রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, নির্বাচনের আগে সরকার তার সব কাজ জনগণের সামনে দেখাতে চাইবে—এটাই স্বাভাবিক। রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনও চাইছেন, যেসব প্রকল্প আরো কিছুটা পরে খোলার পরিকল্পনা ছিল সেগুলোর কাজও দ্রুত শেষ করে উদ্বোধন করে দিতে। এতে জনগণও উপকৃত হবে।
পদ্মায় পড়বে রেলের ছায়া : রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে রেল চলার কথা ছিল। পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষের আগ্রহ ব্যাপক। তাই আগামী অক্টোবরের মধ্যে পদ্মা সেতুতে ট্রেন চালানোর জোর প্রস্তুতি চলছে।
প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৬ শতাংশ। রেলের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পের নির্মাণকাজ তিন খণ্ডে বিভক্ত। এতে ঢাকা-মাওয়া কাজ হয়েছে ৭৫ শতাংশ, মাওয়া-ভাঙ্গা কাজ হয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ, ভাঙ্গা-যশোর কাজ হয়েছে ৬৩ শতাংশ। প্রথমে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ চালু হবে। এই অংশের গড় অগ্রগতি ৮২.৫ শতাংশ।
৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ লাখ টাকা দিচ্ছে সরকার। বাকি ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের তালিকাভুক্ত করা হয়।
কক্সবাজার যাবে ট্রেন : রেলওয়ে সূত্র বলেছে, আগামী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল শুরু হতে পারে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০.৮৩১ কিলোমিটার মেইন লাইন, লুপ ও সাইডিং ৩৯.২০৫ কিলোমিটার নতুন সিঙ্গেল লাইন ডুয়াল গেজ ট্র্যাক নির্মাণকাজ চলছে। মূল রেলপথের ৬৫ কিলোমিটারে রেললাইন বসে গেছে। এতে ৩৯টি বড় সেতু, ২২৩টি ছোট সেতু, ৯৬টি লেভেলক্রসিং, হাতি চলাচলের জন্য আন্ডার ও ওভারপাস নির্মাণকাজ চলছে।
তবে রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮.৩১৮ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। প্রকল্পের এই অংশেও রেললাইনের সঙ্গে নির্মাণ করতে হবে ১৩টি বড় (মেজর) ব্রিজ, ৪৫টি ছোট (মাইনর) ব্রিজ ও ২২টি লেভেলক্রসিং। এ ছাড়া হাতি চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হবে আন্ডার ও ওভারপাস, সঙ্গে থাকছে দুটি নতুন রেলস্টেশন।
প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শুরুতে জমি অধিগ্রহণের জন্য কাজের গতি কম ছিল। করোনার মতো সমস্যাও আমাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে। এখন কাজের গতি ভালো। জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ট্রেন কবে চালানো হবে, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকার নেবে।’
প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৭৮ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় ৯টি নতুন রেলস্টেশন ও এর অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। দুটি স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
খুলবে সীমান্তঘেঁষা আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ : ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার মধ্যে ৭২ কিলোমিটার এই নতুন রেলপথ নির্মাণ হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পুরো রেলপথটি ডুয়াল গেজ ডাবল লাইনে রূপান্তরিত হবে। সীমান্তে জটিলতার কারণে পুরো পথের কাজ একসঙ্গে শেষ করতে পারেনি রেলওয়ে। তাই ২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর লাকসাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার অংশ ট্রেন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
এদিকে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) আপত্তির কারণে ১৫ মাস ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা স্টেশন এলাকা এবং সালদা নদীতে রেল সেতু ও স্টেশন এলাকায় রেলপথ নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল। চলতি মাসে এক সপ্তাহ কাজ করা গেলেও গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিএসএফের আপত্তির কারণে সেই কাজ আবার বন্ধ করতে হয় রেলওয়ের।
দুই দেশের সীমান্তের শূন্য রেখা থেকে ১৫০ গজের মধ্যে রেলের এই নির্মাণকাজ হওয়ায় আপত্তি তুলেছে বিএসএফ। যদিও এখানে আগে থেকেই মিটার গেজ রেললাইন আছে। এর পাশে ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন রেলপথ করতে চায় বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্ত গীন বলেন, ‘বিএসএফের আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। তবে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। পুরো পথেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ট্রেন চালাব। প্রয়োজনে বিকল্প ভাবা হচ্ছে।’
প্রকল্প নথি বলছে, এই রেলপথ পুরো চালু হলে আগের চেয়ে ট্রেনে চলাচলে অন্তত ২৫ মিনিট সময় কম লাগবে। এ ছাড়া বর্তমানে এই পথে ২৩ জোড়া ট্রেন চলাচল করে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এই রুট দিয়ে ৭২ জোড়া ট্রেন চলাচলের সক্ষমতা তৈরি হবে। সেই সঙ্গে মালবাহী কনটেইনার চলাচলেরও সক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়বে।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান গতকাল বলেন, যদিও প্রকল্পের অধীন মূল রেলপথ ৬৫ কিলোমিটার, তবে লুপসহ ৯০ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক বসানো হবে। এরই মধ্যে ৮০ কিলোমিটার রেললাইন বসানো হয়েছে। বর্তমানে চারটি বড় সেতুতে বেশ কিছু কাজ বাকি আছে।
২০১০ সালে শুরু হওয়া খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। অথচ বারবার নকশা পরিবর্তন হওয়ায় বেড়েছে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা থাকলেও বর্তমানে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে চার হাজার কোটি টাকার বেশি।
প্রিন্ট