দেশে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ অনুসন্ধানে প্রচেষ্টা জোরদার করেছে সরকার। সমতল, পার্বত্য এবং সমুদ্রে জ্বালানির সন্ধানে অনেকগুলো প্রকল্প ও প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে দেশের স্থলভাগে ৪৬টি কূপ খনন কার্যক্রম শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৫টি অনুসন্ধান, ১৫টি উন্নয়ন এবং ১৬টি সংস্কার কূপ। ইতিমধ্যে ১৬টি কূপ খননের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সম্পন্ন করেছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
পার্বত্য অঞ্চলে ১০টি স্থানে গ্যাস-খনিজ অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির (আইওসি) সঙ্গে যৌথ কোম্পানি গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি (বাপেক্স)। আর দেশের ইতিহাসে এখনো গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান করতে না পারার আক্ষেপও দূর হতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান এক্সন মোবিলের প্রস্তাব ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে সরকার।
এদিকে দেশে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতির কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলেন বিশেষজ্ঞ ও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা। সে তথ্যের জোগান দিতে ২০২০ সালে বঙ্গোপসাগরের গভীর ও অগভীর ব্লকগুলোতে মালটিক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে (ভূকম্প জরিপ) শুরু করে নরওয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি টিজিএস-নোপেক এবং শ্লম্বার্জার। আগামী মে মাসে সে জরিপ কাজের তথ্য পেট্রোবাংলা হাতে পাওয়ার কথা রয়েছে। আর আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন লাভজনক নয় বলে সরকারের সঙ্গে কাজ করেনি এত দিন। তাদেরকে আগ্রহী করতে এবং দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসায়ীক অংশীদারিত্ব তৈরির লক্ষ্যে আগামী জুনের মধ্যে নতুন উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ সূত্র।
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জিকে দিয়ে ইতিমধ্যে পিএসসির একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। পেট্রোবাংলা নিজস্ব মতামতসহ এটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠায় গত ফেব্রুয়ারিতে। আগেরটি থেকে এটিতে উৎপাদন ও দাম আরও আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে এতে কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর এটি অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিপরিষদ কমিটি বিশ্লেষণ করবে। এই অনুমোদনের পর চূড়ান্ত পিএসসি ঘোষণা করা হবে।
গ্যাস ও খনিজ প্রাপ্তির সম্ভাবনা বিবেচনায় দেশের স্থলভাগকে ২২টি এবং সমুদ্রভাগকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এই ২৬টির মধ্যে ১১টি ব্লক অগভীর সমুদ্রে অবস্থিত। বাকি ১৫টি গভীর সমুদ্রে। এখন পর্যন্ত শুধু অগভীর অংশের দুটি ব্লকে (এসএস-০৪ এবং এসএস-০৯) অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড। চলতি বছরে তাদের জরিপ কাজের ফলাফল পাওয়ার কথা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লকের সবগুলোতে অনুসন্ধানের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে জ্বালানি খাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানি এক্সন মোবিল।
তবে গভীর সমুদ্রে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর নয়। এর আগে কোরিয়ান কোম্পানি পসকো দাইয়ু এবং আমেরিকার কোম্পানি কনকো ফিলিপ পৃথক দুই দফায় পিএসসি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু না করে চলে যায়। তবে এবার আশাবাদী সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম বলেন, এক্সনের প্রস্তাবের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। তবে আগে গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানের জন্য কয়েক বার দরপত্র আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে খুব একটা আগ্রহ দেখতে পাইনি। কনকো ফিলিপস এসে চলে যায়। পসকো দাইয়ুও এসে চলে যায়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক্সন মোবিল খুব আগ্রহ নিয়ে আলোচনা করছে। আমাদের আলোচনা চলছে। তারা রাজি হলে আগামীতে একটি চুক্তি সই করা হবে।
জ্বালানি উপদেষ্টা আরও বলেন, এক্সন মোবিল কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন অনেকে। আমার ধারণা, তারা তাদের জ্বালানির উৎস বৈচিত্র্য আনতে চায়। শুধু মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অন্য কিছু স্থানেও উৎস তৈরি করতে চায়। যেন কোনো কারণে বিদ্যমান উৎস থেকে গ্যাস পেতে বাধা তৈরি হলে সরবরাহে সমস্যা তৈরি না হয়। ভৌগোলিক কৌশলগত কারণে এক্সন মোবিল বাংলাদেশে আগ্রহী হতে পারে। আমি প্রায় পাঁচ বছর ধরে তাদের সঙ্গে আলাপ করছি। তাদের বলেছি, দেশের লাভ থাকলে তাদের সঙ্গে চুক্তি সই করবো আমরা। এই বছরের মধ্যে চুক্তিটি চূড়ান্ত করার ব্যাপারে আমি আশাবাদী। চুক্তির পর কাজ শুরু হলে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস পৌঁছে দিতে ১০ বছর লাগবে।
এদিকে স্থলভাগে গ্যাসকূপ খননের বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ২৫ সালের মার্চের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টির ডিপিপি সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলোর ডিপিপিও আগামী দুই মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে। এই দুই বছরে বাপেক্সের চারটি রিগ এবং লোকবল পূর্ণ সক্ষমতায় ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ২৮টি কূপ খনন করা যাবে। বাকি ১৮টি কূপ বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে বা বাপেক্স ও বিদেশি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে খনন হতে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, দেশে ভূখণ্ডে অনুসন্ধান কূপ খননের হার খুব কম। বছরে গড়ে একটি। এটি খুবই কম। এখন দুই বছরে ১৫টি অনুসন্ধান কূপ খননের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এটি অনেক দেরিতে নেওয়া হলো। তবুও কখনো না হওয়ার চেয়ে এবার হওয়াটা ভালো। তবে এর আগেও ১০৮টি কূপ খননের প্রকল্প নিয়ে বাতিল করা হয়েছিল। এবার যেন তেমন না হয়। তিনি আরও বলেন, ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করে বাংলাদেশ। এই ১০ বছর সাগরে অনুসন্ধান না করা বড় রকমের ভুল। এটি পেট্রোবাংলার দুর্বলতা। ভারত ও মিয়ানমার সাগর থেকে পাইপলাইনে গ্যাস নিয়ে গেছে। এখন যে প্রোগ্রামগুলো নেয়া হয়েছে সেগুলো আরও অন্তত ৭ বছর আগে নেওয়া হয়েছিল। তারপরও এখন আলোচনা এগিয়ে নিয়ে সত্যিকার অর্থে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রিন্ট