ঢাকা , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আজ রুপিতে বাণিজ্য উদ্বোধন 

নতুন যুগে দেশ

-ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে বাণিজ্য করার যুগে প্রবেশ করছে দেশ।

ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে বাণিজ্য করার যুগে প্রবেশ করছে দেশ। ভারতের সঙ্গে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শুরু হচ্ছে মার্কিন ডলারের পাশাপাশি রুপিতে। এর ফলে রপ্তানি আয় বাবদ যে পরিমাণ রুপি আসবে, সমপরিমাণ আমদানি দায় নিষ্পত্তি করতে পারবে ব্যাংক। আবার স্বল্পমেয়াদি রুপির ঋণ নিয়ে আমদানি করা যাবে। এতে ডলারের ওপর সৃষ্ট চাপ সাময়িকভাবে কমবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে আপাতত রুপিতে শুরু হলেও উভয় দেশের বাণিজ্য ব্যবধান কমে এলে শীঘ্র্ই বাংলাদেশী মুদ্রা টাকায়ও হবে এ বাণিজ্য। আজ মঙ্গলবার ঢাকার লা মেরিডিয়ান হোটেলে ভারতের সঙ্গে রুপিতে দ্বিপক্ষীয় লেনদেন কার্যক্রমের উদ্বোধন হবে। অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশন। বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংক উভয় দেশের মধ্যে রুপিতে বাণিজ্য করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংক।

জানা গেছে, টাকা ও রুপিতে উভয় দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করার আলাপ চলছে প্রায় এক দশক ধরে। তবে বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে ভারতের দিল্লিতে গত বছরের ডিসেম্বরে যখন দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়। তখন ভারতের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যম ভারতীয় মুদ্রা রুপি ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়ার কথা ওই বৈঠকেই জানিয়ে দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। টিপু মুনশি দেশে ফিরে এসে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে জানালে সবাই একমত হয় এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা বাস্তব রূপ লাভ করে। ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রা এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনা করে, আর্থিক পরিভাষায় একে বলা হয় ‘কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা’।

এই কাজটি বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশের দুই ব্যাংক ভারতের দুই ব্যাংকে নস্ট্র হিসাব খুলেছে। এক দেশের এক ব্যাংক অন্য দেশের কোনো ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের উদ্দেশ্যে হিসাব খুললে সে হিসাবকে নস্ট্র হিসাব বলা হয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের সোনালী, ইস্টার্ন ও ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে রুপিতে লেনদেন করতে পারবেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা। ভারত অংশে এ সম্পর্কিত বিষয়ের দায়িত্বে থাকবে দেশটির আইসিআইসি ব্যাংক এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। রুপিতে লেনদেনের চাহিদা বাড়লে পর্যায়ক্রমে অন্য ব্যাংককেও অনুমতি দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ভারতীয় হাইকমিশনের যৌথ আয়োজনে আজ মঙ্গলবার ঢাকার লা মেরিডিয়ান হোটেলে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর, বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি, ভারতীয় হাইকমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য রয়েছে এমন ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আরবিআইয়ের গভর্নর শক্তিকান্ত দাসের পাশাপাশি এসবিআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সি এস শেট্টিও জুম প্ল্যাটফর্মে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।

সূত্র জানায়, চার কারণে রুপিতে বাণিজ্য করার বিষয়টি সামনে এনেছে দুই দেশ। প্রথমত, ডলার-সংকটে রয়েছে উভয় দেশ। ফলে উভয় দেশ এতে লাভবান হবে। দ্বিতীয়ত, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের দুবার মুদ্রা বিনিময় করার খরচ কমবে। তৃতীয়ত, লেনদেন নিষ্পত্তিতে সময় বাঁচবে। চতুর্থত, অন্য উদ্বৃত্ত মুদ্রা রুপিতে রূপান্তর করে লেনদেন নিষ্পত্তিতে ব্যবহার করা যাবে। জানতে চাইলে ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখার বলেন, আমরা রুপি এবং টাকা উভয় মাধ্যমেই লেনদেনের জন্য আবেদন করেছিলাম।

রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তা অনুমোদনও করেছে। এখন লেনদেন প্রক্রিয়া চালু হলে প্রাথমিকভাবে অল্প পরিমাণে রুপিতে লেনদেন হবে। পর্যায়ক্রমে তা বাড়বে। এ ছাড়া, টাকায় লেনদেনও পরবর্তীতে চালু করা হবে। তিনি বলেন, এই লেনদেন প্রক্রিয়া আমাদের বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক হবে। এ উপায়ে লেনদেন ধীরে ধীরে ডলারের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে। এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারের ওপর নির্ভরতা খুব একটা থাকবে না। তবে এটা শুধু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, সাধারণ ভ্রমণকারীদের জন্য নয় বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বলেন, রুপিতে লেনদেন চালুর বিষয়ে আমরা প্রস্তুতি শেষ করেছি। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়েছে। এই দুই ব্যাংকের সঙ্গে সুইফট কমিউনিকেশন সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এখন কোনো ব্যবসায়ী চাইলে রুপিতে এলসি খুলতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, ভারতে বছরে দুই বিলিয়ন ডলারের মতো রপ্তানি করে বাংলাদেশ। দেশটি থেকে আমদানি হয় ১৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। এখন এ দুই বিলিয়ন ডলারও যদি রুপিতে নিষ্পত্তি করা যায়, তাতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমবে। এ ছাড়া আগামীতে রপ্তানি আরও বাড়াতে পারলে তখন সুযোগ বাড়বে বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট আট হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে এক হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্যই আমদানি হয় ভারত থেকে। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে এক হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয় ওই অর্থবছরে। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। আমদানিকারকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রুপিকে মর্যাদাপূর্ণ মুদ্রায় রূপান্তর করতে ভারত বহু বছর ধরেই চেষ্টা করছে।

দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআই গত বছরের জুলাইয়ে এজন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এমনকি দেশটির বাণিজ্য সংগঠন ও ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিতে থাকে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়, তারা যাতে ভারতীয় মুদ্রায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করে। দেশের ব্যবসায়ীরা স্বাগত জানিয়েছেন এমন উদ্যোগকে। ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ জানান, ভারত থেকে আমরা ১৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করি। আর দেশটিতে আমাদের রপ্তানি দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য।

ফলে আপাতত আমরা দুই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য টাকা-রুপিতে করতে পারব। তাতে ওই পরিমাণ ডলার বাঁচবে, যা অন্য দেশ থেকে পণ্য আমদানিতে ব্যবহার করতে পারব। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের টাকা থেকে ডলার, তারপর ডলার থেকে রুপিতে বিনিময় করতে গিয়ে ৪-৬ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ হয়। টাকা-রুপির লেনদেন চালু হলে এ খরচ বেঁচে যাবে। আবার ডলারে ঋণপত্র খুলতে ব্যবসায়ীরা একধরনের অনিশ্চয়তায় থাকেন। কারণ গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ঘন ঘন কমেছে। কিন্তু টাকা-রুপির লেনদেনে সেই অনিশ্চয়তা সেভাবে নেই। কারণ, রুপির বিপরীতে টাকার মান তেমন একটা কমেনি। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এবং ভারতের দুটি ব্যাংক টাকা-রুপিতে ঋণপত্র খুলবে।

সামনের দিনগুলোয় ব্যাংকের সংখ্যা আরও বাড়বে। ফলে ব্যবসায়ীদের খুব একটা সমস্যা হবে না। যে কেউ এই সুযোগ নিতে পারবেন। তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই টাকা-রুপির লেনদেনে বেশি উপকৃত হবেন। কারণ, ডলার সংকটের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকে ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। সেজন্য আমরা টাকা-রুপিতে ঋণপত্র খুলতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নিয়োজিত যে কোনো ব্যাংক শাখা থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্বীকৃত পাঁচটি মুদ্রা এবং কানাডিয়ান ডলারে এলসি খুলতে পারে। এজন্য আলাদা করে কোনো ব্যাংকের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আইএমএফ স্বীকৃত পাঁচটি মুদ্রা হলো- ইউএস ডলার, ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড, জাপানি ইয়েন ও চায়নিজ রেনমিনবি। ২০১৬ সাল থেকে চীনের মুদ্রা আইএমএফ স্বীকৃত হলেও গত বছরের সেপ্টেম্বরে এলসি খোলার অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২০১৮ সাল থেকে ইউয়ানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি রয়েছে।

