আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের যে দেশগুলোতে খাদ্য উৎপাদন বাড়তে পারে, বাংলাদেশ তার একটি। জলবায়ু-যুদ্ধে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশের মানুষের মনের জোর ও লড়াই করার শক্তি পৃথিবীতে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই তো জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলা করে বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে টিকে আছে, কোন কৌশলে তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছে, তা জানতে ও দেখতে বিশ্বের তাবৎ বড় বড় জলবায়ু বিজ্ঞানী বাংলাদেশে আসছেন। জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে বিশ্ব গবেষণা কেন্দ্র। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি অভিযোজনবিষয়ক প্রতিবেদনে এসব বলা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হয়েও জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে হাত পেতে বসে থাকেনি। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ) গঠন করে। বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি-২০০৯) চূড়ান্ত করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম দেশ, এ ধরনের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। নিজস্ব অর্থায়নে এ ধরনের তহবিল গঠন বিশ্বে প্রথম, যা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুরুশকুল আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। জলবায়ু ইসু্যকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেছে। নতুন নাম করা হয়েছে ‘পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন’ মন্ত্রণালয়। এতে জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সহজ হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের ২৫টি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের জন্য ৮ শতাংশেরও কম বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের মোট জাতীয় বাজেটের ৫৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। জানা যায়, প্রায় ২৫৩ দশমিক ৫৯ একর জমির ওপর নির্মাণাধীন ১৩৯টি পাঁচ তলাবিশিষ্ট ভবনে চার হাজার ৪০৯টি পরিবার পুনর্বাসিত হচ্ছেন। এক হাজার ৮০০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।
এরই মধ্যে বিশটি পাঁচ তলাবিশিষ্ট ভবনে ৬০০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে নতুন ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পাঁচতলা ভবনে থাকছে ৪৫৬ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি করে ফ্ল্যাট। প্রকল্প এলাকায় ২০ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ৩৬ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য পরিশোধন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, তীর রক্ষা বাঁধ, ছোট সেতু, ১৪টি খেলার মাঠ, মসজিদ, মন্দির, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পুলিশ ও ফায়ার স্টেশন, তিনটি পুকুর, নদীতে দুটি জেটি এবং দুটি বিদু্যতের সাবস্টেশন করা হয়েছে। প্রতিটি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার এক হাজার এক টাকার বিনিময়ে প্রায় ৪৫৬ বর্গফুটের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত ফ্ল্যাট পাচ্ছেন। যেখানে প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথকর্ যাম্প, সোলার প্যানেল, বিশুদ্ধ পানির সুবিধা, বিদু্যৎ, স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং গ্যাস সিলিন্ডারসংবলিত চুলার ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যটনের জন্য সবুজ বনায়ন ও শুঁটকি পলস্নী করা হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পটি অত্যন্ত নয়নাভিরাম একটি জায়গায় গড়ে উঠেছে। প্রতিটি ভবনের নিচের তলায় কোনো ফ্ল্যাট রাখা হয়নি। এতে ঘূর্ণিঝড় হলে জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢোকারও আশঙ্কা নেই। অভিযোজনের পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রশমনে বিশ্বে এগিয়ে আছে।
এবার প্রশমনে গুরুত্ব দিতে স্কটল্যান্ডের গস্নাসগোতে ২৬তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সবুজ জলবায়ু তহবিলে (জিসিএফ) প্রদানের প্রতিশ্রম্নতি পূরণের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোকে আহ্বান জানান। তিনি উন্নত দেশগুলোকে অভিযোজন ও প্রশমনে অর্ধেক অর্ধেক (৫০: ৫০) ভিত্তিতে অর্থ সরবরাহ করার তাগিদ দেন। সিভিএফ সভাপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু সম্মেলনে সোচ্চার ও জোরালো ভূমিকার জন্য নেতৃত্বের আসনে থাকেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের (আইপিসিসি) মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দায়ী না হয়েও বাংলাদেশ সীমিত সম্পদ নিয়ে নিজ উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রকৃতির রুদ্ররূপের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে উদাহরণ। নানা উদ্ভাবনীমূলক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু অভিযোজন কার্যক্রমে বেশ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।ভাসমান পানিতে সবজি চাষ করে বাংলাদেশ বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
