মাহাতাব উদ্দিন একটি এনজিও অফিসের কর্মকর্তা। প্রতি ঈদে তিনি ৫ কেজি গরুর মাংস, সঙ্গে পোলাও চাল, মাছ, মুরগি এবং ইচ্ছামতো মিষ্টান্ন কিনবেন। এবার তিনি বেতন-বোনাস পেয়েছেন ঈদের এক সপ্তাহ আগে। বাজার করতে এসেছেন সোমবারে। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা কেটে অর্ধেকে করেছেন।
অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে মাহাতাব বলেন, ‘বাজারে এসে আমি খুব হতাশ হয়ে পড়েছি। ঈদের শেষ সপ্তাহে যেনো পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। পণ্যমূল্যের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। পরিবারের প্রয়োজন থাকলেও নির্ধাতির বাজেটের বাহিরে যেতে পারছি না। এ কারণে কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়।’
বাজার করতে আসা স্কুল শিক্ষক নাওরিন খানম বলেন, বলার কোনো ভাষা নেই। কি করবো বাজারে এসে মাথা ঘুরছে। পোশাক কেনার কথা কল্পনা করতে পারছি না। ভাগে কোরবানি দিবো সমলাসহ প্রয়োজনীয় বাজার করতে এসে তো বাজাটের অর্ধেক বাজার করতে হবে।
নাওরিন আরও বলেন, এই ঈদে কোরবানির পশু কেনার পর সংসারের যে বাজারের তালিকা এনেছিলাম দ্রব্যমূল্যের দাম দেখে অর্ধেক করে নিয়েছি। এর ওপর রয়েছে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ। এমন অবস্থায় মানুষজন কোনো হিসাবই মেলাতে পারছেন না।
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা নিত্যপণ্যের বাজারে কোনো সুখবর নেই। প্রতিদিনই বাড়ছে পণ্যের দাম। মানুষের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এ ঈদে অনেকেই দেন পশু কোরবানি করবেন। ঈদের বাজার করবেন। ঈদের পরপরই জুলাই মাস শুরু হবে অনেক পরিবারের ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ, বাসা ভাড়াসহ অন্য খরচ মিটাতে গিয়ে ঋণ করতে হবে অনেক পরিবারকে।
আলফাডাঙ্গায় গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে সবজির দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। জিরার দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩০০ টাকা। মাংস রান্নার সকল উপকরণের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
চাল, আটা, ময়দাসহ কনফেকশনারি পণ্যের দামও বেড়েছে। ১২০ টাকা কেজির চিনি হয়েছে ১৩৫ টাকা। মুরগির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২০-৩০ টাকা। গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা কেজি, খাসির সাংস ১০০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি কেজি ১৭০ টাকা ছিল এখন ১৯০ টাকা। সোনালি মুরগি ২৫০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে হয়েছে ২৮০ টাকা। দেশী মুরগি ১০০ টাকা বেড়ে এখন ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সবজি বাজারে নেই কোনো সুখবর। প্রতিটি সবজির দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। বেগুন ২০ টাকা বেড়ে এখন ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লাউ প্রকারভেদে ১০ থেকে ২০ টাকা বাড়িয়ে ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পেঁপে ১৫ টাকা কেজিতে বাড়িয়ে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে ৪০ টাকা কেজি আলুর দাম শুধু অপরিবর্তিত রয়েছে। কাঁচামরিচ সোমবারে ৩৬০ টাকা বিক্রি হয়েছে যাহা গত সপ্তাহে ছিল ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি।
শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানে নয়। এ ঈদে তৈরি পোশাকের দোকানে তেমন কোনো ক্রেতার আগমন নেই। সোমবার সকালে আলফাডাঙ্গা সদর বাজারের কাপড়পট্টিতে বিভিন্ন বস্ত্রলায় গিয়ে দেখা যায় কোনো ক্রেতা নেই, অলস সময় পার করছে দোকানিরা।
সোমবার আলফাডাঙ্গা সদর বাজারে বাজারে গিয়ে দেখা যায়। অনেক মুদি দোকান ও তৈরি পোশাকের দোকানে চোঁখে পড়ার মতো ক্রেতা নেই। দুই দিন পর ঈদ দোকানিরা ক্রেতা না থাকায় হতাশ হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বেশি বিক্রির আশায় অনেক দোকানি ঋণ করে মালামাল তুলেছেন।
মেসার্স দীপন ষ্টোরের মালিক দীপক বিশ্বাস বলেন, গত ঈদে এসময় দোকানে ভিড় লেগেই থাকতো দাড়াবার জায়গা ছিল না। এখন দোকানে কোনো ক্রেতা নেই। তবে আশায় আছি শেষ সময়ে বেচাবিক্রি বাড়বে।
মেসার্স পাল ষ্টোরের মালিক সুজিত পাল বলেন, অনেক টাকার মালামাল তুলেছি দোকানে। চারজন কর্মচারী আছে দোকানে ঈদের বাকি আছে মাত্র দুই দিন। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কমেছে বেচাবিক্রি। দ্রব্যমূল্যে বৃদ্ধির জন্য অনেকেই হিসেব করে বাজার করছেন। অনেকেই পশু কেনায় ব্যস্ত আছে। বাজারের প্রত্যটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানে ক্রেতার ভিড় চোখে পড়েনি। একাধিক ব্যবসায়ী আশায় বুব বেধে আছেন ঈদের আগেই তাদের বেচাবিক্রি বাড়বে। বেচাকেনা এমন মন্দা হবে ব্যবসায়ীদের কল্পনাই ছিলনা।
বধুয়া বস্ত্রলায়ের মালিক প্রবীর কুন্ডু বলেন, গত ঈদ থেকে এই ঈদের বেচাকেনা চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। অনেক নতুন কাপড় তুলেছি বিক্রি করার আশায় এখন কোনো বিক্রি নেই। হঠাৎ করে ক্রেতাশূন্যে হয়ে যাবে তা ভাবিনাই।
সদ্য অবসরে যাওয়া প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক খবিবর রহমান মিয়া বলেন, সংসারের ব্যয়ের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তিনি। আগে ভালো দামের চিকন চালের ভাত খেতেন। খরচ কমিয়ে আনতে এখন মোটা চাল কিনছেন। মাসে পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের চাহিদা এখন দুই লিটারে নিয়ে এসেছেন।
এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘শখের বসে যেসব খাবার খাওয়া হতো, সেটি বলা চলে একেবারেই বন্ধ। ১০ টাকার নিচে কোনো হোটেলে কোনো খাবার মেলেনা। যাতায়াতে ১০ টাকার নিচে কোনো ভাড়া নিতে চায়না। এখন কষ্ট করে হেটে বাজারে যাতায়াত করি।
দ্রব্যমূল্যে বৃদ্ধির প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল হক জানান, বাজার মনিটরিং করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রিন্ট