রাজনীতি, কূটনীতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অভিন্ন মত হচ্ছে, বিদ্যমান সংবিধান বহাল থাকলে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপিসহ সমমনারা অসাংবিধানিক, অনির্বাচিত কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করলেও বর্তমান সংবিধান বহাল থাকায় সেটি কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তাদের দাবি মেনে সংবিধান সংশোধন করারও কোনো সম্ভাবনা নেই বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।
ইতোমধ্যে সারাদেশেই শুরু হয়েছে নির্বাচনী ডামাডোল। নভেম্বরে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পরই গন্তব্যের পথে যাত্রা শুরু করবে নির্বাচনী ট্রেন। কোনো দল নির্বাচনে আসবে, কি আসবে না- সেটির জন্য নির্বাচনী ট্রেনটি আর থামানোও সম্ভব নয়। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আগেই সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন। তাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতির কাজ শেষ করতে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। অতীতের নির্বাচনগুলোর তারিখ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হলে সেক্ষেত্রে ৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবারই অনুষ্ঠিত হতে পারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
গত সোমবার কিশোরগঞ্জে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ইসির প্রস্তুতির কথা স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করবে কি-না, তা রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। এর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন তথা আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করব। নভেম্বরের শুরুতে হয়ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা হতে পারে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমরা নির্বাচন করব। সংবিধানের মধ্য থেকে আমরা সবকিছু করছি। আমরা চাই, সবাই মিলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ইতোমধ্যে ৬৬ স্থানীয় পর্যবেক্ষক ও সংস্থাকে অনুমোদন দিয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেসব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লাগে যেমন স্বচ্ছ ব্যালট বক্স, সিল, স্ট্যাম্প প্যাড, অমোচনীয় কালি, অফিসিয়াল সিল সংগ্রহের ক্রয়পত্রও তৈরি করছে। আগামী নভেম্বরের মধ্যে এসব নির্বাচনী জিনিসপত্র সংগ্রহের কাজ শেষ করবে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
ইসি সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের আগেভাগেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। চলতি মাসের শেষ বা আগামী মাসের শুরু থেকে ধাপে ধাপে বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও ইউএনওদের এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে এসব কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ দিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জননিরাপত্তা বিভাগকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ সপ্তাহেই এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠাতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই এবার মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেবে নির্বাচন কমিশন। প্রশিক্ষণের কারণ ও ধরন সম্পর্কে ইসি বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নির্বাচনী আইন ও বিধির সংশোধন, হালনাগাদ তথ্য অবহিতকরণ এবং সার্বিক নির্দেশনা দিতে এ আয়োজন করা হচ্ছে। বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের চলতি মাসের শেষে কিংবা আগামী মাসের শুরুতে এ প্রশিক্ষণ শুরু হবে। প্রশিক্ষণে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বার্তা দেওয়া হবে। মাঠ পর্যায়ের বিদ্যমান কর্মকর্তাদের বড় অংশই আগামী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন- এমনটা ধরেই এ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।
সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটের মাঠের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা বা ভোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের আচরণ পক্ষপাতমূলক হলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, সম্প্রতি জামালপুরের ডিসি প্রত্যাহারের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে অনুরোধ করার পর সেই কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে সব জেলা প্রশাসককে সতর্ক করার জন্যও বলা হয়েছে। নির্বাচন, জনগণ, ইসি ও সরকারের আস্থার স্বার্থে এটা করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’
চলতি একাদশ সংসদের প্রথম বৈঠক বসেছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সেই হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, সংসদ বহাল রেখে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে এর পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যে কারণে, এ বছরের ১ নভেম্বর থেকে সেই ৯০ দিন গণনা শুরু হবে। সেই ৯০ দিনের আগে সময় রয়েছে আর মাত্র ৪২ দিন। সংবিধানে থাকা নির্বাচনী সময়সীমা অনুযায়ী এই ৪২ দিন পরে শুরু হয়ে যাবে নির্বাচনের ক্ষণ গণনা।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, আগামী বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। সাধারণত ভোটগ্রহণের দিনের আগে ৪২ থেকে ৪৫ দিন সময় হাতে রেখে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করে থাকে নির্বাচন কমিশন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে। এই সময় ধরেই নভেম্বরের যেকোনো সময় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করতে পারে ইসি।
বিদ্যমান সংসদ অনুযায়ী জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্ভব না হলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যেও নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে মেয়াদপূর্তির আগে সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই আগামী নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে তা ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি বড় রাজনৈতিক দল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে।
একাধিক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন- সংসদ ভাঙ্গবে না। বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্তির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কেউ আসুক আর না আসুক- যথাসময়েই নির্বাচন হবে। নির্বাচনী ট্রেন কারো জন্য থেমে থাকবে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, এখন তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া আর কিছুই ভাবছে না। নির্বাচন নিয়ে দেশী-বিদেশী নানা চাপ থাকলেও কোনো পক্ষই আলোচনায় সংবিধান বিরোধী তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার কথা বলেনি। তারা শুধু নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ দেখতে চায়। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু করতে প্রস্তুত।
জানা গেছে, পহেলা নভেম্বর থেকে নির্বাচনী ক্ষণ গণনা শুরু হওয়ার পর ঐ মাসের শুরুতে মন্ত্রিসভা কিছুটা ছোট করে আনতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বলতে কিছু নেই, তারপরও নির্বাচনকালীন সরকারের আদলে ছোট মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন সরকার প্রধান। গণভবনে কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন- সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকা যেসব দল রয়েছে তারা চাইলে তাদেরকে নিয়ে নির্বাচনীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে।
এদিকে, সংবিধানের ৭২ (১) অনুচ্ছেদ মোতাবেক সংসদের একটি অধিবেশন শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে পরবর্তী অধিবেশন ডাকার বাধ্যবাধদকতা রয়েছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদের ২৪তম অধিবেশন শেষ হয়েছে। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সমাপনী বক্তব্যে বলেছেন, অক্টোবরে চলতি সংসদের শেষ অধিবেশন বসবে। একটি অধিবেশন শেষ হওয়ার দিন এবং পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ৬০ দিনের বেশি বিরতি দেওয়া যাবে না বলা থাকলেও সংবিধানে এটাও বলা হয়েছে, তবে এই বিধান সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগের ৯০ দিনের (পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সে হিসেবে আগামী ২৫তম অধিবেশনের পর আর সংসদের অধিবেশন ডাকার কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকবে না।