দেশে গত কয়েক বছরে মোটরসাইকেলের ব্যবহার অস্বাভাবিক আকারে বেড়েছে। রাস্তায় বেরোলেই মোটরসাইকেল। সড়ক-মহাসড়ক সর্বত্র দুই চাকার এ বাহনের দাপট। যাত্রী পরিবহনের কারণে অদক্ষ চালকের হাতে চলে এসেছে মোটরবাইক। দুর্ঘটনার কারণে পরিস্থিতি সামাল দিতে নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটছে সরকার। এর অংশ হিসেবে নীতিমালা প্রণয়ন করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। কিন্তু শিল্পনীতির আওতায় এসে মোটরসাইকেল হয়ে উঠছে সহজলভ্য।
বিআরটিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২টি মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, বছরে প্রায় সাত লাখ মোটরসাইকেল উৎপাদিত হয়। আগে আমদানি হতো মোটরসাইকেল। ২০১৮ সালে ‘মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা’ করে শিল্প মন্ত্রণালয়। এক যুগ আগে আমদানি করা যে মোটরসাইকেল দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হতো, তা এখন অর্ধেক দামে পাওয়া যাচ্ছে ২০১৮ সালের নীতিমালায় শুল্ক ছাড় দেওয়ায়।
দুর্ঘটনা রোধে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) গত বছর মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বৈঠকে প্রস্তাব উঠলেও অনুমোদন পায়নি। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার জরিপে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাকে আশঙ্কাজনক হিসেবে দেখানো হয়েছে।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রায় ২১ শতাংশ দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলের সংশ্লিষ্টতা ছিল। ২০২২ সালে এ হার বেড়ে হয়েছে ২৮ শতাংশ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, গত বছর ২ হাজার ৯৭৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ হাজার ৯১ জন, যা মোট প্রাণহানির প্রায় ৪০ শতাংশ। ৪৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনায় ছিল মোটরসাইকেলের সংশ্লিষ্টরা।
বিআরটিএর তথ্যমতে, ২০১০ সালে সারাদেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৪টি। গত ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে ৪০ লাখ ৩৯ হাজার ৯৬৯টি। ১২ বছরে ছয়গুণ হয়েছে মোটরসাইকেল। ২০১০ সালে রাজধানী ঢাকায় নিবন্ধিত মোটরসাইলের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৮৭৯টি। গত ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে ১০ লাখ ২৩ হাজার। ঢাকায় মোট যানবাহনের সংখ্যা ১৯ লাখ ৬৬ হাজার। সারাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৬ লাখ ২৮ হাজার ৬৫৮, যার বিপরীতে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৪০ লাখ ৩৯ হাজার ৯৬৯টি। অর্থাৎ যানবাহনের ৭১ শতাংশই মোটরসাইকেল।
মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা করতে কমিটি করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। ৯ সদস্যের কমিটি ‘মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা-২০২৩’ এর খসড়া করেছে। এতে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এরপর প্রস্তাবটি পাঠানো হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে।
নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মাহবুব ই রব্বানি আমাদের সময়কে বলেন, খসড়াটি প্রস্তুত করা হয়েছে। দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় নীতিমালায় কিছু পয়েন্ট রাখা হয়েছে। তবে তা চূড়ান্ত নয়। খসড়াটি পর্যালোচনা করবে মন্ত্রণালয়।
তবে নিয়ন্ত্রণের পক্ষে নয় বিনিয়োগকারী ও উৎপাদকরা। তারা বলছেন, বিধিনিষেধ এলে ৯ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। এ বিষয়ে মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার্স ও ম্যানেফ্যাকচার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মতিউর রহমান আমাদের সময়কে জানান, ‘খসড়াটি এখনো দেখা হয়নি। এটি চূড়ান্ত করার আগে নিশ্চয়ই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় করবে সরকার। তখন বোঝা যাবে। এর আগে মন্তব্য করা যথার্থ হবে না। এটুকু বলতে পারি, মোটরসাইকেল শিল্পের জন্য ক্ষতি হবে এমন সিদ্ধান্ত নেবে না, সেই প্রত্যাশা করতেই পারি।’
প্রস্তাবিত নীতিমালায় মোটরসাইকেলকে স্পোর্টি এবং স্কুটিতে ভাগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে- মহাসড়কে যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। মহাসড়কে চলাচলের জন্য মোটরসাইকেলে অ্যান্টি-লক ব্রেকিং সিস্টেম (এবিএস) থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই বয়স্ক, অন্তঃসত্ত্বা এবং ১২ বছরের কম বয়সীদের মোটরসাইকেলে আরোহী করা যাবে না। মোটরসাইকেল বিক্রির সময় ক্রেতাকে বিএসটিআই অনুমোদিত দুটি হেলমেট দিতে হবে। ঈদ ও দুর্গাপূজার মতো উৎসবের আগে-পরে ১০ দিন মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানো যাবে না।
খসড়া নীতিমালায় স্পোর্টির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এটি দ্রুতগতি সম্পন্ন মোটরসাইকেল। যার আসন গতির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষায় কৌনিকভাবে তৈরি হয়ে থাকে। স্কুটির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, আরামদায়ক, জ্বালানি সাশ্রয়ী, অপেক্ষাকৃত কম গতিসম্পন্ন এবং সহজে নিয়ন্ত্রণ উপযোগী মোটরসাইকেল।
নীতিমালার ৮ (২) ধারায় বলা হয়েছে, শহর এলাকায় মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। এ নিয়মের সঙ্গেও একমত নন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, ৩০ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল চালালে দুর্ঘটনা বাড়বে। খসড়া নীতিমালায় বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় বলা হয়েছে, মহাসড়কে ১২৬ সিসির কম ক্ষমতার মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে না।
নীতিমালার খসড়ায় মোটরসাইকেল চালকদের জন্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। রাতে মোটরসাইকেল চালানোর সময় রেট্রোরিফ্লেক্টিভ জ্যাকেট (আলোর প্রতিফলন হয় এমন পোশাক) ব্যবহার, ক্রেতাকে নিরাপত্তা ম্যানুয়েল সরবরাহ, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবগুলোকে স্বাগত জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
নীতিমালার ৩(২) ধারায়, মোটরসাইকেলের নিরাপদ ব্যবহার এবং অপেক্ষকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান করা হয়। ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, স্কুটি মোটরসাইকেল জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে উৎপাদন, সংযোজন, আমদানি পর্যায়ে শুল্ক সুবিধা প্রদান। স্পোর্টি মোটরসাইকেলে শুল্ক বৃদ্ধি করা। ৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, স্কুটি ব্যবহারের সুফল প্রচার করে ব্যবহারকারীদের উৎসাহিত করা। তবে উৎপাদকদের আপত্তি স্কুটিতে। তাদের মতে বাংলাদেশে স্কুটি তৈরি হয় না। চীন ও ভারত থেকে আমদানি হয়। নীতিমালা অনুযায়ী স্পোর্টি মোটরসাইকেলে শুল্ক বাড়লে উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
জানা গেছে, বিদেশি কোম্পানি হোন্ডা, ইয়ামাহা, সুজুকি, বাজাজ, হিরো, টিভিএস বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। কারখানা তৈরি করেছে। দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদন হচ্ছে। দেশি প্রতিষ্ঠান উত্তরা মোটরস, ওয়ালটন মোটরসাইকেল উৎপাদন করেছে। নীতিমালায় করছাড় ও প্রণোদনার কারণে দেশি-বিদেশি আটটি প্রতিষ্ঠান ৯ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ পাইপলাইনে রয়েছে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা হলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না। পুরনো বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে।
প্রিন্ট