বাণিজ্যিকভাবে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে ভারত। ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সই হওয়া একটি চুক্তির আওতায় এতদিন পরীক্ষামূলকভাবে বন্দর দুটি ব্যবহার করেছে দেশটি। ২৪ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জারি হওয়া স্থায়ী আদেশের মাধ্যমে সব ধরনের বাণিজ্যিক কাজে এ বন্দর ব্যবহার করতে পারবেন ভারতীয় আমদানি-রফতানিকারকরা।
ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ বেশি লাগে। এ প্রেক্ষাপটেই ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে ‘এগ্রিমেন্ট অন দি ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’ চুক্তি হয়। এর আওতায় ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যের পরিচালন পদ্ধতির মান (এসওপি) সই হয় ২০১৯ সালে। এরপর ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট বিধিমালা জারি হয় ২০২১ সালে। যার আলোকেই সবশেষ ২৪ এপ্রিল জারি হয়েছে স্থায়ী আদেশ।
স্থায়ী আদেশে মোট নয়টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে পণ্যের ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট-সংক্রান্ত সংজ্ঞা থেকে শুরু করে গোটা প্রক্রিয়া অনুসরণে করণীয় ও বাধ্যবাধকতার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। ট্রানজিট অপারেটর হিসেবে তালিকাভুক্তি-সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউজের তালিকাভুক্তির মাধ্যমেই কেবল চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য চালান করা যাবে।
যে স্থল কাস্টমস স্টেশনের মাধ্যমে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য ঢুকবে বা বের হবে সে কাস্টমস স্টেশনে অনুমোদিত ব্যক্তির মূল বা রেফারেন্স লাইসেন্স থাকতে হবে। এ-সংক্রান্ত সনদ ও ট্রানজিট অপারেটরের তালিকা প্রকাশ করবে এনবিআর।
আরেকটি ধারায় চুক্তির আওতায় ভারতীয় ট্রানজিট পণ্যের কাস্টমস ছাড় প্রদানের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা পদ্ধতির বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। জাহাজ বা অন্যান্য যানবাহন প্রবেশ করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাস্টমস কর্মকর্তা দাখিলকৃত মেনিফেস্টোর তথ্যের সঙ্গে প্রাপ্ত জাহাজ অথবা যানবাহন ও ভাণ্ডারের তথ্য, সিলের অখণ্ডতা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) এবং আনুষঙ্গিক তথ্য যাচাই করবে। এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সব কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে না বলে উল্লেখ রয়েছে স্থায়ী আদেশে।
শুল্কায়ন প্রসঙ্গে স্থায়ী আদেশে বলা হয়েছে, ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যচালান সংশ্লিষ্ট দলিল নির্দিষ্ট শুল্কায়ন সেকশনে দাখিল করতে হবে। এ সেকশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাস্টমস কর্মকর্তা ডিজিটাল সিস্টেমে দাখিলকৃত ট্রানজিট ঘোষণা, প্রয়োজনীয় দলিল, উল্লেখিত তথ্যের যথার্থতা, পণ্যের এইচএস কোড এবং আনুষঙ্গিক বিষয় যাচাই করবেন। যাচাই শেষে প্রাপ্তিসাপেক্ষে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যচালানের শুল্কায়নপূর্বক প্রযোজ্য শুল্ককর, অন্যান্য ফি ও চার্জের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে।
শুল্কায়নকালে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে শুল্ক মূল্যায়ন (আমদানি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ) বিধিমালা, ২০০০ এবং বিদ্যমান অন্যান্য বিধিবিধান প্রযোজ্য হবে। এরপর এসওপির আলোকে স্থায়ী আদেশ প্রযোজ্য শুল্ককরণের বিপরীতে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে কাস্টমস বন্ড দাখিল করা হবে। ট্রানজিট অপারেটর পণ্যের মালিকের পক্ষে কাস্টমস বন্ড দাখিল করবেন এবং অন্যান্য ফি ও চার্জের ওপর প্রযোজ্য মূল্য সংযোজন কর (মূসক) দেবেন।
