দলীয় ফোরামের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা, স্থানীয় নির্বাচনে নৌকাকে হারানো, নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব, ক্রমাগত অভিযোগসহ নানা কারণে আওয়ামী লীগের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথকে।
গত রোববার বরিশাল জেলা শাখা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। গতকাল সোমবার দলের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদ সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অর্পিত ক্ষমতাবলে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আপনাকে (পঙ্কজ নাথ) আওয়ামী লীগ বরিশাল জেলা শাখার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদসহ দলীয় অন্যান্য সব পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। উক্ত বিষয়ে আপনার লিখিত জবাব আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় দপ্তর বিভাগে জমা দেওয়ার জন্য সাংগঠনিক নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে পঙ্কজ নাথ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাকে দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। সে বিষয়ে আমিও চিঠি পেয়েছি। কিন্তু কেন দিয়েছে তা আমি জানি না। তবে জানার চেষ্টা করছি।’
‘জানার চেষ্টা করছেন’ বললেও পঙ্কজ নাথ বিষয়টি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। যা গত রোববার বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দলটির কার্যনির্বাহী সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বাসায় দেখা করতে যাওয়ায় বোঝা যায়। কিন্তু সেই বৈঠকে ফল আসেনি। বরিশালের স্থানীয় কিছু সংবাদমাধ্যমে সেই ছবি গতকাল প্রকাশিতও হয়।
আরও পড়ুনঃ দেড়মাসে ৭টি পৃথক সংঘর্ষে নিহত ২, আহত শতাধিক
এদিকে এমপি পঙ্কজকে আওয়ামী লীগের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জে দলের একাংশ মিষ্টিমুখ করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে। জানতে চাইলে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘জেলার উপদেষ্টা পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর পঙ্কজ নাথ আওয়ামী লীগের অন্য কোনো শাখা বা অঙ্গসংগঠনের পদে নেই। সে হিসেবে তিনি এখন আওয়ামী লীগের কেউ নন।’
বরিশালের রাজনীতিতে সবচেয়ে সংঘাতপূর্ণ এলাকা হচ্ছে মেঘনা ঘেরা মেহেন্দিগঞ্জ ও হিজলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৪ সংসদীয় আসন। সেখানে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ সব সময়ে মুখোমুখি অবস্থানে থাকে। হামলা-পাল্টা হামলা চলতেই থাকে। যে কারণে জেলার রাজনীতিতে বছর জুড়ে আলোচনায় থাকে হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ।
২০১৪ সালে এমপি হওয়ার পর হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জে পঙ্কজ নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন। নিজস্ব বলয় তৈরি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ফলে তাঁর বিরোধীরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর দিকে অবস্থান নেন। ওই সময় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দুই উপজেলায় তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের নামে শক্তিশালী বাহিনী তৈরি করেন।
২০১৬ সালের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সুপারিশে চেয়ারম্যান পদে বেশির ভাগ ইউনিয়নে মনোনয়ন পান পঙ্কজ বিরোধীরা। ওই সব ইউনিয়নে তাঁর মদদে বিদ্রোহী প্রার্থী হন তাঁর অনুসারীরা। একই অবস্থার সৃষ্টি হয় গত ইউপি নির্বাচনে। এর মাঝে মেহেন্দিগঞ্জ ও হিজলা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও এমপি সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে নৌকার প্রার্থী পরাজিত হন। অভিযোগ আছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দুটি উপজেলা পরিষদ ও ৯টি ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারিয়ে দেন পঙ্কজ। ওই এলাকায় স্থানীয় নির্বাচনে কথিত আছে ঘোড়া প্রতীক মানেই ছিল নৌকার বিরুদ্ধে পঙ্কজের প্রার্থী।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মুনসুর আহমেদ বলেন, পঙ্কজ নাথের নির্দেশে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। পঙ্গু হয়েছেন অসংখ্য নেতা-কর্মী। তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তাঁদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালান। পঙ্কজ অনেক আগেই আওয়ামী লীগে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।
অবশ্য তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলমের মতে, পঙ্কজ নাথ ষড়যন্ত্রের শিকার। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এমনভাবে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে যে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
অমর একুশের গানের গীতিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত গাফফার চৌধুরীর জন্মস্থান মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া ইউনিয়নে। বছরখানেক আগে এক অনুষ্ঠানে গাফফার চৌধুরীর জন্ম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে অশালীন মন্তব্য করেন পঙ্কজ নাথ, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই সময়ে ভাইরাল হয়। গত ৫ জুলাই সন্ধ্যায় তাঁর লোকজন প্রতিপক্ষের রাতুল চৌধুরীকে কুপিয়ে জখম করে। এরপর ওই দিন রাত ৮টার দিকে পঙ্কজ নাথ মেহেন্দিগঞ্জ থানার পরিদর্শককে (তদন্ত) তৌহিদুজ্জামানকে মোবাইল ফোনে বলেন, তার লোকজন পৌর মেয়র কামালকে সামনে পাইলে কোপাবে। মোবাইলের ওই আলাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালে হয়।
এ ছাড়া মেহেন্দিগঞ্জে অন্য এক অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম মহিউদ্দিন আহমেদ নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন পঙ্কজ নাথ।
বরিশালে আওয়ামী লীগ চলে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নির্দেশে। বরিশালের ৬টি আসন তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও ২০১৪ সালের পর থেকে পঙ্কজের বরিশাল-৪ আসনে তাঁর কিছু করার ছিল না। মেঘনা ঘেরা হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জের শত শত একর খাস জমি আর কোটি কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ নিয়ে পঙ্কজ নাথ ও আবুল হাসানাত অনুসারীদের মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
এ সব কারণে এক সময়ের হাসানাত বিরোধীরাও এখন এককাট্টা হয়ে পঙ্কজের বিরুদ্ধে সোচ্চার। যে কারণে চলতি বছরে হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জে বেশ কয়েকটি সমাবেশে তাঁর বিরুদ্ধে এককাট্টা হন শাম্মী আহমেদ, শাহ আলম মুরাদ, তালুকদার মো. ইউনুস, আফজালুল করিম ও কামাল উদ্দিন খান। তাদের প্রধান টার্গেট হাসনাতের নেতৃত্বে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল-৪ আসনে নিজেদের এমপি প্রার্থী নিশ্চিত করা।
বরিশাল-৪ আসনে এক সময়ের নৌকার প্রার্থী আফজালুল করিম বলেন, পঙ্কজ নাথকে অব্যাহতি দিয়ে দল ১৫ দিনের মধ্যে জবাব চেয়েছে। তাঁর জবাবে যদি দল সন্তুষ্ট না হয় তবে তাঁকে চূড়ান্ত বহিষ্কার করবে। সে ক্ষেত্রে তাঁর সংসদ সদস্য পদ ঝুঁকিতে পড়বে।
আরও পড়ুনঃ না ফেরার দেশে চলে গেলেন বর্ষীয়ান নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, নিজে থেকে পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত সংসদ সদস্য থাকতে পারবেন পঙ্কজ নাথ। তবে রাজনীতিতে তাঁর অবস্থা হবে যুবলীগের সাবেক প্রভাবশালী সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর মত। আস্তে আস্তে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাবেন তিনি।
প্রিন্ট