কৃষকদের নিজস্ব উদ্ভাবিত এই মডেলটিকে বৈশ্বিক জলবায়ু অভিযোজনের সেরা মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছে গেস্নাবাল কমিশন অন অ্যাডাপ্টেশন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটি জনগোষ্ঠী কতটা উদ্ভাবনী হতে পারে, বাংলাদেশ তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। জিসিএ (গেস্নাবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশন) বাংলাদেশের মাধ্যমে তাদের মূল্যবান শিক্ষা গ্রহণ করে বাকি বিশ্ব নতুন জলবায়ু বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশকে জলবায়ু অভিযোজনের সেরা শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করেছেন তিনি। এ বিষয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডক্টর মঞ্জুরুল হান্নান খান গণমাধ্যমকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলোকে শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ।
গত কয়েক বছরে সরকার দুর্যোগ ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। উপকূলীয় এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে, যা ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে দুর্যোগে মৃতু্যহার উলেস্নখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও উপার্জন হারানোর হার ক্রমে বাড়ছে। সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা সংক্রান্ত কর্মকান্ডে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতে বার্ষিক বরাদ্দের ৬ থেকে ৭ শতাংশ ব্যয় করছে। বছরে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ভয়াবহতা থেকে জানমাল রক্ষার্থে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের ১৯ জেলার মোট ১৪ হাজার ৬৩৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২৩ লাখ ৯০ হাজার ৩০৭ জনকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। সুপার এ সাইক্লোনে মৃতু্য ২৩ জনের। দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোড মডেল। বিশ্বব্যাংকের জলবায়ু পরামর্শক নজরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে আগামী দিনগুলোর ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ-ডেল্টা পস্ন্যান বা ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ হাতে নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষিত রেখে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় আর কী কী করণীয়- তার সবই রয়েছে এই ব-দ্বীপ মহাপরিকল্পনায়।
এর মধ্যে বন্যা, নদীভাঙন, নদীশাসন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নগরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশলও নির্ধারণ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি এখন বাস্তব। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই ভয়াবহতার শিকার হচ্ছে। জলবায়ুবিষয়ক প্রতিষ্ঠান আইপিসিসি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতি তো পিছু ছাড়ছে না বাংলাদেশের। তারপরও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে উদাহরণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় চার কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। জলবায়ুসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনে শীর্ষে বাংলাদেশ। বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে সহনশীল ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। ১৯৭০ সাল থেকে দেশি জাতকে উন্নত করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাত উদ্ভাবনের পথে যাত্রা করেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ১১৭টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ৯৫টি ইনব্রিড ও ৭টি হাইব্রিড উচ্চ ফলনশীল।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) বিজ্ঞানীরা ১৫টি জলবায়ুসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্যে লবণসহিষ্ণু ৯টি, খরাসহিষ্ণু দুটি ও বন্যাসহিষ্ণু চারটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন তারা। বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এতগুলো প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে। সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের বড় বিজ্ঞানী হলেন কৃষক।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বছরের পাঁচ থেকে আট মাস হাত গুটিয়ে বসে না থেকে কৃষকরা নিজেরাই ফসল উৎপাদনের উপায় বের করেছেন। কৃষকরা কচুরিপানা, লতাপাতা, দুলালীলতা, শ্যাওলা, টেপাপানা, গুঁড়িপানা ইত্যাদি জলজ উদ্ভিদের সঙ্গে খড়কুটো ও নারিকেলের ছোবড়া গুঁড়া স্তরে স্তরে সাজিয়ে, পানির ওপর ভাসমান ধাপ তৈরি করে তাতে সারা বছর ফসল উৎপাদন করছেন। এই উদ্ভাবন বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাংলার দামাল কৃষকরা। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতিসংঘের সেরা অভিযোজন প্রকল্পের স্বীকৃতি পেয়েছে ‘ভাসমান ধাপে ফসল চাষ’ পদ্ধতি। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এএফও) কৃষি ঐতিহ্য অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কৃষকদের ব্যক্তিগত এ উদ্ভাবন জলবায়ু মোকাবিলায় একটি নতুন কৌশল হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের (আইপিসিসি) মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দায়ী না হয়েও বাংলাদেশ সীমিত সম্পদ নিয়ে নিজ উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রকৃতির রুদ্ররূপের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে উদাহরণ।
প্রিন্ট