সার্বিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে শুল্কায়ন শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দাখিলকৃত কাস্টমস বন্ড এবং পণ্যচালান সংশ্লিষ্ট সব দলিল অনুলিপি সংরক্ষণ করবেন। ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধায় কনটেইনারসহ পণ্যচালান বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কনটেইনারটি বাংলাদেশ থেকে বাইরে যাবে এ শর্তে ট্রানজিট অপারেটর ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে একটি কাস্টমস রিস্ক বন্ড দাখিল করবেন।
ট্রানজিটকাল সম্পর্কে স্থায়ী আদেশে বলা হয়েছে, উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এসওপি অনুযায়ী, কোনো বন্দরে প্রবেশ করে (পোর্ট অব এন্ট্রি) বের হওয়ার পর সাতদিনের মধ্যে পণ্যচালান নিয়ে বাংলাদেশের যে বন্দর দিয়ে বের হবে (পোর্ট অব এক্সিট) ওই বন্দরে অবশ্যই প্রবেশ করতে হবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যচালান পরিবহন কার্যক্রম সম্পাদন ব্যাহত হলে প্রবেশ বন্দরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে যথাযথ কারণ উল্লেখ করে লিখিতভাবে আবেদনের বিনিময়ে সময় বাড়ানো যাবে। বাড়ানো সময়ের মধ্যে বের হতে ব্যর্থ হলে প্রযোজ্য শুল্ককর আদায় করা হবে।
স্থায়ী আদেশের ফি ও চার্জের তালিকা অনুযায়ী, ট্রানজিট চালানের জন্য সাতটি খাতের মাশুল নির্ধারিত রয়েছে। এর মধ্যে টনপ্রতি ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি প্রতি চালান ৩০ টাকা, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি টনপ্রতি ২০ টাকা, সিকিউরিটি খরচ টনপ্রতি ১০০ টাকা, এসকর্ট বাবদ খরচ কিলোমিটারপ্রতি ৮৫ টাকা ও বিবিধ প্রশাসনিক খরচ টনপ্রতি ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া কনটেইনারপ্রতি স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা, ইলেকট্রিক লক অ্যান্ড সিল ফি বিধিমালা অনুযায়ী এবং সড়ক ব্যবহারের মাশুল আদায় হবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত হারে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থায়ী আদেশ জারি হয়েছে এটা ভালো খবর। এতদিন পরীক্ষামূলকভাবে কার্যক্রম চলছিল, এখন স্থায়ী আদেশ অনুযায়ী সব চলবে। তবে পরীক্ষামূলক ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হলেও এখন স্থায়ীভাবে কার্যক্রম চলবে।
সংশ্লিষ্টরা আরো জানিয়েছেন, ভারতীয় বন্দর ব্যবহারকারীরা চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করেন পণ্য পরিবহন কাজে। চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত এসে তারা সহজে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য নিয়ে যেতে পারবেন। আখাউড়া বা ল্যান্ডলক রাজ্যগুলোতেও পণ্য পরিবহনের ঝামেলা কমে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বন্দরে কার্যক্রমগুলো পূর্ণাঙ্গ রূপে শুরু করতে হবে। তাতে বোঝা যাবে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। যদি হয়, সেগুলো সমাধান করা যাবে। যখন পুরোপুরি কার্যক্রম চলবে তখন অনেক সুবিধা-অসুবিধা দেখা দিতে পারে। সেগুলোর সমাধানও তখন করা যাবে। পুরো প্রক্রিয়াটি কার্যকর কতটুকু হবে সেটা নির্ভর করবে বন্দর ব্যবহারকারীদের ওপর। ব্যবহারকারীরা হলেন ভারতীয়। তারা কতটুকু ব্যবহার করবেন সেটা নির্ভর করবে তাদের ওপর।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এতদিন পরীক্ষামূলকভাবে চালিয়েছি, সেগুলো সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, কোনো অসুবিধা হয়নি। এ কর্মযজ্ঞের জন্য বন্দর শতভাগ প্রস্তুত আছে। ফলপ্রসূ করার দায়িত্ব হলো ব্যবহারকারী বা আমদানি-রফতানিকারকদের। বাংলাদেশের কোনো পক্ষ যদি এ চুক্তির আওতায় বন্দর ব্যবহার করতে চায়, সেটাও তাদের ওপরই নির্ভর করবে। আমাদের কাছে যেকোনো সময় সার্ভিস চাওয়া হলে আমরা তা দিতে পারব।’
জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে সবশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে দুটি চালান আনা-নেয়া করা হয়। ট্রানজিট পণ্য বোঝাই করতে বাংলাদেশী জাহাজ এমভি ট্রান্স সামুদেরা কলকাতার শ্যামপ্রসাদ মুখার্জি বন্দরে যায়। সেখান থেকে রডবাহী পণ্যের চালান নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করে সড়কপথে শ্যাওলা (সিলেট)-সুতারকান্দি (ভারত) স্থলবন্দরের মাধ্যমে ভারতের আসামে নেয়া হয়। সর্বশেষ আরেকটি চালান ভারতের মেঘালয় থেকে ডাউকি (ভারত)-তামাবিল (বাংলাদেশ) স্থলবন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে করে এ পণ্যবাহী চালান কলকাতায় যায়। এ দুটি চালানের মাধ্যমে পাঁচটি রুট বা পথে ট্রানজিট পণ্য আদান-প্রদান সম্পন্ন হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুক্তিটির মৌলিক বিষয় হলো যে পণ্যগুলো আসবে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম বা বহুপদ্ধতির যানবাহনের প্রয়োজন রয়েছে। শুধু বন্দরে জাহাজ এসে ভিড়ল, এতটুকুতে হবে না। এরপর খালাস করে স্থলপথে নেয়ার বিষয় আছে। সেই স্থলপথে নেয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় বিষয় থাকে, এখান থেকে যে পরিবহনগুলো যায়, সেগুলো যদি আবার খালি ফিরে আসে, সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক লোকসানের শঙ্কা থেকে যায়। ফলে নতুন ব্যবস্থায় পূর্ণভাবে সুবিধা অর্জন করতে চাইলে অন্য যেসব পরিবহন ব্যবস্থা আছে, সেগুলোও সহজীকরণ করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের যানবাহন ব্যবহার যেন নিশ্চিত করা হয় সেটি হলো বড় বিষয়। শুধু ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল না, ভুটান ও নেপালের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এবং সেখান থেকে মালপত্র নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যেন অবাধ হতে পারে সেটার নিশ্চয়তা দরকার। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে, যদি চুক্তিটি থেকে বাংলাদেশ যথাযথ সুবিধা পায়। সুবিধা পেতে হলে একদিকে সে সেবা প্রদানকারী দেশ হিসেবে করবে। অপরদিকে একইরকমভাবে নিজস্ব পণ্য অন্য বাজারে নেয়ার ক্ষেত্রে চলাচলের সুবিধা এক হিসেবে পাবে। যদি একটা হয়, আরেকটা না হয়, তাহলে চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের কোনো বড় পরিবর্তন হবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হলো ভারতের সঙ্গে চলাচলের ক্ষেত্রে। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমাদের ট্রানজিটের পূর্ণ কার্যকারিতা এখনো নিশ্চিত হয়নি। আরেকটা হলো ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এখন ৩০টিরও বেশি পয়েন্ট ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু এসব জায়গায় বর্ডার লজিস্টিকস পুরনো পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হয়, সেটা শুল্ক নির্ধারণ থেকে শুরু করে নিরাপত্তার বিষয়েও। এগুলোকে আধুনিকায়ন করা হয়নি। যার ফলে পণ্যজট লেগে থাকে। এ বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে দেখা দরকার।’
প্রিন্ট