তবে ডলারের বাইরে ইউয়ানসহ অন্য মুদ্রায় লেনদেনে এখনো তেমন আগ্রহ তৈরি হয়নি। আঞ্চলিক বাণিজ্যে ডলারের প্রভাব কমাতে বেশ আগে থেকে চেষ্টা করে আসছে বড় দেশগুলো। বিশেষ করে ভারত, চীন ও রাশিয়া নিজেদের মুদ্রা লেনদেনের জন্য অনেক দিন ধরে আলোচনা করছে। করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলারের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি হয়। এর পর নতুন করে নিজ দেশের মুদ্রার প্রচলনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। যদিও ডলারের বাইরে অন্য মুদ্রায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অনেক সতর্ক।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন পর্যন্ত এ উদ্যোগের যে আয়োজন, তাতে রুপিতে বাণিজ্য তাদের জন্যই লাভজনক হতে পারে, যাদের ভারতের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি উভয় ধরনের বাণিজ্য রয়েছে। অর্থাৎ, যাদের রুপিতে আয় করে রুপিতেই খরচ করার বন্দোবস্ত আছে, তারাই এ প্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ীর সংখ্যা আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে বাণিজ্য পরিস্থিতি, তাতে রুপিতে লেনদেন চালু হলে তাতে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের লাভই বেশি। ভারত এ অঞ্চলে রুপিকে জনপ্রিয় করতে চায়।

তাই বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু করতে পারলে তাদের সেই চেষ্টায় কিছুটা হলেও অগ্রগতি হবে। অন্যদিকে এ ধরনের উদ্যোগে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি যেমন নেই, তেমনি খুব বেশি লাভও নেই। তবে এ কথা ঠিক, এ উদ্যোগের ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি হবে। কোনো ব্যবসায়ী যদি মনে করেন সুযোগটি নেবেন, তাহলে তা নিতে পারবেন। কিছু না থাকার চেয়ে কিছু বিকল্প থাকা ব্যবসার জন্য ভালো বলে তিনি মনে করেন।


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ
error: Content is protected !!

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আজ রুপিতে বাণিজ্য উদ্বোধন 

নতুন যুগে দেশ

আপডেট টাইম : ১০:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ জুলাই ২০২৩
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা ডেস্ক :

ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে বাণিজ্য করার যুগে প্রবেশ করছে দেশ। ভারতের সঙ্গে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শুরু হচ্ছে মার্কিন ডলারের পাশাপাশি রুপিতে। এর ফলে রপ্তানি আয় বাবদ যে পরিমাণ রুপি আসবে, সমপরিমাণ আমদানি দায় নিষ্পত্তি করতে পারবে ব্যাংক। আবার স্বল্পমেয়াদি রুপির ঋণ নিয়ে আমদানি করা যাবে। এতে ডলারের ওপর সৃষ্ট চাপ সাময়িকভাবে কমবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে আপাতত রুপিতে শুরু হলেও উভয় দেশের বাণিজ্য ব্যবধান কমে এলে শীঘ্র্ই বাংলাদেশী মুদ্রা টাকায়ও হবে এ বাণিজ্য। আজ মঙ্গলবার ঢাকার লা মেরিডিয়ান হোটেলে ভারতের সঙ্গে রুপিতে দ্বিপক্ষীয় লেনদেন কার্যক্রমের উদ্বোধন হবে। অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশন। বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংক উভয় দেশের মধ্যে রুপিতে বাণিজ্য করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংক।

জানা গেছে, টাকা ও রুপিতে উভয় দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করার আলাপ চলছে প্রায় এক দশক ধরে। তবে বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে ভারতের দিল্লিতে গত বছরের ডিসেম্বরে যখন দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়। তখন ভারতের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যম ভারতীয় মুদ্রা রুপি ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়ার কথা ওই বৈঠকেই জানিয়ে দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। টিপু মুনশি দেশে ফিরে এসে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে জানালে সবাই একমত হয় এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা বাস্তব রূপ লাভ করে। ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রা এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনা করে, আর্থিক পরিভাষায় একে বলা হয় ‘কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা’।

