন ভালো দেখা যাচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ তানভীর আহমেদ সরকার জানান, সরিষার আবাদ বাড়াতে কৃষকদের সরকারিভাবে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে উপজেলার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ হাজার ৯৫০ কৃষককে এক কেজি করে সরিষা বীজ, ডিএপি সার ১০ কেজি ও এমওপি সার ১০ কেজি করে দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরে উপজেলায় ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে যা লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে প্রায় ৬৯০ হেক্টর বেশী, চলতি বছরে উপজেলায় ৯ হাজার ৫৮৬ মেঃ টন উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এই উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছি।
এরই মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় সরিষার ফলন বৃদ্ধি ও মধু উৎপাদনের জন্য মৌ বাক্স স্থাপনের লক্ষ্যে মৌ চাষিদের মাঝে প্রণোদনার আওতায় উন্নত মানের মৌ বাক্স বিতরণ করেছি। গত অর্থ বছরে মৌ বাক্স ছিলো ৫০০টি তাতে মধু উৎপাদন হয়েছিলো প্রায় ১৪ হাজার ১০০ কেজি, চলতি অর্থ বছরে মৌ বাক্স বসানো হয়েছে ১ হাজার যাতে মধু উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার কেজি। তিনি আরো জানান, এবার কৃষকদের সঠিক সময়ে প্রণোদনা বিতরণ করতে পারায় এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সরিষা ও মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করছি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপ-পরিচালক ড. পলাশ সরকার জানান, মাঠ দিবস করে সরিষা চাষের আরোও গুরুত্ব, তেল হিসেবে সরিষার উপকারীতা ও উপযোগীতা এবং সরিষা সংগ্রহকালীন সময় ও সংগ্রহোত্তর করণীয় সম্পর্কে উপস্থিত কৃষকদের পরামর্শ প্রদান করে আসছে। তাছাড়া সরিষা চাষাবাদে অন্যান্য ফসলের চেয়ে খরচ এবং শ্রম কম লাগে। তবে এবার জেলার সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছি।
জানতে চাইলে বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম দৈনিক সময়ের প্রত্যাশাকে বলেন, ‘ভালো জাত সম্প্রসারণ করে কৃষকের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রকল্পটি কাজ করে যাচ্ছে। তিন-চার স্তরের শস্য বিন্যাসের মধ্যে সরিষাকে রেখে কৃষি পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ প্রকল্প পাঁচ বছরের। আশা করছি এর মধ্যেই সরিষার উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা যাবে। আমদানীকৃত তেলের উপর নির্ভর না হয়ে আমরা যদি নিজ নিজ এলাকায় পতিত জমি ফেলে না রেখে সরিষার চাষ করতে পারি তাহলে আমাদেরকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে আর তেল আমদানি করতে হবে না।
প্রিন্ট