এই কাজটি বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশের দুই ব্যাংক ভারতের দুই ব্যাংকে নস্ট্র হিসাব খুলেছে। এক দেশের এক ব্যাংক অন্য দেশের কোনো ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের উদ্দেশ্যে হিসাব খুললে সে হিসাবকে নস্ট্র হিসাব বলা হয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের সোনালী, ইস্টার্ন ও ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে রুপিতে লেনদেন করতে পারবেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা। ভারত অংশে এ সম্পর্কিত বিষয়ের দায়িত্বে থাকবে দেশটির আইসিআইসি ব্যাংক এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। রুপিতে লেনদেনের চাহিদা বাড়লে পর্যায়ক্রমে অন্য ব্যাংককেও অনুমতি দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ভারতীয় হাইকমিশনের যৌথ আয়োজনে আজ মঙ্গলবার ঢাকার লা মেরিডিয়ান হোটেলে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর, বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি, ভারতীয় হাইকমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য রয়েছে এমন ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আরবিআইয়ের গভর্নর শক্তিকান্ত দাসের পাশাপাশি এসবিআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সি এস শেট্টিও জুম প্ল্যাটফর্মে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।

সূত্র জানায়, চার কারণে রুপিতে বাণিজ্য করার বিষয়টি সামনে এনেছে দুই দেশ। প্রথমত, ডলার-সংকটে রয়েছে উভয় দেশ। ফলে উভয় দেশ এতে লাভবান হবে। দ্বিতীয়ত, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের দুবার মুদ্রা বিনিময় করার খরচ কমবে। তৃতীয়ত, লেনদেন নিষ্পত্তিতে সময় বাঁচবে। চতুর্থত, অন্য উদ্বৃত্ত মুদ্রা রুপিতে রূপান্তর করে লেনদেন নিষ্পত্তিতে ব্যবহার করা যাবে। জানতে চাইলে ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখার বলেন, আমরা রুপি এবং টাকা উভয় মাধ্যমেই লেনদেনের জন্য আবেদন করেছিলাম।

রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তা অনুমোদনও করেছে। এখন লেনদেন প্রক্রিয়া চালু হলে প্রাথমিকভাবে অল্প পরিমাণে রুপিতে লেনদেন হবে। পর্যায়ক্রমে তা বাড়বে। এ ছাড়া, টাকায় লেনদেনও পরবর্তীতে চালু করা হবে। তিনি বলেন, এই লেনদেন প্রক্রিয়া আমাদের বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক হবে। এ উপায়ে লেনদেন ধীরে ধীরে ডলারের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে। এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারের ওপর নির্ভরতা খুব একটা থাকবে না। তবে এটা শুধু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, সাধারণ ভ্রমণকারীদের জন্য নয় বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বলেন, রুপিতে লেনদেন চালুর বিষয়ে আমরা প্রস্তুতি শেষ করেছি। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়েছে। এই দুই ব্যাংকের সঙ্গে সুইফট কমিউনিকেশন সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এখন কোনো ব্যবসায়ী চাইলে রুপিতে এলসি খুলতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, ভারতে বছরে দুই বিলিয়ন ডলারের মতো রপ্তানি করে বাংলাদেশ। দেশটি থেকে আমদানি হয় ১৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। এখন এ দুই বিলিয়ন ডলারও যদি রুপিতে নিষ্পত্তি করা যায়, তাতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমবে। এ ছাড়া আগামীতে রপ্তানি আরও বাড়াতে পারলে তখন সুযোগ বাড়বে বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট আট হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে এক হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্যই আমদানি হয় ভারত থেকে। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে এক হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয় ওই অর্থবছরে। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। আমদানিকারকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রুপিকে মর্যাদাপূর্ণ মুদ্রায় রূপান্তর করতে ভারত বহু বছর ধরেই চেষ্টা করছে।

দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআই গত বছরের জুলাইয়ে এজন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এমনকি দেশটির বাণিজ্য সংগঠন ও ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিতে থাকে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়, তারা যাতে ভারতীয় মুদ্রায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করে। দেশের ব্যবসায়ীরা স্বাগত জানিয়েছেন এমন উদ্যোগকে। ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ জানান, ভারত থেকে আমরা ১৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করি। আর দেশটিতে আমাদের রপ্তানি দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য।

ফলে আপাতত আমরা দুই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য টাকা-রুপিতে করতে পারব। তাতে ওই পরিমাণ ডলার বাঁচবে, যা অন্য দেশ থেকে পণ্য আমদানিতে ব্যবহার করতে পারব। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের টাকা থেকে ডলার, তারপর ডলার থেকে রুপিতে বিনিময় করতে গিয়ে ৪-৬ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ হয়। টাকা-রুপির লেনদেন চালু হলে এ খরচ বেঁচে যাবে। আবার ডলারে ঋণপত্র খুলতে ব্যবসায়ীরা একধরনের অনিশ্চয়তায় থাকেন। কারণ গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ঘন ঘন কমেছে। কিন্তু টাকা-রুপির লেনদেনে সেই অনিশ্চয়তা সেভাবে নেই। কারণ, রুপির বিপরীতে টাকার মান তেমন একটা কমেনি। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এবং ভারতের দুটি ব্যাংক টাকা-রুপিতে ঋণপত্র খুলবে।

সামনের দিনগুলোয় ব্যাংকের সংখ্যা আরও বাড়বে। ফলে ব্যবসায়ীদের খুব একটা সমস্যা হবে না। যে কেউ এই সুযোগ নিতে পারবেন। তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই টাকা-রুপির লেনদেনে বেশি উপকৃত হবেন। কারণ, ডলার সংকটের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকে ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। সেজন্য আমরা টাকা-রুপিতে ঋণপত্র খুলতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নিয়োজিত যে কোনো ব্যাংক শাখা থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্বীকৃত পাঁচটি মুদ্রা এবং কানাডিয়ান ডলারে এলসি খুলতে পারে। এজন্য আলাদা করে কোনো ব্যাংকের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আইএমএফ স্বীকৃত পাঁচটি মুদ্রা হলো- ইউএস ডলার, ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড, জাপানি ইয়েন ও চায়নিজ রেনমিনবি। ২০১৬ সাল থেকে চীনের মুদ্রা আইএমএফ স্বীকৃত হলেও গত বছরের সেপ্টেম্বরে এলসি খোলার অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২০১৮ সাল থেকে ইউয়ানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি রয়েছে।

তবে ডলারের বাইরে ইউয়ানসহ অন্য মুদ্রায় লেনদেনে এখনো তেমন আগ্রহ তৈরি হয়নি। আঞ্চলিক বাণিজ্যে ডলারের প্রভাব কমাতে বেশ আগে থেকে চেষ্টা করে আসছে বড় দেশগুলো। বিশেষ করে ভারত, চীন ও রাশিয়া নিজেদের মুদ্রা লেনদেনের জন্য অনেক দিন ধরে আলোচনা করছে। করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলারের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি হয়। এর পর নতুন করে নিজ দেশের মুদ্রার প্রচলনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। যদিও ডলারের বাইরে অন্য মুদ্রায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অনেক সতর্ক।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন পর্যন্ত এ উদ্যোগের যে আয়োজন, তাতে রুপিতে বাণিজ্য তাদের জন্যই লাভজনক হতে পারে, যাদের ভারতের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি উভয় ধরনের বাণিজ্য রয়েছে। অর্থাৎ, যাদের রুপিতে আয় করে রুপিতেই খরচ করার বন্দোবস্ত আছে, তারাই এ প্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ীর সংখ্যা আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে বাণিজ্য পরিস্থিতি, তাতে রুপিতে লেনদেন চালু হলে তাতে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের লাভই বেশি। ভারত এ অঞ্চলে রুপিকে জনপ্রিয় করতে চায়।

তাই বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু করতে পারলে তাদের সেই চেষ্টায় কিছুটা হলেও অগ্রগতি হবে। অন্যদিকে এ ধরনের উদ্যোগে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি যেমন নেই, তেমনি খুব বেশি লাভও নেই। তবে এ কথা ঠিক, এ উদ্যোগের ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি হবে। কোনো ব্যবসায়ী যদি মনে করেন সুযোগটি নেবেন, তাহলে তা নিতে পারবেন। কিছু না থাকার চেয়ে কিছু বিকল্প থাকা ব্যবসার জন্য ভালো বলে তিনি মনে করেন।


প্রিন্ট